লেখা: রাজিব হোসাইন
বাংলাদেশে বহু বছর আগে, ৮০ দশকে জাতীয় শোক দিবস বলে কোনো ব্যাপার ছিল না। সকলে ইতিহাসের পাতা থেকে জানত, ১৫ আগস্ট ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব এবং তার পরিবারের অনেক সদস্যকে কীভাবে নির্মম হত্যা করা হয়েছে। ১৫ আগস্ট এলে দুঃখ ভারাক্রান্ত মনে স্মরণ করত, কিন্তু শোক দিবস নামে কিছু ছিল না। এর কারণ তখন এরশাদ সাহেব ক্ষমতায়।
আমার আব্বাকে নিয়ে শৈশবের যে সমস্ত স্মৃতি আমার রয়েছে, এর মাঝে বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুতে তার গভীর শোকের কথাটিও আছে। আব্বা ধানমন্ডি ৩২ থেকে প্রকাশিত জয় বাংলা সাংস্কৃতিক সংঘ বা এরকম নামের একটি ব্যানার থেকে প্রকাশিত ক্যাসেট নিয়ে মফস্বলের বাসায় এসেছিলেন। ক্যাসেট প্লেয়ারে বাজালে এখানে অনেক গান বাজত। এর মাঝে ছিল স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের গান, সাত মার্চের ভাষণ। একটি গানের শুরুতে নারী কণ্ঠে আবৃত্তি করত, কাঁদো বাঙালি কাঁদো, তোমাদের পিতার জন্য কাঁদো!
এই স্থানে আমি আব্বাকে প্রশ্ন করতাম, এই কাঁদার কারণ এবং ইতিহাস কি। আব্বা খুব সংক্ষেপে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন। জ্ঞান হবার পর থেকে তাই বঙ্গবন্ধুকে শ্রদ্ধা করা, তার লিগ্যাসি নিয়ে ভাবা, ১৫ আগস্টে মৌনতায় তাকে স্মরণ করা; এগুলো আমি করেছি। তখনকার অনেক মানুষকেই তা করতে দেখেছি।
এরপর ৯৬ সালে ক্ষমতায় আসার পর হাসিনা ১৫ আগস্ট জাতীয় শোক দিবস ঘোষণা করলেন। শুরু হলো, রাষ্ট্রীয় ভাবে শোক পালনের চর্চা। হাসিনার প্রথম এবং দ্বিতীয় মেয়াদে শোক পালনে একটা ভদ্রতা ছিল। অর্থাৎ আসলেই মানুষ জানত, এই শোক পালনের উদ্দেশ্য; বঙ্গবন্ধু এবং তার পরিবারের খুন হওয়া সদস্যদের প্রতি সম্মান জানানো! পৃথিবীর অন্য কোনো দেশে একটি নির্দিষ্ট পরিবারের হত্যাকাণ্ডের কারণে প্রতি বছর জাতীয় শোক দিবস পালনের নজির প্রায় নেই হলেও, বাংলাদেশের মানুষ তার ফাউন্ডিং ফাদারের বিষয়ে এই চর্চা পালন করতে দ্বিধা বোধ করে নাই। তবে আসল ঝামেলা লাগল ২০০৮ সালে নির্বাচনের পর হাসিনা সরকার গঠনের সময় থেকে।
এবারে হাসিনা অনেক বেশি আত্মবিশ্বাসী। তাকে আমরা মহব্বত করে দেশের প্রধানের দায়িত্ব দিয়েছি। তার প্রতি সকলের সহানুভূতি এবং মায়া আছে। যত দিন যেতে লাগে, ততই হাসিনার আসল চেহারা বের হতে থাকে। নিজের ভাড়া করা বিচারপতি দিয়ে নির্বাচন কালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি বাতিল দিয়ে শুরু। ড. ইউনূসের নামে মামলা, গ্রামীণ ব্যাংক থেকে অপসারন, বিরোধী দলীয় নেতাকে তার বাড়ি থেকে উচ্ছেদ, আরও অনেক কিছু। কিন্তু আসল আঘাত পেলাম পিলখানা হত্যাকাণ্ডের ঘটনায়। দেখলাম, তিনি কীভাবে গোটা ঘটনাকে ভারতের চোখে দেখে বিবেচনা করলেন, কীভাবে বিচারের নামে প্রহসন করলেন, কীভাবে পরিবারের সদস্যদের গনভবনে এনে সান্ত্বনা দেওয়ার দৃশ্য ভিডিও করে প্রচার করলেন (জুলাই ২৪ গনঅভ্যুত্থানে তিনি একই নাটক করেছেন), কীভাবে পদে পদে পিলখানা হত্যাকাণ্ডের বিচার শুরু থেকেই ভিন্ন পথে পরিচালনা করলেন। এবং তার উপরে যে বিশ্বাস, যে মহব্বত, যে সহানুভূতি, তা উবে যেতে লাগে। এবং তখনও তিনি প্রতিটি পরিবারকে সেইম ডায়ালগ দিতেন, স্বজন হারানোর বেদনা আমি বুঝি। এবং তখনও তিনি ঘটা করে ১৫ আগস্ট জাতীয় শোক দিবস পালন করিয়ে ছাড়তেন।
গত ১৬ বছরে জাতীয় শোক দিবস পালনের নামে অসভ্যতা কেবল বেড়েই গেছে। এই দিবস পালনের নামে আওয়ামী লীগের নেতাদের মাঝে শো ডাউন হতো। কে কার চেয়ে বেশি শোক প্রকাশ করতে পারে। শোক প্রকাশের বিষয়টি যে প্রায় ব্যক্তিগত, মৌন, মানুষ তা ভুলেই গিয়েছিল। এই দিনে বাংলাদেশের মানুষের সন্তান জন্ম নিলে, তারা সেটা প্রকাশ করতেও দ্বিধা করত। কারণ সামাজিক পরিস্থিতি।
লীগের ছ্যাঁচড়া নেতারা আজান দিয়ে চাঁদাবাজি করেছে। ১৫ আগস্ট উদযাপন উপলক্ষে আশেপাশের তাবৎ ব্যবসায়ীদের কাছে থেকে কোটি টাকার চাঁদা তুলেছে। কেউ দিতে অপারগতা প্রকাশ করলে তাকে প্রশাসন দিয়ে হেনস্তা করিয়েছে। চাঁদার টাকায় ১৫ আগস্টে সারা দেশে লক্ষ গরু জবেহ করে, ডেক ভরে খিচুড়ি বিরিয়ানি রান্না। দরিদ্রদের খাওয়ানোর নামে মহা উৎসব, চাঁদার টাকা নিয়ে ভাগ বাটোয়ারা। আপনারা যদি ঢাকার বাইরে তৃনমূলের দিকে যান, শোক দিবসের নামে কি হতো দেখতে পারতেন। মনে হতো, কে কার চেয়ে বড় নেতা, প্রমানের চেষ্টা। সংঘর্ষ অহরহ। এগুলো দেখে কষ্ট পেতাম। আমি একবার একটা শোক দিবসের অনুষ্ঠানে দেওয়া বক্তৃতা শুনে স্তব্ধ হয়েছিলাম। এরা শোকের আলোচনাকে সম্পূর্ণ অপ্রাসঙ্গিক রাজনৈতিক আলাপে পর্যবসিত করত। বঙ্গবন্ধু এবং পরিবারের জন্য তাদের আত্মা কতটুকু ব্যথিত ছিল তা আমার জানা নেই, তবে তাদের কাণ্ড দেখে দেশের যাবতীয় বিবেকবান মানুষ যে ব্যথিত ছিল, তাতে সন্দেহ নেই। এই মচ্ছব বছরের পর বছর বেড়েই গেছে। শেখ হাসিনা বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর এই দিনকে জাতির কাছে থেকে ছিনিয়ে নিয়ে আওয়ামী লীগের দিবস করে ফেলেছিলেন। এবং তিনি একান্তই রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে এই দিনটি ব্যবহার করা শুরু করেন। এই দিনে তিনি বিরোধী রাজনৈতিক দলের পূর্বসূরিদের জড়িয়ে নিত্য নতুন মিথ্যাচার করেন।
২৪ এর জুলাইতে শেখ হাসিনা নিজে নির্দেশ দিয়ে গনহত্যা চালান। তিনি ৪ বছরের শিশু থেকে শুরু করে ভার্সিটির ছাত্র, পথের পাশে মুদির দোকানদার কাউকে বাদ দেন নাই। আপনাদের জানার কথা, ৫ আগস্ট পদত্যাগ করার পূর্বেও তিনি তার অনুগত আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারি বাহিনীদেরকে আরও খুন করতে নির্দেশ দিচ্ছিলেন। তিনি এক পর্যায়ে ভারতের কাছে মিলিটারি সাহায্য চেয়েছিলেন- ছাত্র জনতাকে দমন করার জন্য। এই সব কিছু আমাদের টাটকা স্মৃতি। এখনও মাত্র দুই সপ্তাহ পাড় হয় নাই।
আমরা দেখেছি, শেখ হাসিনার কাছে ছাত্রদের জীবনের কোনো দাম নাই। আমরা দেখেছি তার পেটোয়া আধুনিক রক্ষীবাহিনী কীভাবে ছাত্রদের খুন করেছে, তখনও তিনি মেট্রোরেল স্টেশনের জন্য বেশি শোক সন্তপ্ত ছিলেন, আমাদের বাচ্চাদের জানের জন্য না। এবং তখনও তিনি কপাল কুঁচকে বলেছেন, স্বজন হারানোর বেদনা আমি বুঝি।
এই সবকিছু মিলিয়ে আসলে শেখ হাসিনার দ্বিচারিতা, মিথ্যাচার, ভণ্ডামির চিত্র আমাদের সকলের সামনে উন্মোচিত হয়েছে। তার ভেতরে দেশের মানুষের প্রতি তিল পরিমাণ দরদ না থাকা, ভারতের গোলামির মাত্রা এবং ক্ষমতায় থাকার জন্য যে কোনো অবলম্বন গ্রহণের ইচ্ছা প্রকাশ পেয়ে যায়। এর ফলে, যে বঙ্গবন্ধু আমাদের জাতীয় অনুভূতি, যার মৃত্যু আমাদের জাতীয় ক্ষয়, যার প্রস্থান আমাদের প্রকৃত শোক, সেই বঙ্গবন্ধুও হেয় হন। এই প্রজন্ম তো আমাদের মতো এত আগে থেকেই রাজনীতির উত্থান পতন দেখে নাই। তারা ৯০ এর গণ আন্দোলন কিংবা এর পরে গণতান্ত্রিক উত্তরণের পথে বাংলাদেশের অভিজাত্রা সম্পর্কে এত বেশি জানেন না। দেখেন নাই। তাদের চোখের সামনে ২০২৪। তাদের চোখের সামনে গত ১৬ বছরে হাসিনার রাক্ষুসি হয়ে ওঠা। তাই তারা হাসিনার সমস্ত ন্যারেটিভ প্রত্যাখ্যান করেছে। সেই সাথে জাতীয় শোক দিবসকেও ধিক্কার দিয়েছে।
হাসিনা আমাদের জাতীয় সম্পদ বঙ্গবন্ধুকে একান্তই দলীয় স্বার্থে ব্যবহার করে, বঙ্গবন্ধুকে জাতির পিতা থেকে সরিয়ে ফ্যাসিজমের প্রতীকে পরিণত করেছিলেন। রাস্তায় রাস্তায় মূর্তি বানানোর অনেক আগে বঙ্গবন্ধু আমাদের অন্তরে ছিলেন। হাসিনা সেটা নষ্ট করেছেন। আজ মুক্ত দেশে বঙ্গবন্ধুর মূর্তি ভাঙ্গা, তার তাবৎ স্মৃতিকে অবমাননা করা, এই সবকিছুর জন্য কেবলই হাসিনা দায়ী। অন্য কেউ না। হাসিনা আমাদেরকে বঞ্চিত করলেন।
জাতীয় শোক দিবসের ছুটি বাতিল করা হয়েছে। শোক দিবস পালন হবে কিনা জানি না। কারণ এই দিন সামনে রেখে হাসিনা দেশের ভিতরে গণ্ডগোল পাকানোর জন্য, ভারতের গোয়েন্দা সংস্থার সাহায্য নিয়ে ক্রমাগত ষড়যন্ত্র চালিয়ে যাচ্ছেন। এমতাবস্থায় আগামীকাল দেশে শোক পালনের মাত্রা কী হবে কে জানে! তবে আমরা যারা বঙ্গবন্ধুকে জাতীয় সম্পদ জেনে বড় হয়েছি, তারা এক মুহূর্তের জন্য হলেও মৌনতা পালন করব। বঙ্গবন্ধু ও তার খুন হওয়া পরিবারের প্রতি শোক প্রকাশ করব। একান্তেই করব। কোনো চাঁদাবাজি করব না, শো ডাউন করব না, গরু কাটার প্রতিযোগিতা করব না, মাইকে ৭ মার্চের ভাষণ বাজিয়ে অত্যাচার করব না। তবে শোক পালন করব।
আজকে বঙ্গবন্ধুর যতখানি অবমাননা, তার জন্য কেবলমাত্র তার কন্যা শেখ হাসিনা ও তার দল আওয়ামী লীগ দায়ী। আর কেউ না।
পাঠকের মন্তব্য
ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে
লগইন