অরিত্র আহমেদ
তোফাজ্জল ছিল 'বহিরাগত'। তারে যারা খুন করেছিল, তারা ছিল ঢাবিয়ান। তা-ও একজন দুই জন না। লিটারেলি একটা মব তৈরী হইছিল ওই ঘটনায়। শিক্ষিত ঢাবিয়ান মব। ওই খুন নিয়ে কান্নাকাটি কম হয় নাই বাংলাদেশে। মানুষের ক্ষোভেরও শেষ ছিল না। অনেক র্যান্ডম পোস্ট দেখেছি ফেসবুকে, ঢাবিতে এইরকম খুনীরাও থাকে তাহলে? ফেসবুকে ওই সময় ওই ঘটনার প্রেক্ষিতে ঢাবিকে ডিফেন্ড করা অসম্ভব ছিল। কারণ ঘটনা ঘটাইছিল ঢাবিয়ানরা, দর্শক ছিল ঢাবিয়ানরা, এমনকি ঢাবির মহাশক্তিধর প্রক্টরিয়াল টিমও লাজুক দর্শক হিসেবেই ঘটনাস্থলে হাজির ছিল।
ছাত্রদল-নেতা সাম্য খুন হওয়ার পর এখন তুমুল বহিরাগত-হটাও আন্দোলন হচ্ছে ফেসবুকে। সামনের কয়েক দিন এইরকমই চলবে। ঢাবির অথর্ব প্রশাসন ভয়াবহ জোশ নিয়ে বহিরাগত নিয়ন্ত্রণে নামবে। অতীতের বহু ঘটনার সাক্ষী হিসেবে এইসব আমার বা আমার মতো অনেকের কাছে নতুন কিছু না। আবার, এখন যে অনেকের মধ্যে তীব্র ভিসিপ্রেম ও 'প্রশাসন নির্দোষ' মার্কা অবস্থান দেখা যাচ্ছে, এইটাও নতুন না। এই ভিসিপ্রেমও রাজনীতিমুক্ত কোনো ঘটনা না। হাসিনার ছবি মুছে ফেলা কিংবা তোফাজ্জলের ঘটনার ডিটেইলস জানা থাকা স্বত্তেও যাদের কাছে বর্তমান প্রশাসনকে ইনকমপিটেন্ট মনে হয় না, তারা যে কোনো বিবেচনা থেকে ভিসি ও তার প্রশাসনের প্রেমে গদগদ হয়, তা কেবল তারাই জানে। আমরা খালি অনুমান করি।
ঢাবির অবস্থানই ঢাকা শহরের এমন একটা জায়গায়, যেখানে 'বহিরাগত'-মুক্ত ক্যাম্পাসের ধারণাটাই অচল। এইখানে ঢাকা মেডিকেল আছে। বাংলা একাডেমি আছে। ব্রিটিশ কাউন্সিল আছে। শহীদ মিনার আছে। মাজার আছে। রাজু ভাস্কর্য আছে। গুরুদুয়ারা আছে। টিএসসিতে প্রায় প্রতিদিনই 'নট অনলি ঢাবিয়ান' প্রোগ্রাম হয়। সেইখানে আলেম-ওলামা থেকে শুরু করে মিউজিশিয়ান- সবাই আসেন। সেন্ট্রাল মসজিদে নামাজ পড়তে আসে, এমন অনেক 'বহিরাগত'-ও আছে। বিভিন্ন কাজে হাজার মানুষ এইখানে আসে। অর্থাৎ, সব বহিরাগত ঢাবিতে হাওয়া খাইতে আসে না। সব বহিরাগত ঢাবিতে এসে গাঁজা খায় না। উদ্যানে বহু লোকে গাঁজা খায়, কিন্তু সেইখানেও অনেকেই আসে খালি ঘুরতে। ফ্যামিলি নিয়ে। উদ্যানের ভেতরের খাবারের দোকানগুলোর রমরমা ব্যবসা এই ঘুরতে আসা, অ-গাজাখোর লোকজনের উপরেই নির্ভরশীল। এখন, উদ্যানের মালিক তো ঢাবি না। উদ্যান সরকারি জায়গা। পাশে শাহবাগ থানা থাকা সত্ত্বেও ওইখানে যে লেভেলের মাদক বেচাকেনা হয়, তাতে কোনো পাগলও বিশ্বাস করবে না যে পুলিশের যোগসাজশ ছাড়া এই লেভেলের মাদকব্যবসা সম্ভব। এরপরও যখনই কোনো অ্যাক্সিডেন্ট ঘটে, তখনই পুরো ব্যাপারটা একদম ছিমছাম, সরলরৈখিক বহিরাগত-হটাও আন্দোলনে পরিণত হয়। অ্যাজ ইফ, বহিরাগত মাত্রই পোটেনশিয়াল গাঁজাখোর। বহিরাগত মাত্রই পোটেনশিয়াল খুনী।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কোনো পার্ক না, এইটা সত্যি কথা। এইখানে শুক্র-শনিবারে বিকালের পর টিএসসি এলাকায় যে পরিমাণ ভিড় হয়, তাতে শুধু ঢাবিয়ান না, যে কারোরই বিরক্ত হয়ে যাওয়ার কথা। রাস্তাঘাটে যে পরিমাণ জ্যাম হয়, তাতে কারোরই মাথা ঠিক থাকার কথা না। এখন, এইটার সমাধান কী? গায়ের জোরে ঢাবিকে বহিরাগত-মুক্ত করা? ঢাবি এবং এর আশেপাশের কিছু এলাকা এখনও ঢাকা শহরের মানুষের কাছে একটা ব্রিদিং স্পেস। দরকার না থাকলেও অনেক মানুষ এইখানে আসে ফ্রি টাইম পাস করার জন্য। কেন আসে? কারণ এইখানে মোটামুটি সাধ্যের মধ্যে থেকেই খাবার-দাবার খাওয়া যায়, ঘোরা যায়। ঢাকা শহরে এইরকম আরও কিছু এলাকা থাকলে ঢাবির উপর এত চাপ পড়ত না। আরব্যান প্লানিংটা আরেকটু ভালো হলে এত বেশি জ্যামও হতো না (শুধু ঢাবিতে না, কোথাওই না)। অর্থাৎ, মূল সমস্যাটা আরও বড়। এবং এই সমস্যা জাবি-রবি-চবিতে নেই। সঙ্গত কারণেই নেই। ঢাবির অবস্থানের কারণেই ঢাবির এত সমস্যা। ঢাবির তাৎপর্যও এত বেশি এই অবস্থানের কারণেই।
ফলে, ইন্সেসিটিভ ভাষায় বহিরাগত নিয়ে হম্বিতম্বি করে ভালো কিছু সম্ভব না ঢাবিতে। ফার্স্ট ইয়ারী ইমোশন আর অ্যাকাডেমিক প্রাইডের বাইরে এসে ঢাবির দিকে তাকালে বাস্তবতাটা একটু আলাদা মনে হবে আসলে। বিভিন্ন প্রয়োজনে আসা এবং 'ঢাবিকে পার্ক বানায়ে ফেলা' ঢাকা শহরের মানুষকে শত্রু বানায়ে ফেলে আমি খুব মনোযোগ দিয়ে লেখাপড়া করব (আসলে কিন্তু করে না)- এইরকম আকাঙ্ক্ষা বেশ বিপজ্জনক। একমাত্র গর্বিত ঢাবিয়ান ছাড়া কেউই এই আকাঙ্ক্ষা ভালো চোখে দেখবে না। আমি ব্যক্তিগতভাবে চাইও না যে, ঢাবি কোনো ক্লোজড স্পেস হোক। হওয়া উচিত না। এতে ঢাবির চেয়ে বাংলাদেশেরই বেশি ক্ষতি।
সাম্য-হত্যার যে বর্ণনা সাম্যের সাথে থাকা বন্ধুরা দিয়েছে, তাতে মনে হচ্ছে এইটা প্লানড মার্ডার। র্যান্ডম বাইকের ধাক্কা মার্কা একটা ঝগড়ায় উত্তেজনাবশত কেউ ছুরি মেরে চলে গেছে, এমন না সম্ভবত। যেটাই হোক, এইখানে আগে দরকার খুনীগুলোকে ধরা। তারাই জানে তারা খুন কেন করেছে। সত্যটা বের হোক। সাম্য-র খুনের বিচার হোক।
না হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি যদিও।
পাঠকের মন্তব্য