লেখা: উম্মে ফারহানা
ছোটোবেলায় ইদের সাত–আট দিন আগে থেকেই অপেক্ষায় থাকতাম, প্রতি রাতে গুনতাম—আর কয় দিন বাকি। এখনও যে অপেক্ষা করি না, তা নয়। তবে এখনকার অপেক্ষা ইদের দিনের জন্য না, ইদের ছুটির জন্য। বছরে এই একটা ছুটিই অনেক বড় হয়, অনেক দিন কাজে যেতে হয় না।
ইদের দিন নিয়ে আমার তেমন আগ্রহ নেই। তার একটা কারণ, আমি নিজে বড় হয়ে গেছি। আরেকটা বিশেষ কারণ—আমার আব্বা ইন্তেকাল করেছিলেন রমজানের ২৪ তারিখে, ইদের এক সপ্তাহ আগে। সেই থেকে আমার কাছে রোজার ইদ মানে একটা কষ্টের দিন।
১৯৯৯ সালে রোজা এসেছিল জানুয়ারিতে। প্রচণ্ড শীত। আব্বাকে হাসপাতালে নেওয়া হলো শেষ রাতের দিকে, সেহরির ঠিক আগে। রোজা চলছে, ইদ প্রায় এসেই গেছে—তাই কোনো ডাক্তার নেই। ভর্তি করা দরকার ছিল করোনারি ইউনিটে, ভর্তি করা হলো জেনারেল ওয়ার্ডে। ভোরের দিকে ডা. দীলিপ ধরকে পাওয়া গেল, তিনি দেখেই বুঝলেন হার্ট অ্যাটাকটা বাসাতেই হয়ে গেছে। রোগীর জান যাওয়াটা তখন শুধু সময়ের ব্যাপার।
আমরা তখনও জানতাম না আব্বা আর বাঁচবেন না। তাই বাসায় চলে এসেছিলাম—কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে আবার যাব বলে। ঘুমিয়েই গিয়েছিলাম। সকালে নয়টার দিকে ঘুম ভেঙে দোতলার জানালা দিয়ে দেখলাম, আব্বাকে বিছানার চাদরে মুড়ে খাটিয়ায় করে নিয়ে আসা হচ্ছে। টিয়া রঙের একটা প্রিন্টের চাদর—প্রায় সব মধ্যবিত্ত বাড়িতেই তখন এ রকম চাদর থাকত।
১৯৯৯ সাল থেকে আমার জীবনে বহু দিন আর রমজানের ইদ আসেনি। শুধু ২৪ রমজানে কোরআনখানি করাতেন আম্মা। বাকি রোজাগুলো রাখতে না পারলেও ২৪তম রোজাটা রাখতাম আমি। এরপর রোজার ইদ উৎসাহ নিয়ে পালন করা শুরু করেছি ২০১৩ সাল থেকে।
আমার স্বামী কাজী রুবায়েত ইসলাম, যার ডাকনাম তন্ময়, তার ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বাসায় ইদ উৎসব খুব ধুমধাম করে পালিত হয়। সাতসকালে ছেলেরা জায়নামাজ নিয়ে ইদের নামাজ পড়তে যান, মেয়েরা আগের রাত থেকেই রান্নাবাড়ায় ব্যস্ত থাকেন। সবাই সবার বাসায় গিয়ে কোলাকুলি, কদমবুসি করেন। বড়রা পকেটে হাত দিয়ে পা এগিয়ে বলেন, সালাম কর, আর সালাম শেষ হওয়ার আগেই টাকা বের করে এগিয়ে দেন।
আরও মজার ছিল তন্ময়ের নানা, যাকে সব নাতি–নাতনিরা ভাইসোনা বলে ডাকত। ভাইসোনার সালামি দেওয়ার পদ্ধতিও মজার—সবাইকে সমান পরিমাণের নতুন চকচকে নোট দিতেন। দশ টাকা হলে দশ টাকা, বিশ হলে বিশ টাকা। ৫০ বছর বয়সী মেয়ের জামাইকেও ১০ টাকা, ৫ মাস বয়সী নাতির ঘরের পুতিকেও ১০ টাকা।
তন্ময়ের বাড়িতে ইদের বিশেষ আকর্ষণ ছিল আম্মুর হাতে বানানো নেশেস্তার হালুয়া। আমার কাছে সেটা দেখতে যতটা সুন্দর লাগত, খেতে ততটা না। যে পরিমাণ ঝামেলা করে সেটা বানাতে হয়, তার তুলনায় সে হালুয়া অত আহামরি কিছু না। কিন্তু তন্ময়ের খুব প্রিয় ছিল বলে কয়েকবার আমিও সেটা বানানোর চেষ্টা করেছি।
কিছুতেই আম্মুর মতো হচ্ছিল না বলে তন্ময় বলেছিল, আম্মু যদি শুধুমাত্র দুই ইদে এই আইটেম বানিয়ে থাকেন, ৩০ বছরে ৬০ বার বানিয়েছেন। আর তুই দুইবার বানিয়েই সেই লেভেলে উঠতে চাস কেমনে? বিয়ের আগে আমরা বন্ধু ছিলাম, পরস্পরকে তুই বলে বলতাম।
প্রায় প্রতিবারই ইদ করতে যেতাম ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়। শাড়িকাপড় পেতাম, সালামি পেতাম। তবুও খুব শখ ছিল একবার নিজের বাসায় ইদ করব—পোলাও, কোর্মা, জর্দা, সেমাই রেঁধে; বাসার পর্দা–কুশন কভার পাল্টে রীতিমতো উৎসব করব।
করোনার পর একবার এমন হলো যে আমরা ব্রাহ্মণবাড়িয়া না গিয়ে রোজার ইদ ময়মনসিংহেই করলাম, কোরবানির ইদে যাব বলে আম্মু–আব্বুকে রাজি করালাম। কিন্তু সেবারের ইদ তেমন ভালো হলো না।
ময়মনসিংহ শহরে আমার চৌদ্দ গুষ্টি থাকলেও ১৪ জন আত্মীয়ের সঙ্গেও তেমন যোগাযোগ নেই। ইদে পরবে আসা–যাওয়াও তেমন একটা হয় না। ইদের পরদিন কয়েকজন মেহমান এসেছিলেন, ইয়াখনি পোলাও রেঁধেছিলাম, কিন্তু ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ইদের ধারেকাছেও যায়নি সেই আয়োজন।
তন্ময় নিজেও মনমরা হয়ে ছিল, ট্যাঙ্কের পাড়ে বন্ধুদের সঙ্গে ইদের আড্ডা মিস করছিল। নামাজ পড়ে এসে সালামি দেওয়ার রেওয়াজটাও আমাদের এদিকে নেই বললেই চলে, তাই একটা ম্যাড়ম্যাড়ে ইদ হয়ে গেল সেবার।
গত বছর এপ্রিল মাসের ২৯ তারিখে, বয়স ৩৮ হওয়ার ঠিক এক মাস আগে তন্ময় মারা গেল। মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায়—ট্রাকের সঙ্গে ধাক্কা খেয়ে রাস্তায় পড়ে স্পট ডেড। সেটা রোজার ইদের কিছুদিন পরের ঘটনা।
এই বছর রোজার ইদ তন্ময়ের মৃত্যুর পর প্রথম রোজার ইদ। হয়তো আম্মু এবারও নেশেস্তার হালুয়া বানাবেন, অন্য ছেলে–মেয়ে আর নাতি–নাতনিদের জন্য। শুধু তন্ময় সেটা চাখবে না। আম্মু হয়তো তাঁর প্রথম সন্তানের জন্য দোয়া করতে করতে চোখের পানি ফেলবেন, সেই পানি হয়তো হালুয়াতেও মিশে যাবে।
হয়তো এবারও আব্বু, সুস্ময় (তন্ময়ের ছোটো ভাই) আর চাচারা, চাচাতো ভাইয়েরা মিলে কোন মসজিদে নামাজ পড়া ভালো হবে, তা নিয়ে তর্ক করবেন। সকালে হয়তো আব্বু বলবেন, কেন তাকে সেই জায়নামাজটা দেওয়া হলো না—রাগারাগি করবেন। আর হয়তো ভাববেন, তন্ময় থাকলে এক ঝাড়ি মেরে বলত, আব্বু চুপ করো তো, জায়নামাজ নিয়ে এত কথা বলার কী আছে? হয়তো একথা ভেবে আব্বু হাউমাউ করে কাঁদবেন।
আমি দিব্যচোখে দেখতে পাচ্ছি—ভাইয়াকে ছাড়া প্রথম রোজার ইদে কারও হাতে মেহেদি দিতে গিয়ে মৌমিতাও কাঁদছে। দেখতে পাচ্ছি, ট্যাঙ্কের পাড়ের আড্ডায় তন্ময়ের স্কুলের বন্ধুরা সবাই তাকে মিস করছে, ভাবছে—প্রাণশক্তিতে ভরপুর, জীবনকে প্রতি মুহূর্তে উপভোগ করা একজন টগবগে যুবককে কেন এত দ্রুত চলে যেতে হলো? এ কেমন আল্লাহর বিচার?
গত বছর এপ্রিলের ২৮ ও ২৯ তারিখে তাপমাত্রা সর্বোচ্চ থাকবে—তা আগেই ঘোষণা হয়েছিল। ২৮ তারিখ বাস থেকে ক্যাম্পাসের রৌদ্রোজ্জ্বল একটা ছবি তুলে ফেসবুকে লিখেছিলাম, April is the cruellest month। তখনও জানতাম না, ঠিক পরদিনই এপ্রিলের নিষ্ঠুরতা আমাদের জীবনে চিরস্থায়ী হয়ে যাবে।
শুনছি, এবার ইদ হবে এপ্রিলের এক তারিখে। এই রোজার ইদ আমাদের জীবনের সবচেয়ে দুঃখের ইদ। আমার ছেলের জীবনের সবচেয়ে করুণ ইদ—কারণ সেও এখন আমার মতো বাবাহীন হয়ে ইদ করছে।
যে ছেলে আমাকে মৃত্যুর পর ইদের অনীহা কাটিয়ে দিয়েছিল, সে আর নেই। তাই এই রোজার ইদ আমাদের জীবনে আসবে এপ্রিলের সব নিষ্ঠুরতা নিয়ে।
মানুষের জীবন অতি নশ্বর। সবাইকেই আগে বা পরে চলে যেতে হয়। যারা থেকে যান, তারা বহন করেন মৃতদের স্মৃতি। জীবন কারও জন্য থামে না—নিয়ম করে সূর্য ওঠে, ডোবে; আকাশে ইদের চাঁদ ওঠে; রান্নাবান্না থামে না; জীবনের দৌড় থামে না। ইদ উৎসবও প্রতিবছরই আসে।
আমরা যারা প্রিয়জন হারিয়েছি, তারা হয়তো নিয়মরক্ষা করে ইদের আয়োজন করি, মৃতদের জন্য শোক ভুলে গিয়ে জীবিতদের সঙ্গে আনন্দ ভাগ করি। দিনে দিনে এই শোকও সহনীয় হয়ে ওঠে, যেহেতু মৃত্যু অমোঘ।
তবে এবারের ইদ আমার পুত্র ও তার দাদাবাড়ির সবার জন্য নিষ্ঠুরতম পরব হয়েই এসেছে।
পাঠকের মন্তব্য