বাংলাদেশের সাধারণ মানুষকে জিজ্ঞেস করুন, কেমন কেটেছে আপনার গত দশমাস। সে উত্তর দেবে, জীবনে এই প্রথম স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব শব্দদুটো কল্পনা থেকে বাস্তবের জমিনে ধরা দিয়েছে।
পৃথিবীর ইতিহাসে বিপ্লব ও অভ্যুত্থানের পরে যেরকম নৈরাজ্য ও প্রতিশোধমূলক হত্যাযজ্ঞ ঘটতে দেখা যায়; তার কিছুই ঘটেনি বাংলাদেশে।
যেহেতু ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে সাধারণ মানুষ তাদের দাবি দাওয়া উত্থাপন করতে পারেনি দেড় দশক; তাই অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সময় অসংখ্য দাবি দাওয়া নিয়ে বিভিন্ন পেশাগোষ্ঠী রাজপথে নেমেছে।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা দায়িত্ব গ্রহণের পরেই বলেছিলেন, যেহেতু দেড় দশক নির্যাতন সয়েছে দেশের জনগণ; তিনি তাই কোনো ব্যাপারে তাদের ওপরে কঠোর হতে চান না।
সিভিল ও মিলিটারি এডমিনিস্ট্রেশনে হাসিনার দেড় দশক ধরে পুঁতে রেখে যাওয়া বিষবৃক্ষেরা ৫ আগস্ট সাঁঝ থেকে আজ অবধি; ড. ইউনূসকে ব্যর্থ প্রমাণের চেষ্টায় সক্রিয়। কেবল মেধার ভিত্তিতে প্রশাসনিক রদবদল সম্ভব হয়নি বিএনপি ও জামায়াতের বঞ্চিত কর্মকর্তার নামে পদায়ন ও পদোন্নতি চাওয়া লোকেদের কোলাহলে। দেড় দশকে ভারতের ছায়া উপনিবেশে তাদের মনপছন্দ সামরিক ও বেসামরিক প্রশাসনের কর্মকর্তাদের রেখে দেওয়াতে; ইউনূসের নির্দেশাবলী পালনে তারা পলাশীর প্রান্তরে মীরজাফর কিংবা জগতশেঠের মতো নিষ্ক্রিয়তা দেখিয়েছে। যাতে আজকের এই অবস্থায় তারা পৌঁছাতে পারে।
জাতিসংঘের হিসেবে প্রায় ১৪০০ মানুষ হত্যা করে শেখ হাসিনা ও তার খুনি দোসরেরা ৫ আগস্ট সাঁঝ থেকে জাতির বিবেক হিসেবে উপস্থিত হয়েছে। অনুশোচনাহীন এই হীন মানুষেরা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও বাঙালি সংস্কৃতির চুইংগাম চিবিয়ে বার বার ড. ইউনূসের প্রশাসনকে ঠিক ভারতীয় মিডিয়ার মতো করে ইসলামি মৌলবাদি তকমা দিয়ে চলেছে। আপনি কখনও খুনির ভাই-বোনের এত বড় গলা দেখেছেন। ঐ যে হিন্দুত্ববাদী ভারতীয় বয়ান, হাসিনা ক্ষমতায় না থাকলে বাংলাদেশ ইসলামপন্থীদের দখলে চলে যাবে; সেটাই প্রচার করেছে হাসিনার দোসরেরা। ভারত সমর্থিত এই হিন্দুত্ববাদী বয়ান মোকাবেলায় অনেক সময় নষ্ট হয়েছে ইউনূস সরকারের।
হাসিনার পদত্যাগের পর সেনাপ্রধান যখন বললেন, জামায়াত ও অন্যান্য রাজনৈতিক দলের নেতার সঙ্গে বৈঠক হয়েছে; অমনি মাথায় চড়ে গেল সাধারণ নির্বাচনে একটি-দু'টি আসনের দাবিদার জামায়াত। জাসদ থেকে আসা জামায়াতের নেতা প্রতিদিন বাণী চিরন্তনীর চুইংগাম চেবাতে থাকলেন। ভারতে এগারো বছর ধরে হিন্দুত্ববাদীরা ক্ষমতায় থাকার যৌক্তিকতা দিতে ভারতীয় মিডিয়ায় বাংলাদেশে ইসলামপন্থীদের প্রকোপের প্রচারণা করতে হয়। সে সব প্রচারণা শুনে জামায়াতের মাথায় বায়ু চড়ে যায়। এইভাবে ইন্ডিয়া ডমিনো এফেক্টের কৌশল অবলম্বন করে কালচারাল ওয়ারের চুইংগাম এগিয়ে দেয়; তার কর্মচারী আওয়ামীলীগ ও মোদি প্রগতিশীলতার পোস্টার বয়দের। গত দশটি মাস অসংখ্য জরুরি কাজ ফেলে এই জামায়াত বনাম মোদি প্রগতিশীল কালচারাল ওয়ারের নিষ্পত্তিতে সময় নষ্ট হয়েছে ইউনূস সরকারের।
আমাদের প্রত্যাশা ছিল বিএনপি জনপ্রিয় একটি রাজনৈতিক দল হিসেবে দায়িত্ববোধের পরিচয় দেবে। কিন্তু তারাও ভারতের চুইংগাম চিবিয়ে আওয়ামীলীগের প্লে বুক অনুসরণ করে কথাবার্তা বলতে শুরু করে। আর প্রতিদিন পাওনাদারের ভঙ্গিতে বলতে থাকে, কবে নির্বাচন দেবেন? আওয়ামীলীগের দেশ লুণ্ঠকেরা চাঁদাবাজির রাজ্যপাট ফেলে মনিব ভারতের দেশে পালিয়ে যাওয়ায় বিএনপির দেশ লুণ্ঠকেরা সেই চাঁদাবাজির রাজ্যপাটের দখল নিয়েছে দশমাস ধরে। তাদের অল্প সংখ্যক বহিষ্কার হলেও; দেশের প্রান্তিক মানুষ তাদের চাঁদাবাজির অত্যাচারে অত্যাচারিত। বিএনপির তো মনোযোগ দেবার কথা ছিল, জনগণের ভিক্ষা চাই না কুত্তা সামলাও, এই চিরন্তন দাবির দিকে। মনোযোগ দিয়ে চাঁদাবাজি বন্ধের দলীয় সংস্কার করার কথা ছিল। অথচ কবে নির্বাচন, কবে ক্ষমতার চেয়ার, পতাকা ওড়ানো গাড়ি, জমিদারির চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত; এই আত্মকেন্দ্রিক কথাবার্তার বাইরে সামষ্টিক স্বার্থে কোনো উদ্যোগ নেই তাদের সক্রিয়তায়।
৫৪ বছর ধরে জাতীয়তাবাদের চুইংগাম চিবিয়ে রাজনীতিক ও আমলাদের দেশলুণ্ঠনের বিষাদ সিন্ধু আমরা প্রত্যক্ষ করেছি। বৃটিশ ও পাকিস্তানি উপনিবেশের চেয়ে বেশি অর্থ-সম্পদ লুণ্ঠন ও পাচার করেছে স্বদেশী লোকেরা। তাদের সামনে স্পিকটি নট হয়ে থেকে তেলাঞ্জলি দিয়ে যে বুদ্ধিজীবী সমাজকে প্লট-পদ-পদক নিতে দেখলাম; তারা ৫ আগস্ট সন্ধ্যা থেকে মারাত্মক সচেতন নাগরিক সমাজ হয়ে পড়ল। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ছেলে-মেয়েদের ছিদ্রান্বেষণ করে মিডিয়া, ইউটিউব, ফেসবুক কাঁপিয়ে ফেলল তারা। যে ইউটিউবাররা জুলাই বিপ্লবে ঐক্যবদ্ধ ছিল; তারা বিভাজিত হয়ে বিএনপি, জামায়াত ইত্যাদির ভেলায় চড়ল। ইউটিউবিং এর বিনিময়ে বিশেষ সহকারী, প্রেস মিনিস্টার, এটা-ওটা-সেটা হবার রেসে বাদ পড়ে অভিমানী ইউটিউবার ও ফেসবুকার ইউনূসের সরকারের শত্রু হয়ে গেল। অনেকে বিএনপি ক্ষমতায় এলে পদ পদবী হাসিলের খেলায় ইউনূসের ছিদ্রান্বেষণ শুরু করল।
১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের অংগীকার ও ১৯৯০-এর গণঅভ্যুত্থানের শপথ পূরণ না হবার কারণ; মুক্তিযুদ্ধ ও অভ্যুত্থানের সুফল দ্রুত কুড়িয়ে বাড়ি-গাড়ি-ভুড়ি বাগানোর তাল। সাধারণ মানুষের কাতার থেকে বেরিয়ে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের জমিদার হবার স্বপ্ন। জুলাই বিপ্লবের বিপ্লবীদের কাউকে কাউকে আমরা দেখেছি সেই ভুল পথে হাঁটতে। একই ভুল তৃতীয়বারের মতো ঘটলে বুঝতে হবে মিথ অফ সিসিফাসের ট্র্যাজেডি এই বাংলাদেশ। যেখানে সাধারণ মানুষ প্রাণপণে ভারী পাথর পাহাড়ের ওপর তোলে; আর দ্রুত ধনী হতে চাওয়া লোকেরা সে পাথর ওপর থেকে লাথি দিয়ে ফেলে দিয়ে একাই পর্বত শৃঙ্গে পতাকা ওড়াতে চায়। কাজেই অল্পবয়েসী এই বিপ্লবীদের গত দশমাসের ভুল ভ্রান্তি থেকে শিক্ষা নিয়ে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে বাংলাদেশের স্বার্থে। কারণ তারা ছাড়া বাংলাদেশের আর কোনো আশ্রয় নেই। হয় স্বদেশের প্রতি কর্তব্য সতভাবে পালন করে ইতিহাসে অমরতার আয়োজন করা; অথবা ৫৪ বছরের ভুল প্রবীণ নেতা-আমলাদের মতো বিস্মৃতির অতলে হারিয়ে যাওয়া; এর একটাকে বেছে নিতে হবে জুলাই বিপ্লবীদের।
এই যে অনেকেই প্রমাণ করতে চান পাওয়ার করিডোরের কিরামান কাতিবিন হয়ে তারা প্রতিটি সংকট প্রত্যক্ষ করেন; তারপর ফেসবুক কিংবা ইউটিউবে অথবা পত্রিকার কল্প কলামে তুলে ধরেন ক্ষমতা-কাঠামোতে তাদের অবাধ যাতায়াতের গপ্পো; তারা একটা বেসিক জিনিস মিস করে যান; তা হলো, ৫ আগস্ট বাংলাদেশে প্রভাব হারানোর পর প্রায় উন্মাদ দশায় রয়েছে ভারত। সেই পাগলামি তাদের মন্ত্রী-সচিব-সেনা প্রধান- সাবেক রাষ্ট্রদূত-একাডেমিশিয়ান-মিডিয়া রঙ মহলে দশমাস ধরেই চলছে। ৫ আগস্টে অবস্থা বেগতিক দেখে বিশ্বস্ত কর্মচারি হাসিনাকে দিল্লিতে তুলে নিয়ে গেলেও; ফেলে যাওয়া এসেটেরা প্রতিমুহূর্তে সক্রিয় ইউনূস প্রশাসনে অন্তর্দ্বন্দ্ব তৈরিতে। ফলে ভারতের সেনা প্রধানের অনধিকার দাবি, বাংলাদেশে দ্রুত নির্বাচন চাই হুবহু মিলে যায়; বাংলাদেশের অভ্যন্তরে তাদের এসেটদের বক্তব্যের সঙ্গে। পনেরো বছরে পিলখানাসহ বিভিন্ন অপরাধে ভারতের কোনো কোনো মহলের যে সম্পৃক্ততা, তা উন্মোচিত না হবার গ্যারান্টি চায় তারা। নর্থ ইস্টের সেভেন সিস্টারস শাসনে বাংলাদেশকে ডোর ম্যাট বা পাপোষ হিসেবে চাই ভারতের। কোন বানেগা পাপোষ-এর কাস্টিং কাউচ হচ্ছে বাংলাদেশের কোনো কোনো রাজনীতিক ও এস্টাবলিশমেন্টের কারো কারো বক্তব্য। ভৌগলিক অবস্থানের কারণে যৌথ নদীতে বাঁধ দিয়ে বাংলাদেশ মরুকরণ কিংবা বাঁধের স্লুইসগেট খুলে বাংলাদেশ প্লাবিত করার যে সাক্ষাত যমদূত হিসেবে ভারত একটি চিরন্তন অসূয়া; একইভাবে বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বের জন্য ঝুঁকি হিসেবে ভারত রয়ে যায় মিনার্ভার অশনি পেঁচার ডানা উড়িয়ে।
পাঠকের মন্তব্য