শ্রমিক মরলে আমাদের কম কষ্ট লাগে কেন?

১০০ পঠিত ... ১৮:২৬, অক্টোবর ১৬, ২০২৫

লেখা: ফারিয়া জামান নিকি

আজ সারাদিন ভাবছিলাম যে কেন আমার বা সবার মাইলস্টোনের ঘটনাটা থেকে কোনো একটা গার্মেন্টস ফ্যাক্টরির খুনকে আরো 'হালকা ঘটনা' বলে মনে হয়।

খেয়াল করলে দেখবেন মাইলস্টোনের ঘটনার ২-৩ দিন কেউ স্বাভাবিক ছিল না,ফেইসবুকেও ছিল প্রচণ্ড শোকের ছায়া। শ্রমিকের মৃত্যুর ক্ষেত্রে বিষয়টার রিয়্যাকশন কাছাকাছিও না। এই যে অনেকটাই 'কম এম্প্যাথি' অনুভূত হচ্ছে। এটার কারণ কী?

আমরা অনেকেই পুঁজিবাদকে শুধুমাত্র একটা অর্থনৈতিক জিনিস মনে করি। পুঁজিবাদ যে আমদের বিনোদন, সাহিত্য, আর্ট, সংস্কৃতি এমনকি অনুভূতিও নিয়ন্ত্রণ করে-এটা চট করে বোঝা যায় না। মার্ক্স বলেন, পুঁজিবাদের মানুষ শ্রমশক্তি হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ, মানুষ হিসেবে নয়। এই মানুষের অর্থনৈতিক মূল্যবোধই ধীরে ধীরে সাংস্কৃতিক মূল্যবোধে পরিণত হয়।

এটাকে সবাই খারাপ মানুষ তাই শ্রমিকের জন্য শোক করছে না, বিষয়টা মোটেও এমন না। অথবা, কয়েকজন 'বুর্জোয়ার' শ্রমিক মরাতে যায় আসে না, তেমনও না। বরং আমাদের শোকও পুঁজিবাদ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। মালিকদের হাতে থাকে মিডিয়া, নিউজ, পত্রিকা অর্থাৎ ন্যারেটিভ উৎপাদনের ক্ষমতা। এই বয়ান শাসক, উচ্চবিত্ত বা মধ্যবিত্তের জীবনকে 'শোকযোগ্য' বানায়। আর শ্রমিকের জীবনকে বানায় 'রিপ্লেসেবল'। শ্রমিককে মানুষ হিসেবে দেখতে কষ্ট হয়। শ্রমিক মরলে কেউ বলে না ১৬ বছরের বাচ্চা মরছে, শ্রমিক মরলে তাদের প্রেম কাহিনী নিয়া কোনো sad story লেখে না।

শ্রমিক মরলে কেউ শোকের ফটোকার্ড দেয় না। হয় না কোনো রাষ্ট্রীয় ছুটি। আমরাও আমজনতা, শ্রমিকের নিউজগুলো স্ক্রল করে যেতেই পছন্দ করি। করব না কেন? ওদের কান্নাটাও তো আমাদের মতো না।

তাই আমরা কনজিউমাররা কখনও শ্রমিকের মৃত্যু রোমান্টিসাইজ করতে পারি না। তাই মাইলস্টোনের গল্পে হিরো থাকে, সার্ভাইভার থাকে, ভিলেন থাকে, বিতর্ক থাকে।

সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, গল্প থাকে। অন্যান্য ট্র‍্যাজিডিতে তীব্রভাবে গল্প থাকে। গরীব মাইনষ্যের ট্রাজিডিতে কোনো ডেপথ থাকে না, গল্প থাকে না, ইমোশোন থাকে না। স্রেফ একটা দুর্ঘটনা কিংবা ঘটনা। শ্রমিক মরছে।

তাতো প্রতিমাসেই মরে। নতুন কী? তাই শ্রমিকের মৃত্যু আর রাস্তায় ট্রাক চাপা খাওয়া কুকুরের মৃত্যুর শোকে খুব বেশী পার্থক্য থাকে না।

এই যে শ্রমিককে সমষ্টিগতভাবে মানুষ হিসেবে দেখতে পারার অক্ষমতা, এই অক্ষমতাই শ্রমিকের উপর নিপীড়ন টিকাইয়া রাখে। তাই নায্য বেতন চাইলে কেউ গুলি করতে পারে, চোর সন্দেহে পিটায়া মারতে পারে, ইন্সুরেন্সের টাকার জন্য গেট আটকাইয়া পুড়াইয়া মারতে পারে, রানা প্লাজায় পিষে পিষে খুন করতে পারে। এটা পারে কারণ শ্রমিকদের সাথে আমাদের শোকটা রিলেটবল না। দুঃখজনক হলেও আপনি যতোই অধিকারের পক্ষের লোক হন না কেন, আপনার শোকটাও বর্তমান এই আইন, মিডিয়া, কালচার দ্বারাই নিয়ন্ত্রিত।

জুডিথ বাটলার বলছিল, Some lives are more grievable than others.

তো ধরেন, কোনো কোনো মানুষ মইরাও গুরুত্বপূর্ণ হইতে পারে, যদি আমরা তারে মনে রাখতে পারি। কিন্তু, শ্রমিদের ক্ষেত্রে দেখা যায় তাদের নামও ঝাপ্সা হয়ে ওঠে। তাই গণঅভ্যুত্থানেও নানা প্রতিনিধিত্বের শহীদদের আমাদের মনে থাকলেও, বেশীরভাগ শ্রমজীবী মানুষ মারা গেলেও আমরা সব শহীদ হিসেবেও তাদেরই মনে রাখি যারা ইকোনমিক-কালচারালভাবে গুরুত্বপূর্ণ।

রানা প্লাজায়, তাজরিনে, সেজান জুসে–আমি কোনো শ্রমিকের নাম মনে করতে পারি না। গুলি খাওয়া নাম মনে করতে কষ্ট হয়। অথচ, বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া, মধ্যবিত্ত আমার সাথে রিলেটবেল 'নিপীড়িত' মানুষদের নাম মনে করতে কোনো কষ্ট হয় না।

যে ব্যবস্থাটার হাতে আমাদের শোকেরও নিয়ন্ত্রণ থাকে, সেই ব্যবস্থারে ভয় করা শিখেন। আর সাথে এটাও প্রশ্ন কইরেন, শ্রমিকদের ফ্যাক্টরিতে আগুন লাগলে ছাদ/গেট কেন বন্ধ থাকে?

কেন শ্রমিকদের ওয়াশরুমের চাবি ম্যানেজারের কাছে থাকে?

কেন 'টি-স্টেট' শ্রমিকদের সাথে কথা বলতেও মালিকদের অনুমতি লাগে?

জানি এই পুরা সিস্টেমটাই আপনারে শ্রমিকরে নিয়া বেশীক্ষণ ভাবতে আর শোক অনুভব করতে দেয় না। এই শ্রমিকদের নিয়ে ভাবার কাজটাও, শোক করাটাও আপনি শুধুই বামপন্থীদের ঘাড়েই ফেলতে চান।

তবুও চেষ্টা কইরেন। শ্রমিকরা তো খালি শ্রমিক না, মানুষও। আমার আপনার মতোই তীব্রভাবে মানুষ।

১০০ পঠিত ... ১৮:২৬, অক্টোবর ১৬, ২০২৫

আরও eআরকি

পাঠকের মন্তব্য

আইডিয়া

কৌতুক

রম্য

সঙবাদ

স্যাটায়ার


Top