৭৫ শতাংশ মানুষ সকালের নাশতায় কিংবা দুপুরের খাবারে খরচ কমাতে পাউরুটি, কেক কিংবা বিস্কুটে ক্ষুধা মেটাচ্ছেন।

১৫০ পঠিত ... ১৭:২৯, এপ্রিল ১৫, ২০২৫

33

দুপুরবেলা, একজন ডেলিভারিম্যান আপনার লাঞ্চটা পৌঁছে দিয়ে নিজেও তাঁর লাঞ্চ করতে যাবেন। আপনি যখন প্যাকেট থেকে বার্গার কিংবা বিরিয়ানিটা বের করছেন, তখন হয়তো সেই ডেলিভারিম্যান একটা চায়ের দোকানে ঝুলতে থাকা কেক, রুটি বা বিস্কুটের মধ্য থেকে কিছু একটা খুঁজে নিচ্ছেন। এটিই তাঁর ‘লাঞ্চ’। ইয়ুথ পলিসি নেটওয়ার্কের এক জরিপে দেখা গেছে, শহরের নিম্ন আয়ের মানুষ (বিভিন্ন শ্রমজীবী, এবং শহরের বাইরে থেকে আসা শিক্ষার্থী)দের ৭৫ শতাংশই সকালের নাশতা কিংবা দুপুরের খাবারে খরচ কমাতে পাউরুটি, কেক, বিস্কুট বা এমন কোনো বিকল্প খাবারে ক্ষুধা মেটাচ্ছেন। এবং তাঁদের একটি বড় অংশই দিনে শুধু এক বেলা ঠিক করে খাচ্ছেন। যদিও সেটি সুষম খাবার কি না, সে প্রশ্ন থেকেই যায়। যখন পেট ভরানোটাই চ্যালেঞ্জ, তখন পুষ্টির প্রসঙ্গ থাকুক। এই আধপেটে থাকতেই আবার নিম্ন আয়ের এই মানুষগুলোকে ৭ দশমিক ৫ কিংবা ১৫ শতাংশ ভ্যাটের মাশুল গুনতে হচ্ছে।

বর্তমানে রুটিতে ভ্যাট রয়েছে ১৫ শতাংশ, কেকের ওপর ৭ দশমিক ৫ শতাংশ এবং বিস্কুটে ৭ দশমিক ৫ শতাংশ ভ্যাট প্রযোজ্য আছে। যদিও আগামী ৩০ জুন ২০২৫ পর্যন্ত নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য ক্যাটাগরিতে বিস্কুটের ওপর ভ্যাট অব্যাহতি আছে। যদি নতুন করে সিদ্ধান্ত না নেওয়া হয়, তবে জুলাই থেকে নতুন অর্থবছরে বিস্কুটে আবার এই ভ্যাট বসবে।

আপনি কিংবা আমি হয়তো বিস্কুট আর রুটির ভ্যাট নিয়ে তেমন একটা ভাবি না। এই কয়েক টাকার মাশুল হয়তো আমাদের গায়েই লাগে না। তবে হাড়ভাঙা খাটুনি দেওয়া এই মানুষরা, মাস শেষে যাঁদের উপার্জিত ১০-২০ হাজার টাকায় নিজের খাওয়া-পরা-থাকা মিটিয়ে বাড়িতে রেখে আসা পরিবারের কাছেও টাকা পাঠাতে হয়, তাঁদের জন্য প্রতিদিনের এই কয়েক টাকাও সামান্য নয়। আর টাকা বাঁচাতে সকালের নাশতা এবং দুপুরের খাবারের সঙ্গেই আপস করতে হয় তাঁদের।

ভ্যাট (মূল্য সংযোজন কর) বিষয়টি আসলে কী? সহজ ভাষায়, কোনো পণ্য বা সেবা কেনার সময় ভোক্তা বা ক্রেতা সেটির দামের সঙ্গে অতিরিক্ত যে টাকা দেন, সেটিই ভ্যাট। এটি যেমন পাউরুটি বা বিস্কুটের ক্ষেত্রে, তেমনি হয়তো প্লেন কিংবা সিনেমার টিকিটে, কিংবা রেস্তোরাঁয়—একইভাবে কাজ করে, শুধু ভ্যাটের হারের ভিন্নতা থাকতে পারে। ভ্যাট সব সময় ভোক্তার পকেট থেকেই দিতে হয়, বিক্রেতা বা উৎপাদকের কাজ সেই অতিরিক্ত অর্থ সরকারি কোষাগারে জমা দেওয়া। সেক্ষেত্রেও অনেক ফাঁকিবাজি হয় যদিও, সে আলাপ এখন না।

ভ্যাট কীভাবে কাজ করে? ধরা যাক পাউরুটির কথা। এতে আছে ১৫ শতাংশ ভ্যাট। অর্থাৎ, উৎপাদক যদি সিদ্ধান্ত নেন, ২০ টাকায় পাউরুটি বিক্রি করলে তাঁর লাভ হবে যথেষ্ট, তাহলে দোকানে সেটির দাম লেখা থাকবে ২০+৩=২৩ টাকা। এই অতিরিক্ত ৩ টাকা চলে যাবে সরকারের কাছে। আমরা দোকানে যেসব পণ্য দেখি, তার প্রায় সব কটির খুচরা মূল্যে ভ্যাট যুক্ত করাই থাকে। রেস্তোরাঁয় খেতে গেলে আমরা সরাসরি বুঝতে পারি ভ্যাটের বিষয়টি। দেখা যায়, খাবারের বিল এসেছে ৩০০ টাকা, কিন্তু তার সঙ্গে যোগ হচ্ছে ১৫ শতাংশ হারে আরও ৪৫ টাকা। অর্থাৎ ৩৪৫ টাকা ভোক্তাকেই দিতে হচ্ছে। অবশ্য অনেক সময় ভ্যাট বাড়লেও (এমনকি উৎপাদন খরচ বাড়লেও) সেটির প্রভাব সরাসরি দেখা যায় না। হয়তো আমাদের অজান্তেই রুটির আকার ছোট হয়ে গেল, কিংবা প্যাকেটে বিস্কুটের সংখ্যা কমে গেল কয়েকটি; কিন্তু খুচরা মূল্য একই থেকে গেল। মোট কথা, শেষমেশ ভোক্তাকেই কোনো না কোনোভাবে ভ্যাটের মাশুল গুনতে হয়।

এই ভ্যাট থেকে সরকারের বিপুল পরিমাণ রাজস্ব আসে, যা মোট রাজস্বের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ। আধুনিক বিশ্বে প্রায় সবখানেই ভোগ্যপণ্যে এবং বিভিন্ন সেবার মূল্যের ওপর এই কর থাকে। বাংলাদেশে নব্বইয়ের দশকের শুরুতে ভ্যাট চালু হয়। ১৯৮৮ সালের ভয়ংকর বন্যার পর ক্ষতি সামলে উঠতে আইএমএফের সহায়তা চাওয়া হলে, তারা শর্ত হিসেবে বাংলাদেশে ভ্যাট চালুর প্রস্তাব দেয়। শুরুতে অল্প কিছু পণ্যে ভ্যাট বসানো হলেও ধীরে ধীরে এর পরিধি বিস্তৃত হয়। নিঃসন্দেহে বর্তমান সময়ে ভ্যাট একটি অপরিহার্য বিষয় হয়ে আছে। দেশের সামগ্রিক উন্নয়নে এর বিকল্প নেই। কিন্তু সেটি কি নিম্ন আয়ের শ্রমজীবী মানুষকে আরও বিপদে ফেলে? ১০ বছর আগেই যেখানে ঢাকা শহরে একটা রুটি, একটা কেক আর এক কাপ চা খেয়ে ফেলা যেত ২০-২৫ টাকায়, এখন তাতেই খরচ হয় ৩০-৪০ টাকা। অর্থাৎ খরচ কোনো কোনো ক্ষেত্রে দ্বিগুণ হয়েছে, তার সঙ্গে তো বাকি সব খরচের ঊর্ধ্বগতি আছেই। শ্রমজীবী নিম্ন আয়ের মানুষের আয় কি দ্বিগুণ হয়েছে? হয়নি। তবে কেন তাঁদের খাবারেই আরও ভ্যাট! এসব পণ্য থেকে পুরোপুরি ভ্যাট তুলে নেওয়া উচিত। বরং ভ্যাট বসুক বিলাসী পণ্যে। রাজস্বের জন্য বড়লোকদের কর ফাঁকি নিয়ন্ত্রণে আনা হোক। অর্থ পাচার বন্ধ করা হোক! পাচারকৃত অর্থ ফেরত আনা হোক। এসব করলেই এই রুটি-বিস্কুটের ভ্যাটের দিকে আর তাকাতে হয় না রাজস্ব বিভাগের। তাই আমাদের চাওয়াটা আরও একবার পরিষ্কার করি—নিম্ন আয়ের মানুষদের পেটে লাথি পড়বে, এমন সব পণ্য থেকে ভ্যাট প্রত্যাহার হোক।

 

১৫০ পঠিত ... ১৭:২৯, এপ্রিল ১৫, ২০২৫

আরও eআরকি

পাঠকের মন্তব্য

আইডিয়া

কৌতুক

রম্য

সঙবাদ

স্যাটায়ার


Top