অপরিষ্কার ও বিশৃঙ্খল দেশপ্রেম

১৫০ পঠিত ... ১৪:০৯, মার্চ ২৭, ২০২৫

8probashe-eid

লেখা: সাদমান ফাকিদ (নিউ ইয়র্ক) 

আমি বইলা বেড়াই যে দেশরে আমি ভালোবাসি না। বিশ্রী ওই দেশের পরতে পরতে দূষণ, পরতে পরতে ধর্ষণ। ঢাকার রাস্তায় বের হওয়া যেন একটা পানিশমেন্ট। নর্দমা, জ্যাম আর ধুলায় গন্ধে মাথা ঝিম ধইরা আসা বাতাস। এইটারে ভালোবাসার কী আছে? আমেরিকায় আইসা দেশের এইসব অপরিপূর্ণতা আরও স্পষ্ট হইয়া ধরা দেয়। রাস্তাঘাট এইখানে চকচক করে; গাড়ি গাড়ির গতিতেই চলে, জ্যামের গতিতে না। বাতাসে মনে হয় যে অক্সিজেন বেশি, বুক ভরে বাতাস নিলে মনটা কেমন শান্তি শান্তি লাগে—আমি নিজেরেই নিজে ধন্যবাদ দেই, নিজেরে এইখানে নিয়া আসছি বইলা।

দিন গড়াইয়া সন্ধ্যা নামে। এইখানের লো একিউআই-এর পরিষ্কার বাতাসে আকাশটারে অনেক বড় মনে হয়। মনে হয় অনেক দূরে দিগন্ত। দিগন্তে লাল নীল বেগুনি মিলাইয়া অনেকরকম রঙ। গোধূলি। ঢাকায় হঠাৎ হঠাৎ সুর্য ডোবার সময় দালান কোঠার ফাঁকফোকর দিয়া গোধূলি দেখা যাইত। তার থেকে সুন্দর গোধূলি এইখানে দেখা যায় প্রতিদিন।

চকচকে দিন ছাইড়া আসে অন্ধকার রাত। এইখানে রাতের নীরবতা অন্যরকম। ইব্রাহীমপুরে রাত ১২টায় নিচে নামলেও দেখতাম রাস্তাঘাটে আলো। অথচ এইখানে মানুষ যেন অন্ধকার ভালোবাসে, অথবা হয়তো তাদের জীবনে রাতের কোলাহলের প্রয়োজন পড়ে না। কিন্তু সারাদিনের ব্যস্ততা শেষ কইরা এই নিখুঁত নীরবতায় হঠাৎ আমার কেমন দম বন্ধ লাগে। মনে হয়, কানের কাছে যদি এখন দুই-একটা রিকশার টুংটাং আওয়াজ আসত খারাপ লাগত না। অজান্তে নিজেরে জিজ্ঞেস কইরা বসি, গলির মোড়ের টংয়ের দোকানটা কি খোলা? তারপর মনে পরে এইখানে গলির মোড়ে অন্ধকার ছাড়া কিছু নাই। চায়ের কাপে চামচের বাড়ি খাওয়ার শব্দ কেমন কানে বাজে, কিছু মানুষের অকারণ হাসি বা তর্কাতর্কি যেন শুনতে পাই দূর থেইকা। নানান রকম ভ্রম হয়, ঘুম পাইতেছে তো! এইখানে মাঝরাতে জানালা দিয়া তাকাইলে অন্ধকার পথঘাট দেখি, আর বুকের ভেতরটায় কেমন জানি ফাঁকা ফাঁকা লাগে। দিনের আলোয় যেই ফাঁকাফাঁকাটারে শান্তি ভাবতেছিলাম, রাতে আইসা ওইটাই কেমন বিষণ্ণতা হইয়া ধরা দেয়।

রাত যত বাড়ে তত তন্দ্রার সাথে যুদ্ধ করি কারণ কাল প্রফেসরের সাথে মিটিং আছে, কাজ করতে হবে। যুদ্ধ করতে করতে ঢুইলা পড়ি ঘুমে, ল্যাপটপটা সামনে নিয়া চোখ বন্ধ কইরা স্বপ্ন দেখতে থাকি। স্বপ্নে কখনও আমেরিকা দেখি না; এমাজনের কনভেনিয়েন্স, স্নো-তে ডুইবা যাওয়া উইন্টার ওয়ান্ডারল্যান্ড, ফল কালার্স বা চেরি ব্লসমস আমার স্বপ্নে আসে না। স্বপ্নে আসে সবুজ সবুজ সিএনজি, লাল নীল রিকশা, আজানের শব্দ। চইলা যাই পলাশীর মোড়ে, বা আউলার ক্যান্টিনে। হুট করে ফোনের কোনো নোটিফিকেশনে ঘুম ভাইঙ্গা যায়, আমি জাইগা উঠি; কিন্তু সেই আমি কি আমি কিনা তা ঠিক ঠাহর করতে পারি না। ওই যে কাঁচাবাজারের মাছওয়ালার হাঁকডাক, বৃষ্টিতে কাকভেজা হইয়া কাদা পাড়াইয়া বাসায় ফেরা—এইগুলার মধ্যে মনে হয় যেন নিজেরে ফালাইয়া আসছি। ওই নোংরা, কোলাহলে ভরা দেশের মধ্যে যেই আমিত্ব ছিল তারে খুঁইজা বেড়াই। আমেরিকায় আইসা পাওয়া শান্তি, পরিচ্ছন্নতা, নিয়মে কেন জানি সে নাই।

বোনটার মুখটা কতদিন সামনাসামনি দেখি না। ভিডিও কলে কথা হইলে ঝকঝকে স্ক্রিনে হাইস্পিড ইন্টারনেটে ওর মুখটা ভাইসা ওঠে। কিন্তু ওই ছোঁয়াটুকু তো পাই না। ওর কণ্ঠটারে সামনাসামনি শোনার আকুলতা কমে না। বইলা বেড়াই আমার দেশপ্রেম নাই। কিন্তু এই যে না পাওয়াগুলা, এই যে শূন্যতা, এইটাই কি দেশপ্রেম? হয়তো। হয়তো এই অপরিষ্কার, বিশৃঙ্খল দেশটারেই আমি অপরিষ্কার আর বিশৃঙ্খলভাবেই ভালোবাসি। এই ভালোবাসা হয়তো মুখে স্বীকার করার মতো সুন্দর না, কিন্তু বুকের ভেতরটায় ভীষণ সত্যি। এইখানে সুন্দর গোধূলি দেখতে দেখতেও মনটা ঢাকার ওই দালানকোঠার ফাঁকের গোধূলির জন্যই পোড়ে। এই নিখুঁত রাতের নিস্তব্ধতায় আমি কান পাইতা থাকি ঢাকার সেই হাজারও শব্দের জন্য। ভালো না বাইসাও দেশটার জন্য আমার চোখটা কেমন ভিজা হইয়া আসে।

১৫০ পঠিত ... ১৪:০৯, মার্চ ২৭, ২০২৫

আরও eআরকি

পাঠকের মন্তব্য

আইডিয়া

কৌতুক

রম্য

সঙবাদ

স্যাটায়ার


Top