লেখা: লুবনা তুরীন
বাংলাদেশের ইতিহাসে আলবদর ও জামায়াত নেতা আজহারুল ইসলামের মৃত্যুদণ্ড থেকে মুক্তি, খালি কি একটা মামলার রায়? না। এটা ইতিহাস কীভাবে লেখা হয় এবং রাষ্ট্র কাকে প্রতিনিধিত্ব করে, এই দুটি প্রশ্নের সংকটপূর্ণ প্রকাশ।
আজহারুলের বিরুদ্ধে ১৯৭১ সালে রংপুর অঞ্চলে সংগঠিত হত্যাকাণ্ড, গণধর্ষণ ও নির্যাতনের অভিযোগে ২০১৪ সালে মৃত্যুদণ্ডাদেশ হয়, যেখানে রাষ্ট্রপক্ষ ১৯ জন প্রত্যক্ষদর্শী সাক্ষীর সাক্ষ্য, ডকুমেন্টারি প্রমাণ ও আজহারুল ইসলামের নিজ বক্তব্য উপস্থাপন করে।
কিন্তু আজকে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের রায়ে তাকে নির্দোষ ঘোষণা করে মৃত্যুদণ্ড বাতিল করেছে। বিচারিক বিচারে নতুন প্রমাণ উপস্থাপনের পরিবর্তে ‘সন্দেহাতীতভাবে অপরাধ প্রমাণ হয়নি’, এই যুক্তিতে রায়টি গৃহীত হয়েছে।
কিন্তু এই রায় যুক্তির নিরিখে প্রশ্নবিদ্ধ, কারণ আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের বিচারের নীতিমালায় ‘বিয়ন্ড রিজনেবল ডাউট’ নয় বরং ‘প্রি পন্ডারেন্স অফ এভিডেন্স’ বা অধিক সম্ভাবনার ভিত্তিতে বিচার গ্রহণযোগ্য।
সবচেয়ে বড় কথা, একজন বীরাঙ্গনা, যিনি নিজে ১৮ দিন ধরে টাউন হলের ভেতরে ও বাইরে পাকিস্তানি সেনাদের হাতে গণধর্ষণের শিকার হন, এবং সাক্ষ্য দেন, তখন সেটা আদালতের ‘testimony’ বা ‘witness statement’ এর বাইরেও একটি embodied historical truth হয়ে ওঠে।
‘টাউন হলে আরও অনেক নারীর সঙ্গে আমাকে আটকে রাখা হয়। বাইরে আমার ওপর পাশবিক নির্যাতন চালানোর পর টাউন হলেও নির্যাতন করে পাকিস্তানি সেনারা। ১৮ দিনের মাথায় গর্ভের সন্তানটি নষ্ট হয়ে গেলে আমি অসুস্থ হয়ে পড়ি। পরে কে বা কারা আমাকে বাড়িতে ফেরত পাঠায়। সেদিন থেকে আজহারের কঠিন শাস্তি চেয়েছি। আজ সে চাওয়া পূরণ হল।‘
বীরাঙ্গনা মানসুরা (বিডিনিউজ২৪, ৩০ ডিসেম্বর ২০১৪)
এই যে স্টেটমেন্টটা, এইখানে কী খালি নির্যাতনের বর্ণনা? না তো! এটা একটি entire structure of war-time patriarchy, militarized masculinity, এবং ethno-political violence এর দলিল হয়ে উঠেছে। বীরাঙ্গনার শরীর একটি আদালতের চেয়ে বড় দলিল।
১৯৯৮ সালে রুয়ান্ডা ট্রাইব্যুনালের Akayesu মামলায় নারীদের ধর্ষণের সরাসরি সাক্ষ্যকে ‘acts of genocide’ হিসেবে গণ্য করে আন্তর্জাতিক আদালত। ঐ মামলায় প্রমাণের ভার ছিল না কোনো মেডিকেল রিপোর্টে, বরং ‘coherent, credible, and consistent testimony of the survivors’-এর উপর ভিত্তি করেই সাজা দেওয়া হয়। আন্তর্জাতিক মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারে আইসিসি, রুয়ান্ডা ট্রাইব্যুনাল, এবং সিয়েরা লিওন ট্রাইব্যুনালের বিচারে বারবার বলা হয়েছে, যুদ্ধকালীন ধর্ষণের শিকার নারীর মৌখিক সাক্ষ্য, যদি বিশ্বাসযোগ্য হয়, তবে সেটাই চূড়ান্ত প্রমাণ হিসেবে গণ্য হতে পারে।
তাহলে বাংলাদেশে একজন বীরাঙ্গনার প্রত্যক্ষ, বিশদ, এবং years-long consistent বয়ান কি আদালতের চোখে ‘beyond reasonable doubt’ নয়? একজন জীবিত সাক্ষী, ধর্ষণের শিকার নারীর সরাসরি সাক্ষ্যকে কি ‘সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ হয়নি’ বলে উড়িয়ে দেওয়া যায়?
আমরা ভুলে যেতে পারি, আদালতও ভুল করতে পারে, কিন্তু ইতিহাস এবং বীরাঙ্গনাদের শরীরবিজড়িত স্মৃতি ভুল করে না। সেই স্মৃতি শুধু ব্যক্তিগত নয়, একটি জাতির আত্মপরিচয়ের সাক্ষ্য।
আজহারুলের বিরুদ্ধে এই ধরনের প্রত্যক্ষ সাক্ষ্য থাকা সত্ত্বেও তার শাস্তি বাতিল শুধু বিচারপ্রক্রিয়াগত নয়, একটি নৈতিক ও রাজনৈতিক ব্যর্থতা।
আচ্ছা বাদ দিলাম নাহয় এইটা পুরুষতান্ত্রিক রাজনৈতিক আদালত এর কাছে, আমি একটু বর্তমান রাষ্ট্রের বিপজ্জনক প্যারাডক্স, মানে জামায়াতের মেটামরফোসিস এবং এই ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের সহযোগিতা নিয়ে কথা বলি;
বর্তমান সরকার, জামায়াত-শিবির ঘরানার রাজনীতির প্রতি এক ধরনের ক্ষমাশীল ভঙ্গি গ্রহণ করছে। জামায়াত বর্তমানে আর ‘রাজাকার’ পরিচয়ে মাঠে নামছে না। তাদের নতুন পরিচয় from Collaborators to Cultural Moralists! I mean তারা একটা মিউটেড, বুদ্ধিবৃত্তিক, ও সাংস্কৃতিক কৌশল গ্রহণ করেছে, NGO খাত, ইসলামি শিক্ষাব্যবস্থা, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এবং ধর্মীয় বয়ানব্যবস্থায়, এইখানে তারা নিজেদের re-brand করছে as ‘moral guardians of society’, যা soft Islamism বা ‘cultural moralism’ এর অন্তর্গত। এই প্রক্রিয়ায় তারা এখন চারটি প্রধান কৌশলে এগোচ্ছে:
- NGO খাতের অনুপ্রবেশ: জামায়াতঘেঁষা সংগঠনগুলো গ্রামীণ উন্নয়ন, কওমি শিক্ষা, এবং নারী উন্নয়নের নামে কার্যত একটি conservative social order প্রতিষ্ঠা করছে, যেখানে ধর্মীয় আদর্শের নাম করে patriarchal domination বজায় থাকে।
- মাদ্রাসা-ভিত্তিক শিক্ষাব্যবস্থার পুনর্গঠন: তারা মাদ্রাসা-ভিত্তিক শিক্ষাকে ‘ethically superior’ বলে প্রচার করছে, যেখানে নারীশিক্ষা, যৌনতা, ও আধুনিক বিজ্ঞানকে বিতাড়িত করে রক্ষণশীলতা প্রতিষ্ঠা করা হয়। এটা একধরনের epistemic cleansing।
- সোশ্যাল মিডিয়া ‘influencer jihad’: ফেসবুক, ইউটিউব এবং টিকটক ভিত্তিক ইসলামি প্রিচারদের মাধ্যমে তারা তরুণদের ‘moral purity’ নামে gender-regressive মতাদর্শে দীক্ষিত করছে। একে বলা যেতে পারে Digital Dawah Politics।
- ধর্মীয় বয়ান-ভিত্তিক রাষ্ট্রদর্শনের চাপ: জামায়াতপন্থীরা এখন সরাসরি রাজনৈতিক দখল না করেও সমাজে একটি ‘moral panic’ সৃষ্টি করছে, যার ফলে রাষ্ট্র বাধ্য হচ্ছে তাদের মতকে accommodate করতে, নারী সংস্কার কমিশনের সুপারিশ মালা তার আদর্শ উদাহরণ ।
Strategic Silence or Ideological Consent? রাষ্ট্র এইসব রূপান্তর জানে, বোঝে তবুও নীরব। এই জায়গায় রাষ্ট্রের নিরবতা বিপজ্জনক। কারণ ‘a silent state is a complicit state’। এটা double betrayal: মুক্তিযুদ্ধের আত্মত্যাগের বিশ্বাসঘাতকতা, যেখানে রাষ্ট্র নিজেই তার প্রতিষ্ঠাকালীন নৈতিক ভিত্তিকে ধ্বংস করছে। গণতন্ত্র ও নাগরিক অধিকার হরণের বিশ্বাসঘাতকতা, যেখানে ধর্মীয় কনজারভেটিজমকে সামাজিক নিয়ন্ত্রণের হাতিয়ার বানানো হচ্ছে।
এই দ্বিচারিতা একটি পরিচ্ছন্ন নৈতিক কাঠামোর ওপর রাষ্ট্র পরিচালনার ধারণাকে ভেঙে দেয়। Gramsci এর ‘passive revolution’ ধারণা বর্তমান প্রেক্ষাপটে নতুন তাৎপর্য লাভ করেছে। রাষ্ট্র সরাসরি জামায়াত কিংবা ৭১-এর যুদ্ধাপরাধীদের আদর্শকে সমর্থন না করলেও, তাদের ‘reform’ করা এক ধরনের আদর্শিক পুনর্বাসনের পথে হাঁটছে।
আজহারুল ইসলামকে ‘বেকসুর খালাস’ দেওয়া কোনো বিচ্ছিন্ন আইনি সিদ্ধান্ত নয়, এটি হলো রাষ্ট্রীয় নৈতিকতার একটি passive shift। এখানে রাষ্ট্র জামায়াতের মতাদর্শকে প্রকাশ্যে গ্রহণ না করলেও, তার বিচারিক, নীতিনৈতিক, ও সাংস্কৃতিক কাঠামোর ভেতর ওই মতাদর্শকে জায়গা করে দিচ্ছে। একেই Gramsci বলেছিলেন, ‘a revolution from above, without a revolution below.’
এইখানে কোনো গণআন্দোলনের দাবি ছিল না, কোন গণচাপে যুদ্ধাপরাধীর বিচার বাতিল হয়নি। বরং ক্ষমতাসীন গোষ্ঠী চুপিসারে এবং ধাপে ধাপে সেই শক্তিকেই ফিরিয়ে আনছে, যাকে একসময় রাষ্ট্রঘাতক বলে চিহ্নিত করা হয়েছিল।
এই প্রক্রিয়াই হলো বাংলাদেশের ‘passive counter-revolution’, যেখানে জামায়াতের মতাদর্শকে ধ্বংস না করে বরং একটি ‘harmless moral alternative’ হিসেবে পুনর্গঠন করা হচ্ছে, NGO, দাওয়াহ মিডিয়া, এবং ইসলামি সামাজিক প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে।
আর রাষ্ট্র এই পুরো পুনর্গঠনের ‘facilitator’ হয়ে উঠেছে, কখনও চুপ করে থেকে, কখনও বিচার বিভাগকে ব্যবহার করে, আবার কখনও ‘আইন-কানুনের প্রক্রিয়া’ বলে দায়সারা যুক্তি দিয়ে।
বর্তমান রাষ্ট্রের এই প্যারাডক্স আমাদের বাধ্য করছে নতুন এক ‘counter-hegemonic narrative’ গঠনে। শুধুমাত্র অতীত-স্মৃতি নয়, বরং একটি তাত্ত্বিক, যৌক্তিক, এবং জনসম্পৃক্ত ভাষায় রাষ্ট্রীয় নীরবতা ও জামায়াতীয় রূপান্তরকে চ্যালেঞ্জ করা, এই লড়াই কেবল রাজনৈতিক নয়, এটা epistemological!
বিচার নয়, ইতিহাসের চূড়ান্ত রায় কে দেবে? আজহারুল ইসলামের মতো যুদ্ধাপরাধীদের মুক্তি রাষ্ট্রীয় ‘due process’ এর ব্যর্থতা নয় শুধু, এটা আমাদের আত্মপরিচয়ের কেন্দ্রে এক ধরনের ideological disintegration। এই রায় একটা সিগন্যাল, বিচারব্যবস্থা ইতিহাসের পক্ষে নয়, শক্তির পক্ষে। নারীর মুখ নয়, রাষ্ট্রের স্বার্থই এখন ‘সত্য’ নির্ধারণ করে।
কিন্তু আমরা তো ফাইটার জাতিগত ভাবেই, আমরা জানি, আত্মরক্ষার একমাত্র ভাষা, স্মৃতি, যুক্তি ও প্রতিরোধ। আর একটা জাতি তার স্মৃতি ভুলে গেলে তার ভবিষ্যৎও শত্রুর দ্বারা নির্ধারিত হয়। এই মুহূর্তে প্রয়োজন ‘counter-historical mobilisation’, যৌক্তিক, নৈতিক ও তথ্যনির্ভর প্রতিরোধ, যা জামায়াত বা আদালত নয়, জনগণের অভিজ্ঞতা ও ঐতিহাসিক স্মৃতি দিয়ে ইতিহাস পুনরায় লিখবে।
আমরা যেন ভুলে না যাই, বীরাঙ্গনাদের শরীরই প্রথম দলিল। সে দলিল যদি রাষ্ট্র না মানে, তবে ইতিহাস মানবে। ইতিহাস মানবেই।
পাঠকের মন্তব্য