আমলাতন্ত্রের সাথে ৫ বছরে যত সার্কাস দেখেছি

২৩৬ পঠিত ... ১৬:৫৭, মে ২৭, ২০২৫

10

লেখা: আমিনুল ইসলাম ইমন

আমলাদের সাথে পাঁচ বছর কাজ করেছি। সপ্তাহে কমপক্ষে দুইদিন মন্ত্রণালয়ে যেতে হতো।

কয়েকটা অভিজ্ঞতা বলি।

১#

মন্ত্রণালয়ের মিটিং রুমে বেশিরভাগ সিদ্ধান্ত হয়। মিটিং শুরুর আগে আনুমানিক চল্লিশটা চেয়ারের মধ্যে কে কোন চেয়ারে বসবেন সেটার অলিখিত এক জটিল ডিফারেনসিয়াল ক্যালকুলাসের মাধ্যমে তারা হিসাব করেন এবং সঠিক চেয়ারে তারা বসে পড়েন। তাদের জীবনের সব কাজে ভুল হয়, কিন্তু চেয়ার চিনতে ভুল হয় না।

২#

মিটিং-এ মূলত: তারাই কথা বলেন যারা ওই কাজের ব্যাপারে সবচেয়ে কম জানেন। যারা কাজ বা প্রকল্প সম্পর্কে জানেন, ডকুমেন্টগুলো বানিয়েছেন এবং মাঠে থেকে কাজটা করবেন, তাদেরকে দ্বিতীয় সারির চেয়ারে বসিয়ে রাখা হয়। প্রশ্ন না করা হলে তাদের মুখ বন্ধ রাখাই নিয়ম।

৩#

মিটিং-এর উচ্চ পদ-ধারী দু-তিন জন বাদে বাকি সবার বক্তব্য হয় দুই/ তিন মিনিট করে। তারা এই অল্প সময়ের মধ্যে উপস্থিত সকলের নাম, পদবী উল্লেখ করে তাদের প্রতি শ্রদ্ধা, ভালোবাসা, আনুগত্য ইত্যাদি উচ্চারণ করতে করতে বেশিরভাগ সময় চলে যায় এবং রাজনৈতিক দলগুলোর নেতাদের মতোই তাদের নিজস্ব মত থাকে না বলে বক্তব্যের শেষ মিনিটে মিটিং-এর চেয়রপার্সনকেই মতামত দিতে অনুরোধ জানান।

৪#

ভণ্ডামি, বাটপারি, তেলবাজি, অভিনয়, স্বজনপ্রীতি, দলবাজি ও গ্রুপিং। এগুলো দেশের সব অফিসে থাকলেও, মন্ত্রণালয়ের মতো এত নিষ্ঠা, মেধা ও সময় দিয়ে প্র্যাকটিসের উদাহরণ আর কোনো সরকারি বা বেসরকারি সেক্টরে নাই। এগুলো করা ছাড়া শুধু কর্মদক্ষতা ও সততা দিয়ে মন্ত্রণালয়ের উচ্চ পদে যাওয়ার কোনো রাস্তা নাই। এগুলো না পারলে জয়েন্ট সেক্রেটারি হবে তার জীবনের শেষ পদ।

৫#

মিজানুর রহমান নামে  এরকম এক জয়েন্ট সেক্রেটারি ছিলেন, স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ে। উনি মাইনাস টু ফর্মুলার জন্য ব্যাপক সক্রিয় ছিলেন। একটা প্রকল্প ভিজিটে তার সাথে সিলেট গেছিলাম। সেখানে প্রায় দৌড়ে টিলার মাথায় উঠে গেলেন। সেই উনি যখন কিছুদিন পর টের পেলেন মাইনাস টু হচ্ছে না বরং আওয়ামীলীগ ক্ষমতায় আসার সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে, এরকম সময়ে তিনি নিজেকে মুক্তিযোদ্ধা দাবি করে সবাইকে মুক্তিযুদ্ধের গল্প শোনাতে লাগলেন। কিছুদিন পর তার ডান পায়ের গোড়ালিতে গুলি লেগে ক্ষত হয়েছে বলে নিজের পা দেখাতে লাগলেন। সেখানে অবশ্য কোনো ক্ষত কেউ না দেখতে পেলেও সবাই খুবই সহানুভুতির কথা বলতেন। ২০০৮ সালের নির্বাচনের আগে আগে তার সেই চল্লিশ বছর আগের গুলি খাওয়া পায়ের গোড়ালির ব্যথা বেড়ে গেল। উনি পঙ্গু হসাপাতাল থেকে এলুমিনিয়ামের লাঠি কিনে হাতে ধরে খুঁড়িয়ে হাঁটতে শুরু করলেন।

তারপরের ঘটনা সবার জানা আছে। আওয়ামীলীগ সরকার ক্ষমতায় আসার দুই মাসের মধ্যে এডিশনাল সেক্রেটারি হলেন। কয়েক মাস পরে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের পূর্ন সচিব হলেন। বিপুল উৎসাহে মুক্তিযুদ্ধের সার্টিফিকেট বিক্রি করতে লাগলেন। একদিন আমাকে জিজ্ঞেস করলেন সার্টিফিকেটের জন্য আবেদন করব কিনা। জন্ম একাত্তরের পরে হবার কারণে আবেদন করতে না পেরে খুব আফসোস করলাম।

এই ভদ্রলোকই মুক্তিযুদ্ধের জন্য ভারতীয় সেনাদের ডেকে গোল্ড মেডেল দিয়েছিলেন। এবং সেই গোল্ড মেডেলে যে কোনো গোল্ড নাই সেটা নিয়ে মিডিয়ায় ব্যাপক হইচই হয়, এবং আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় বাংলাদেশ নিয়ে অনেক হাস্যরস হয়।

ভয়ঙ্কর ব্যাপার হলো উনি একা না, আমি আরও কয়েকজন সচিবকে দেখেছি একই ধরনের কাণ্ড করতে।

এবং আমি এও নিশ্চিত যে ভবিষ্যতে জামায়াত ক্ষমতায় আসলে দ্রুত দাড়ি রেখে তারা যে গোপনে হিজবুত তাহরীর করতেন সেই গল্প প্রচার করে বেড়াবেন।

৬#

এরা খুব বিদেশ ভ্রমণ করতে পছন্দ করেন। সেখানে নাকি তারা ট্রেনিং নেন। কতটুকু ট্রেনিং করেন আর কতটুকু ঘুরে বেরান সেটা আমরা জানি। সেই প্রসঙ্গে এক ম্যাডাম সেক্রেটারির গল্প বলি। উনি স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় থেকে অনেকগুলো দেশ ভ্রমণে গেলেন, নিম্ন আয়ের আবাসন বিষয়ে অভিজ্ঞতা ও শিক্ষা নিতে। সেই প্রকল্পের ডিজাইনার আমি। আমার যাওয়া দূরে থাক উনি কী দেখে আসেন আর কী শিখে আসেন আমাকে না কাউকে বলেন না। ভাবলাম কোনো একদিন হয়তো বলবেন।

একদিন সব ট্যুর শেষ হলো। আমি দেখা করতে গেলাম। যেয়ে দেখি ওইদিন তার বিদায় সংবর্ধনা হচ্ছে। উনি মৎস্য মন্ত্রণালয়ে যাচ্ছেন। আমাকে সময় দিলেন। আমি বললাম আপনি যে এত কিছুর ট্রেনিং নিলেন সেগুলো এখন দেশের কী কাজে লাগবে? মৎস্য মন্ত্রণালয়ে যেয়ে কীভাবে কাজে লাগবেন এগুলো? উনি গম্ভীরভাবে বললেন অভিজ্ঞতা থাকলে কোনো না কোনো কাজে লাগবেই। পাশে বসা উপ-সচিব মাথা নেড়ে সায় দিলেন।

এরকম শত শত অভিজ্ঞতা আছে। যারা ওখানে বেশিদিন থাকে তারা এই অদ্ভুত জীবনে অভ্যস্ত হয়ে যায়। তাদের কাছে এটাই স্বাভাবিক।

দেশে রাজনীতির পরিবর্তন হয়। সকল প্রতিষ্ঠানের কম বেশি পরিবর্তন হয়। ভূমিকম্প হলে হিমালয় পর্বতমালাও দু তিন ইঞ্চি নড়ে চড়ে বসে। কিন্তু বাংলাদেশের মন্ত্রণালয়ের পরিবর্তন অসম্ভব। ড. ইউনূস এর প্রভাব হয়তো দেশের রাজনীতিতেও খানিকটা পরিবর্তন আনতে পারবে, কিন্তু এই মন্ত্রণালয়ের কালচারের পরিবর্তন আনতে পারা আমার মতে অসম্ভব।

তার পরেও হাসনাত আব্দুল্লাহকে বলব, চেষ্টা করো, দেখো কী হয়।

 

২৩৬ পঠিত ... ১৬:৫৭, মে ২৭, ২০২৫

আরও eআরকি

পাঠকের মন্তব্য

আইডিয়া

কৌতুক

রম্য

সঙবাদ

স্যাটায়ার


Top