আমরা নারীরা কি পাবলিক স্পেসে থাকার অধিকার হারাইয়া ফেলতেছি!

১১ পঠিত ... ৫ ঘন্টা ২১ মিনিট আগে

লেখা: ফারিয়া জামান নিকি 

কুষ্টিয়ায় লালনের ধামের সামনে গিয়ে দেখি শত শত মানুষ লালনের মাজারের ভিডিও করার ভঙ্গি করে নারীদের ভিডিও করছেন। ৩-৪ সেকেন্ড করে ক্যামেরা ধরে রাখছেন। একজনকে আমি বললাম, 'আপনি এভাবে মেয়েদের ভিডিও করছেন কেন?'  

সাথে সাথেই বলল ডিলিট করে দিচ্ছি। এটা ডিলিট করানোর মাঝেই আরেকজন আমার নিতম্বে আমাকে গ্রোপ করে। আমি খপ করে তার হাত ধরে ফেলি এবং আঙুল উল্টাইয়া দিতে দিতে তারে কনফ্রন্ট করি। তখনও দেখি আমার এই কনফ্রন্টেশনের ভিডিও করা হচ্ছে। আমি কল্পনায় তখন দেখতে পারলাম ক্যাপশন, 'লালনে কেন চিল্লালেন এই তরুণী'/ 'লালনে শাহবাগীর চিৎকার' ক্যাপশনের একটা রিল ভিডিও হয়ে গেলাম আমি। আমি আর তেমন কিছু বললাম না চলে আসলাম।

এই যে কিছু বললাম না, রিল হয়ে যাওয়া থেকে নিজেকে এভোয়েড করতে। এটা পুরুষরা টের পেয়ে গেছে। বিভিন্নভাবে ভিডিও করে নারীদের যে সোশ্যাল মিডিয়ার আদালতে বসানো যায় এবং প্রায় সবক্ষেত্রেই রায় নারীর বিরুদ্ধে যায়–এটা এখন তারা জানে। আর এটাই তাদের প্রচণ্ড হিংস্র করে তুলেছে। 

আমি এখন শাহবাগে কোনো প্রোগ্রামে যেতে বা স্লোগান দিতে প্রচণ্ড অস্বস্তি ফিল করি। আমার বোধ হয় সাংবাদিকেরা বিশেষত মোবাইল সাংবাদিকেরা সাংবাদিকতা কার্ডের মাধ্যমে আমাকে ও আমার দেহকে অসম্মানিত করার অধিকার পেয়ে গেছেন। তারা খুবই উদ্ভট ক্যাপশন ও অ্যাঙ্গেলে ভিডিও করতে থাকেন যেটার কারণ হচ্ছে 'কাটতি'। আমাকে সাজেস্টিভ ও মিসোজিনিস্ট লেন্সে দেখালে সেই ভিডিওর ভিউ বেশি হয়। সাংবাদিকেরা তাই সাংবাদিক পরিচয়েই নারীদের হেনস্তা করেন। আওয়াজ নিউজ মার্কা শত শত পোর্টাল আছে যেগুলো, 'ব্যাগ থেকে এ কী বের করলেন তাসনিম জারা' টাইপ ভিডিও বানায়। এটাকে তারা সাংবাদিকতা নাম দিয়ে বৈধতার সাথে মিসোজিনি বিক্রি করে।

নারীদের এই রিল হয়ে যাওয়ার যে এপিডেমিক এটার সাথে অবশ্যই ফারজানা সিঁথির 'ভাইরাল শাহবাগী' ভিডিওগুলোর প্রভাব আছে। কীভাবে একই অ্যাক্টের জন্য (আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সাথে চিল্লাচিল্লি) তাকে মিডিয়া জুলাই-এ বানিয়েছিল বাঘিনী আর জুলাই এর পরে বাম/শাহবাগী। সেখান থেকেই বাংলা রিলসে একটা মিসোজিনি ধারার শুরু, সাংবাদিকদের হাত ধরে। এই ফাস্ট ক্লিকের প্রতিযোগিতাময় যুগে সত্যিকারের খবর অর্থবোধকতা হারিয়েছে। গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে ভিউ। এই বাজারে টিকে থাকতে হলে সাংবাদিকতার নামে নারী বিদ্বেষ বিক্রি করতেই হবে।

কুষ্টিয়ায় বাজারে একটা আংকেলের সাথে দেখা। উনি জিজ্ঞেস করছিলেন কতদিন হলো লালনে, লালনভক্ত কিনা আমি ইত্যাদি। এবার নিয়ে আমার ৩য় বার কুষ্টিয়া যাওয়া। কুষ্টিয়ার মানুষ অমায়িক আর মিশুক। এই কথোপকথনটা ঠিক ৫-৭ ফিট দূর থেকে আরেকটা লোক ভিডিও করছিলেন। আর তিনি খুব নরমালি কনফিডেন্সের সাথে ভিডিও করছিলেন। আমি তাকে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, 'আপনি কি আমার ভিডিও করছিলেন?'

উনি সহজ উত্তর দিলেন, হ্যাঁ, আপনার ভালো না লাগলে ডিলিট করে দেব। আমি তখন ওনাকে বললাম, ফোনটা দেন। আমি ভিডিও ডিলিট করতে গিয়ে ডিলিটেড ফাইলসে দেখি শত শত মেয়েদের ভিডিও। ভিডিও করতে উনি কোনো কার্পণ্য করেন নাই। চিকনা মাইয়া, মোটা মাইয়া, লালনভক্ত মাইয়া, হিন্দু মাইয়া, মুসলিম মাইয়া, হন্টনরত মাইয়া, নাগরদোলার ওপরে মাইয়া, বাজার করা মাইয়া–এমন জাস্ট নারীদের এক্সিস্ট করার ভিডিও। সবচেয়ে বেশী ভিডিও মধ্যবয়সী মা-খালাদের, বিশেষত বোরকা পরা নারীদের।

আমি ফেইসবুকে এতদিনে 'মেয়েদের আনরেডি ভিডিও' পেইজগুলো দেখেছি। বুঝলাম এমনই একটা পেইজ হবে হয়তো। যখন আমি ওনার ফোন চেক করছি, প্রচণ্ড ক্রোধে আশেপাশের লোকজনকে দেখাচ্ছি। আমার খুব প্যারা লাগছিল এই ভেবে যে উনি তো সোশ্যাল স্ট্যান্ডার্ডে 'মডেস্ট' মেয়েদের ভিডিও করছেন, সেটাকেও কি তারা অপরাধ ভাবছে না!

মাঝে মাঝে ব্রেইনটা খুব নাইভ হয়ে যায়। মেয়ে মানুষের দোষ মেয়ে মানুষ হওয়াটাই। পোশাকের ঝুলে বা প্রকৃতিতে সেটা বদলায় না৷ ওনাকে জিজ্ঞেস করলাম কেন এইসব ভিডিও বানায়, উনি খুব নরমালি উত্তর দিলেন–'এইগুলা নেটে ছাড়ি'। আমার তখন সব ক্রোধ উবে গেল। উনি পুরা প্রসেসটায় কিছুই লুকানোর চেষ্টাও করলেন না। পুর ঘটনাটার স্বাভাবিকতা আমাকে প্রচণ্ড প্যারা দিল। মনে হলো নিতান্তই গ্রামের লোক যিনি উঠতি ভ্লগার হতে গিয়ে মেয়েদের আনরেডি ভিডিও ভ্লগার হয়ে গেছেন। এনার সাথে রাগ করা পয়েন্টলেস। ওনার মতো শত শত লোক এই এলগরিদমের ঠ্যালায় 'মেয়েদের আনরেডি ভিডিও' বানানো শুরু করছেন। আমি ওনাকে আর কিছুই বলতে পারলাম না।

এরপর আমি যেখানেই গেলাম, আমাকে ভিডিও করা হলো। না জানি কত কত লোক আমার ভিডিও করল, আমি গননা হারায় ফেলছি। রবীন্দ্রনাথের কুঠিবাড়িতেও মাল্টিপল মানুষ আমারসহ মেয়েদের ভিডিও করলেন।

ক্যাম্পাসে এসে আমার বান্ধবীদের যখন এই গল্প করলাম তারা তখন ওয়ানগালা উৎসব থেকে ফেরত এসেছে। তারাও বলল সেই প্রোগ্রামেও শত শত মোবাইল। আর ভিডিওগুলো আচার অনুষ্ঠানগুলো অনেকটা ব্যাঘাত ঘটিয়ে খুবই এক্সটিক প্রাণীর ভিডিও করার মতো করে করা। সেখানে তাদেরও বিভিন্ন ভ্লগার ও সাংবাদিক নূন্যতম কনসেন্ট ছাড়া ভিডিও করেছেন।

আমার জুনিয়ররা কক্সবাজার গেছিল। তাদের থেকেও অভিজ্ঞতা শুনলাম। কাছাকাছি অভিজ্ঞতা। তারা পানিতে নামতে ও গোসল করতে পারছিলেন না ভিডিও হয়ে যাওয়ার আতঙ্কে। 

কয়দিন আগে দুর্গাপূজায় দেখলাম সনাতনী মেয়েরা নাচছে আর সেগুলোর ভিডিও বানাচ্ছেন অনেকেই। একটা-দুইটা ভিডিও ডিলিট করা যায়, এভাবে শত শত ভিডিও ডিলিট করা সম্ভব?

আদিবাসী, হিন্দু, ক্যাম্পাসের শিক্ষার্থী, যেকোনো সাংস্কৃতিক, সামাজিক, ধর্মীয় অনুষ্ঠানের আয়োজকদের অনুরোধ করব আপনারা প্লিজ নো ক্যামেরা জোন হিসেবে আপনাদের অনুষ্ঠানগুলোকে ঘোষণা করেন প্লিজ। আপনাদের সুন্দর অনুষ্ঠানের 'প্রচারের' নামে তারা মেয়েদের ভিডিও করে। প্রত্যকের ফোন চেক করবেন, যদি সাংবাদিকও হয় তবুও ফোন চেক করবেন। যেন তারা বাজে, ইঙ্গিতপূর্ণ ভিডিও না বানাতে পারে। নাইলে আর কোনো পাবলিক প্রোগ্রাম করা সম্ভব না। 

আমি এখন একা পাবলিক বাসে চড়তে ভয় পাই। পাবলিক বাসের যে সামগ্রিক মিসোজিনিস্ট ও নিপীড়নমূলক আচরণ তা নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে। শাহবাগী বলে ক্যাটকল করা নরমালাইজড হয়ে গেছে। যেন একটা সার্টেন সাজ-পোশাক পরলে মৌখিক নিপীড়ন করা জায়েজ–আমরা এখন এই বাস্তবতায় দাঁড়িয়ে আছি। বাসে চড়েছি কিন্তু হয়রানিমূলক আচরণের স্বীকার হতে হয় নাই - এমন শেষ কবে হয়েছে জানি না। যেহেতু রাষ্ট্রীয়ভাবে নারীদের ভিডিও করা, নিপীড়ন করা,'ক্যাটকলিং' করা এক ধরণের নরমালাইজেশন ঘটেছে বাসে। গত ৩-৪ মাস আমি পাবলিক বাসে চড়া সম্পূর্ণভাবে এড়িয়ে চলি। আমার প্রতিনিয়ত বাইকের সামর্থ্য নেই। তাই আমি আর প্রতিনিয়ত বের হই না।

কুষ্টিয়ার অভিজ্ঞতা অন্যান্য নারীদের সাথে শেয়ার করার পর আমার মনে হয়েছে খালি আমি না, বাংলাদেশের প্রায় সকল নারীরাই চরম প্রাইভেসিহীনতায় ভুগছেন। মেয়েদের ভিডিও করা কিংবা ছবি তোলা সামাজিকভাবেই একটি নিপীড়নমূলক কাজ হিসেবে দেখা হতো। গত কিছুদিনে এটার ব্যাপক হারে নরমালাইজেশন ঘটেছে। প্রায় সবার হাতে হাতে ফোন আর সবাই মেয়েদের ভিডিও করছেন।

আমি চাই না একটা কলা খেতে খেতে, প্রেমিকের হাত ধরা অবস্থায়, মিছিল করে প্রচণ্ড ঘামা গায়ে জুম করে কিংবা রাস্তায় হাঁটার কারণে আমার ভিডিও করা হোক। আমি আমার প্রাইভেসি হারাইয়া ফেলতেছি। আমার সবসময় তটস্থ থাকতে হয়, না জানি কখন রিলস হয়ে যাই।

বাংলাদেশের কনসেন্ট ছাড়া নারীদের ভিডিওর বিষয়টা প্রচণ্ড কনসার্নিং হয়ে দাঁড়াইছে। আর এটাই ক্রমবর্ধমান নারী বিদ্বেষের সাথে সম্পর্কযুক্ত। নারীদের শুধুমাত্র এক্সিস্ট করার অপরাধে যৌনবস্তু হিসেবে উপস্থাপন করা হচ্ছে। আর এটার নরমালাইজেশন শত শত ছেলেদের 'মেয়েদের আনরেডি ভিডিও' পেইজের মালিক বানাচ্ছে।

আমার জুনিয়ররা,বান্ধবীরা এই কারণে আর বের হতে চান না। পাবলিক স্পেসে যেতে চান না। এই সার্বক্ষণিক ভিডিও করার প্রবণতা আমাদের এক্সিস্ট করার অধিকার কেড়ে নিচ্ছে।

এই জায়গায় ওই মেয়ের জুতাপেটা করার ভিডিও আমাকে প্রচণ্ড শক্তি দিছে। আমিসহ শত শত মেয়ের একটা অদ্ভুত স্যাটিশফেকশন লাগছে। বিশ্বাস করেন আমাদের প্রতিনিয়তই কাউকে না কাউকে জুতাপেটা করতে ইচ্ছা করে। আমরা পারি না। ভাড়ার কাহিনী হোক আর যাই হোক আমি বা আমরা জানতে চাই না। ঝামেলা যেটা নিয়েই হোক, কেউ কারও পোশাক নিয়ে মন্তব্য করতে পারে না। আমরা যারা নারী, গত অনেকদিন তারা চরম ডিসগ্রেসফুল ও আতঙ্কগ্রস্থ জীবন-যাপন করছি। সেই জায়গা থেকে ওই মেয়ের থাপ্পড় খালি থাপ্পড় হয়ে থাকে নাই। এটা আমাদের সব মেয়েরই একটা আউটব্রাস্ট হচ্ছে। আরও আউটব্রাস্ট হবে। 

নেক্সট টাইম আমার কনসেন্ট ছাড়া ভিডিও করলে বাড়ি মাইরা আমি ফোন ভাঙব। ভাঙার পর জিজ্ঞেস করব, 'আপনি কি আমার ভিডিও করছিলেন?'

বহুত হইছে, আর না।

১১ পঠিত ... ৫ ঘন্টা ২১ মিনিট আগে

আরও eআরকি

পাঠকের মন্তব্য

আইডিয়া

কৌতুক

রম্য

সঙবাদ

স্যাটায়ার


Top