লেখা: সায়েমা খাতুন
শরীর আমার, সিদ্ধান্ত আমার—স্লোগানটি নারী বিষয়ক সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদনে ব্যবহার করা হয়েছে দশম অধ্যায়: সকল বয়েসী নারীর সুস্বাস্থ্য আলোচনার শুরুতে, ১০৫ পৃষ্ঠায়। এখানে এই স্লোগানের ব্যবহারটা কি খুব র্যাডিকাল? নারীরা তো এটাও বলছে না, সন্তান আমার সিদ্ধান্ত আমার—কিম্বা ঘর আমার, সংসার আমার সিদ্ধান্ত আমার—বলছে না, রাষ্ট্র আমার, পার্লামেন্ট আমার, আদালত আমার, প্রশাসন আমার, সিদ্ধান্ত আমার—বলছে না, জমি-জিরাত, খেতখামার, ভূমি, ব্যবসা-বাণিজ্য, কলকারখানা, ব্যাংক-বীমা আমার সিদ্ধান্ত আমার। কোনোকিছুই আমার বলছে না, কোনোকিছুর উপর মালিকানা বা কন্ট্রোল চাইছে না, কেবল তার নিজের দেহের উপর আত্মনিয়ন্ত্রণ ঘোষণা করছে। যাতে করে, তার শরীর-স্বাস্থ্যগত বিষয়গুলো নিয়ে সিদ্ধান্ত সরকারের না হয়, ডাক্তার, বা ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানির না হয়, বহুজাতিক সংস্থার না হয়, মিডিয়ার না হয়, যাতে কোনো ধরনের মেডিকেল ইন্টারভেনশন করা যাবে, সে সবের উপর তার ইনফরমড চয়েসের সুযোগ থাকে। যাতে নারী জানতে পারে তার উপর কী ধরনের চিকিৎসা হবে, কোন ধরনের ঔষধ তারা নেবে, কী নেবে না এবং সেভাবে ঠিক করতে পারে সে কোনটা করবে, কিম্বা বিরত থাকবে—নারী কোন ধরনের মাসিক ব্যবস্থাপনা গ্রহণ করবে, কোন প্রোডাক্ট কীভাবে ব্যবহার করবে, কোন ধরনের জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি গ্রহণ করবে, কোন বয়েসে নারী গর্ভধারণ করবে, কয়টা বাচ্চা নেবে, সিজার করবে না, প্রাকৃতিক প্রসব পদ্ধতিতে যাবে, জীবনরক্ষাকারী অনাকাঙ্ক্ষিত গর্ভপাতের প্রয়োজন দেখা দিলে কীভাবে সেটা করা হবে, লাইগেশন করবে কিনা, করলে কখন করবে, কিম্বা আদৌ সন্তান নেবেন কিনা, সন্তানহীন থাকতে চান কিনা, নারীর শরীর-স্বাস্থ্য সংক্রান্ত যাবতীয় বিষয়ে এখানে নারীর কর্তাসত্ত্বা দাবি করা হয়েছে।
শরীর আমার, সিদ্ধান্ত আমার বললে নারী কি বিবস্ত্র হওয়ার কথা ভাবে? কী অকল্পনীয় যৌন এই কল্পনা শক্তি! নারীর শরীর মানেই যৌন বস্তু, বিবস্ত্র দেহ? What is in a man's head নামে একটা কার্টুন আছে। দেখেছিলাম জার্মানিতে পড়বার সময়; যেখানে দেখা যাচ্ছে, পুরুষের গোটা মাথা জুড়ে বিবস্ত্র নারী। নারীর শরীরের কল্পনা মানেই বিবস্ত্র নারীর দেহ, এই পুরুষালী গেজ, এমনকি একজন উচ্চশিক্ষিত নারী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরও থাকতে পারে। নারী বিষয়ক সকল দুশ্চিন্তা-উদ্বেগ-দুর্ভাবনা কেবল বিবস্ত্র দেহ ঘিরে! অথচ, দেশব্যাপী নারীদের উচ্চহারে ধর্ষণের ঘটনায় যখন নারীর ইচ্ছার বিরুদ্ধে বল প্রয়োগ করে নারীদের বিবস্ত্র করা হয়, তখন এই নারীদের মুখে কি কোনো আওয়াজ শুনেছেন—কেন নারীদের এভাবে বিবস্ত্র হতে হলো?
শরীর আমার সিদ্ধান্ত আমার—এর অর্থ কি এই যে, নারীরা অনিয়ন্ত্রিত যৌন-জীবন ও গর্ভপাত চায়? যার তার সাথে, যেখানে সেখানে ঘুমাতে চায়? কী বীভৎস এই সেক্সুয়াল ফ্যান্টাসি! নারী-পুরুষ কারোই নিজের শরীর নিয়ে যা খুশি তাই করবার অধিকার নাই—যেমন, আত্মহত্যার অধিকার নাই, সেলফ-হার্ম বা আত্ম-নিগ্রহের অধিকার নাই, ড্রাগ নেওয়ার অধিকার নাই। মানব শরীরের মেজর অর্গানগুলো, শারীরবৃত্তিয় সব কার্যক্রমই সম্পূর্ণ ঐশী শক্তির নিয়ন্ত্রণে চলে, যাতে আমাদের কারোই ইচ্ছা-অনিচ্ছার কোনো সুযোগ নাই। কেবল যে বিষয়গুলোতে মানবিক সিদ্ধান্ত, কর্মকাণ্ড নারীর শারীরিক-মানসিক-সামাজিক-আর্থিক ভালোমন্দের সাথে জড়িত, সেইসব বিষয়গুলোতে নারী নিজের নিয়ন্ত্রণ লাভের অধিকারী হবে, এর চেয়ে সাদামাটা দাবি আর কী হতে পারে? এটা র্যাডিকাল হওয়া তো দূর কী বাত, নেহায়েত বেসিক। নারী কেবল তার নিজের দেহসংক্রান্ত বিষয়ে নিজে সিদ্ধান্ত নিতে চায়। অন্য কারও উপর নিয়ন্ত্রণ চাইছে না, এটুকুও কেমন করে বিরাট এক অডাসিটি মনে হচ্ছে?
যুগ যুগ ধরে নারীদের শারীরিক একান্ত ব্যক্তিগত বিষয়কগুলোতেও নারী তার সুবিধা-অসুবিধা প্রকাশ করতে পারে না, তার নিজের সিদ্ধান্তের ক্ষমতা থাকে না, বরং, সরকার, ডাক্তার, মোক্তার, বাবা, স্বামী, বা শ্বশুরবাড়ির কর্তাকর্ত্রীরা নারীকে শিশুতুল্য করে সকল ধরনের সিদ্ধান্ত দিয়ে থাকে, যা আর একদিনও চলতে দেওয়া যাবে না।
পাঠকের মন্তব্য