১৯৭২ সালের সংবিধানে একদলীয় শাসন ব্যবস্থা প্রবর্তনের মধুভাণ্ড আছে। যিনি প্রধানমন্ত্রী, তিনিই দলীয় প্রধান আবার অনন্তকাল তিনি প্রধানমন্ত্রী হতে পারবেন; এই স্বপ্নের বীজ পোঁতা আছে ঐ সংবিধানের জমিনে। রাষ্ট্রপতি হবেন ক্ষমতাহীন অলংকার, বিশ্ববিদ্যালয় সমাবর্তনে ভাষণ দেওয়া, মাজার জিয়ারত, রোজার ঈদে বঙ্গভবনে সবাইকে ডেকে সেমাই খাওয়ানো; আর প্রধানমন্ত্রীর পাঠানো প্রতিটি প্রস্তাবে লক্ষ্মী ছেলেটির মতো স্বাক্ষর করে দেওয়া ছাড়া আর বিশেষ দিবসে বাণী দেওয়া ছাড়া তার আর কোনো কাজ নেই।
আবহমান বাংলার পঞ্চায়েত প্রধান যেমন একটি গ্রামের সর্বময় ক্ষমতার মালিক; তার অঙুলি হেলনে গ্রামে সূর্য ডোবে ও অস্ত যায়; সে চাইলে মুখে গামছা বেঁধে তার খুনে বাহিনী যেভাবে অবাধ্য গ্রামবাসীকে খুন করে নদীতে বস্তা বেঁধে ডুবিয়ে দেয়; ৭২-এর সংবিধানটি প্রধানমন্ত্রীকে ঐ পঞ্চায়েত প্রধান কল্পনা করে লেখা।
এই সংবিধান যে শাসন ব্যবস্থা কায়েম করেছে; তা জনগণের নাগরিক অধিকার কেড়ে নিয়ে তাকে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের জমিদারতন্ত্রের অধীনে নির্যাতিত প্রজায় পরিণত করেছে।
এই সংবিধানের মধুভাণ্ডের সব মধু ঢেলে খেয়ে ৩০০টি নির্বাচনী এলাকায় ৩০০ জমিদারি এলাকা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এই সংবিধানে উক্ত চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের বীজ ফ্যাসিজমের বিষবৃক্ষ হয়েছে।
২০২৪ সালের জুলাই বিপ্লবে এদেশের ছাত্রজনতা সে ফ্যাসিজমের বিষবৃক্ষ উপড়ে ফেলতে চেয়েছে। কিন্তু ফ্যাসিজম বৃক্ষের বাজপাখি উড়ে গেলেও বৃক্ষটি রয়ে গেছে। পুরোনো রাজনৈতিক দলগুলোকে এই বৃক্ষের দ্রুত দখল নিতে অস্থির হয়ে উঠতে দেখা গেছে।
যে সংবিধান একের পর এক স্বৈরাচারি শাসন ব্যবস্থার কালা জাদুর পাণ্ডুলিপি হয়ে নাগরিকদের নিজভূমে পরবাসী করে রেখেছে; তাতে যেন কোনো পরিবর্তন না ঘটে; সেই জিদ ধরে মরিয়া হয়ে উঠেছে স্বপ্নগ্রস্থ বাজপাখি; যে এই কালাজাদুগ্রন্থের মারণঘাতী মন্ত্রের স্বাদ পেয়েছে।
বৃক্ষ ছেড়ে যাওয়া বাজপাখির জন্য বৃক্ষের দখল নিতে উদ্যত বাজপাখির মায়া প্রদর্শিত হয়েছে বাজপাখি পরিবারের সম্মিলিত মরণকান্না হয়ে।
জুলাই বিপ্লব মানেই আগের সংবিধান আস্তাকুঁড়ে চলে যাওয়া। কিন্তু সমস্ত শক্তি দিয়ে ৭২-এর সংবিধান রক্ষার ধনুক ভাঙা পণের মধ্যে আর যাই হোক দেশপ্রেম বা জনকল্যাণ নিহিত নেই। এতে আছে স্বৈরাচারি শাসনের রক্ষাকবচ। প্রধানমন্ত্রীর সর্বময় ক্ষমতা ব্যবহার করে রাষ্ট্রের সংসদ, নির্বাহী, বিচার বিভাগের স্তম্ভগুলোকে দলীয় স্তম্ভে পরিণত করার সব গ্যারান্টি আছে ঐ সংবিধানে আছে। চতুর্থ স্তম্ভ মিডিয়া ক্ষমতাসীনের কোলে যাত্রাপালার নটনটী হয়ে দোলে; ক্ষমতার ভারসাম্য রক্ষার কোনো পথ খোলা নেই।
সংসদের একটি উচ্চকক্ষ তৈরি করে সেখানে আনুপাতিক ভোটের প্রেক্ষিতে রাজনৈতিক দলগুলোর আসন বন্টনের পদ্ধতিটি গণতন্ত্রে অপেক্ষাকৃত সফল দেশগুলোতে কার্যকরিতার প্রমাণ রেখেছে। কিন্তু তাতে অনীহা ফ্যাসিজমের বায়েস্কোপের নেশায় বুঁদ দলগুলোর। ন্যায়পাল নিয়োগের মাধ্যমে রাষ্ট্রের বিভিন্ন স্তম্ভের ক্ষমতার ভারসাম্য রক্ষার যে পরীক্ষিত পদ্ধতি; তাতেও অনাগ্রহ স্বৈরমানসের।
রাজনৈতিক দলগুলোর ঐক্যমত না হলে গণভোটের মাধ্যমে সংবিধান সংস্কারের দৃষ্টান্ত অসংখ্য। ফ্রান্সে ১৯৪৫ ও ১৯৫৮ সালে সাধারণ নির্বাচনের আগে গণভোটের মাধ্যমে নতুন সংবিধানের পক্ষে অভিমত সংগৃহীত হয়েছিল। চিলিতে ১৯৮০ সালে সাধারণ নির্বাচনের আগে অনুরুপ গণভোট অনুষ্ঠিত হয়েছিল নতুন সংবিধান প্রণয়নের লক্ষ্যে। মিশরে ১৯৫৬, ১৯৭১ ও ২০১৪ সালে, তুরস্কে ২০১৭ সালে সংবিধান পরিবর্তনের জন্য গণভোট অনুষ্ঠিত হয়। ফিলিপাইন্সে ১৯৭৩ ও ১৯৮৭ সালে নতুন সংবিধান প্রণয়নের জন্য গণভোট অনুষ্ঠিত হয়। ইতালিতে ১৯৪৬ সালে সংবিধান সংস্কারে গণভোট অনুষ্ঠিত হয় সাধারণ নির্বাচনের আগে। এছাড়া বাংলাদেশে ১৯৭৭ সালে, শ্রীলংকায় ১৯৮২ সালে, ভারতে ১৯৫৭ সালে গোয়ায়, ১৯৮০ সালে নেপালে সাধারণ নির্বাচনে যাবার আগে গণভোট অনুষ্ঠিত হয়।
সাধারণ নির্বাচনের আগে গণভোটের অসংখ্য দৃষ্টান্ত আমাদের পরিচিত বিশ্বে থাকার পরেও; সম্প্রতি এক প্রবীণ আইনবেত্তা বললেন, দুনিয়ার আর কোথাও সাধারণ নির্বাচনের আগে গণভোটের দৃষ্টান্ত নেই। বাংলাদেশ ৫৪ বছর পরে কল্যাণরাষ্ট্র হতে না পারার পেছনে এইরকম পুরোহিতদের বিশেষ ভূমিকা রয়েছে। তারা ৭২-সংবিধানের চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের অধীনে গড়ে ওঠা জমিদার গৃহগুলোতে এই বস্তাপচা বন্দোবস্ত টিকিয়ে রাখার জন্য পণ্ডিত হিসেবে নানারকম জাস্টিফিকেশন জুগিয়ে কাল্পনিক উচ্চবর্ণের শাসন টিকিয়ে রেখেছেন।
বাংলাদেশে জেঁকে বসা ক্ষমতার বাজপাখিরা মুক্তিযুদ্ধে মেহনতি মানুষের রক্ত ত্যাগ, নব্বইয়ের গণ-অভ্যুত্থানে ছাত্রজনতার আত্মত্যাগ কাজে লাগিয়ে দুর্নীতির বসন্তে আঙুল ফুলে কলাগাছ হবার মহাকাব্য লিখেছে। ফলে ২০২৪-এর জুলাই বিপ্লবকেও তারা ছাত্র-জনতার রক্তাক্ত মৃতদেহ'র সিঁড়ি দিয়ে উঠে ক্ষমতার অলিম্পিক মশাল জ্বালার সুযোগ হিসেবে নিয়েছে।
কাজেই যে সংবিধান তাদের চুয়ান্ন বছরের সৌভাগ্যের উচ্চ নম্বরের সিঁড়ি তাকেই নীলক্ষেত ও কচুক্ষেতে ফটোকপি করে কালোটাকা ও পেশীশক্তির মাফিয়াতন্ত্র ধরে রাখতে মরিয়া ক্ষমতার মাস্তানেরা। সাধারণ মানুষের ছেলে মেয়েরা রক্ত দেবে; আর সে রক্তনদীতে ক্ষমতাপংক্ষীতে অভিসার করবে খল ক্ষমতাকাঙক্ষীরা। বেয়াইতন্ত্রের এই পাক্কা বন্দোবস্তে এক বেয়াই জনতার ধাওয়া খেয়ে পালালে আরেক বেয়াই তার ব্যবসা পাহারা দেবে; বিপদের সময়টা ভিজিয়ে রাখবে দুই নয়নের জলে। তারপর পরিস্থিতি অনুকূলে এলে আমরা আর মামুরা মিলে আবার শুরু হবে বাবুকালচারের বুলবুলি আখড়াই।
বেশ কাকতালীয় ব্যাপার হচ্ছে ৭২-এর সংবিধান বাঁচাও প্রকল্পটি চব্বিশের জুলাই-বিপ্লবের পর প্রথম ভারতের গদি মিডিয়ায় পেখম মেলেছিল। এরপর তা বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির আকাশে প্রজাপতি ডানা মেলে উড়তে থাকে। কোথাও তো একটা স্বার্থের অন্তঃমিল বা অন্তঃসম্পর্ক আছেই। তাই তো প্রশ্ন জাগে, প্রজাপতি প্রজাপতি, কোথায় পেলে ভাই, এমন রঙিন পাখা!



পাঠকের মন্তব্য