আমার স্ত্রীর বান্ধবীরা যে রাতে আমাদের বাসায় আড্ডা মারতে এলো

১০০৯৫ পঠিত ... ০৪:৪৮, ফেব্রুয়ারি ১৬, ২০১৮

আমার স্ত্রী ফারহানা আলমের ব্যস্ততার সীমা নেই। অনেক বছর পরে তার স্কুল আর কলেজের ঘনিষ্ঠ বান্ধবীরা তার বাড়িতে একত্রিত হতে যাচ্ছে। দুই-একজন বাদে তারা সবাই রাত্রে আমাদের বাড়িতে থাকবে। সন্ধ্যা থেকে ভোর পর্যন্ত অশেষ আড্ডা হবে। 

তাদের এই আড্ডার উপলক্ষ্য হচ্ছে--বান্ধবীদের মধ্যে দুইজন অনেক বছর ধরে ক্যানাডার অধিবাসী। ঘটনাক্রমে দুইজনই অল্প দিনের জন্যে একই সময়ে দেশে বেড়াতে এসেছে। একজনের ভাইয়ের বিয়ে। আরেকজনের কী উপলক্ষ্য, জানি না। 

কলেজ জীবন শেষ হওয়ার পরে যেহেতু তারা বন্ধুরা কোনোদিন আর একসঙ্গে হওয়ার সুযোগ পায়নি, ক্যানাডা-প্রবাসী দুইজনের দেশে আগমন উপলক্ষ্যে অন্য বন্ধুরা তাদের মহাব্যস্ততা আর জরুরি কাজকর্মের মধ্যেও নানা ঝামেলা করে একত্রিত হওয়ার জন্যে সময় বের করেছে।

কারও হয়তো অফিসের কাজে ঢাকার বাইরে যাওয়ার কথা ছিল, আগের দিন তাকে অসুস্থ হয়ে পড়তে হয়েছে, যাতে ঢাকার বাইরে যেতে না হয়। কারও হয়তো বাচ্চার অসুখ, তাকেও অনেক কষ্টে বাচ্চার দেখাশোনার দায়িত্ব কয়েক ঘণ্টার জন্যে হাজব্যান্ডের হাতে সঁপে দিতে হয়েছে পুনর্মিলনীর জন্যে সময় বের করতে। কারও হয়তো একই সময়ে অনেকগুলি দাওয়াত পড়ে গিয়েছিল, তাকে তখন বাকি দাওয়াতগুলো ক্যানসেল করে দিতে হয়েছে এই রিইউনিয়নের জন্যে সময় আলাদা করে রাখতে। কারও হয়তো বিদেশে বেড়াতে যাওয়ার কথা ছিল, তাকেও হয়তো বিস্তর জটিলতা ভোগ করে প্লেনের টিকেট এবং হোটেলের বুকিং পিছিয়ে দিতে হয়েছে। 

ফারহানা আলম আমাকে দুই সপ্তাহ আগেই জানিয়ে রেখেছিল, আমাকে অতি অবশ্যই এইদিন ফ্রি থাকতে হবে। আমি যেন বোকার মতো হাতে কোনো কাজকর্ম না নিয়ে ফেলি। 

আমি বলতে যাচ্ছিলাম, আড্ডা দিবা তোমরা। আমি ফ্রি থেকে কী করব। কিন্তু শেষ মুহূর্তে বুদ্ধি করে চেপে গেলাম। 

তারা আড্ডা দেবে সত্যি, সেখানে আমার হয়তো সেই অর্থে কোনো ভূমিকা নেই, কিন্তু তাদের নিশ্চয়ই ফুট-ফরমাশ খেটে দেওয়ার জন্যে একজন পুরুষ মানুষ দরকার হবে। তা ছাড়া চারিদিকে কত রকম খুন-ধর্ষণ, চুরি-ডাকাতি, ছিনতাইয়ের গল্প শুনি--এতগুলি নারীর নিরাপত্তা বিধানের জন্যেও তো আমার মতো দায়িত্ববান কারও কাছেপিঠে থাকা দরকার, যাতে কোনো বিপদ-আপদ-আর্তনাদ হলে হুংকার দিয়ে দুষ্কৃতকারীর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়তে পারি। 

তার ওপর সরকার তো আগেই ঘোষণা দিয়ে রেখেছে, তারা কোনো মানুষের বেডরুমে গিয়ে নিরাপত্তা দিতে পারবে না। 

কাজেই আমি তাড়াতাড়ি মাথা নেড়ে রাজি হয়ে গেলাম, যথাসময়ে সুন্দর পোশাক আশাক পরে বাসায় উপস্থিত থাকব। 

মহান আড্ডা ও পুনর্মিলনীর দিন ঘনিয়ে আসতে আসতে ফারহানা আলম যথেষ্ট তৎপরতার সঙ্গে প্রস্তুতিপর্বের কঠিন অংশগুলো আগেভাগে শেষ করে রাখল। কাজের মানুষের পেছনে লেগে থেকে পুরো বাসা ঝকঝকে-তকতকে বানিয়ে ফেলা হলো। আমি আমার কাপড়-চোপড়, বইপুস্তক আর জরুরি কাগজপত্র আমি বাসার বিভিন্ন কক্ষে নানা রকম চিপাচুপায় হারিয়ে ফেলতাম, সেগুলো খুঁজে বের করে যথাস্থানে সমাহিত করা হলো। 

ফারহানা আলমের বন্ধুদের বেশিরভাগই আগে থেকেই নিজেরা আলাপ-আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নিয়ে রেখেছিল, কে কী রান্না করে নিয়ে আসবে। কেউ হাঁসের মাংস, কেউ ঝাল মুরগির মাংস, কেউ গরুর মাংসের কালা ভুনা, কেউ পায়েস, কেউ রসগোল্লা, কেউ আইসক্রিম। তারপরেও ফারহানা আলম দরকারি আরও খুঁটিনাটি জিনিস আগেই বাজারসদাই করে রাখল। আমার কাছে জানতে চাওয়া হলো, ‘তুমি কী ধরনের সাহায্য করতে পারবা?’ 

আমি মাথা চুলকে একটু চিন্তা-ভাবনা করে বললাম, ‘আমি আর কী সাহায্য করব। আমি পাশে দাঁড়িয়ে উৎসাহ যোগাতে পারি।’ 

ফারহানা আলম বলল, ‘হ্যাঁ। এর বেশি কিছু করার দরকার নাই। কিছু করতে দিলে দেখা যাবে, একটা না একটা গোলমাল পাকিয়ে বসে আছো।’ 

সুতরাং আমি দ্রুত মাথা নেড়ে তাকে আশ্বাস দিলাম, আমি খুব সাবধানে থাকব। আমার দ্বারা কোনোমতেই কোনো গোলমাল হবে না। 

তারপরও আড্ডা শুরু হওয়ার কয়েক ঘণ্টা আগে কীভাবে-কীভাবে জানি ছোটখাটো একটা গোলমাল ঠিকই হয়ে গেল। 

বাজার-সদাইয়ের মধ্যে একটা-দুইটা জিনিস কোনো কারণে বাদ পড়ে গিয়েছিল। শেষ মুহূর্তে ফারহানা আলম আমাকে সেগুলোর তালিকা দিয়ে বলল, আমি যেন ড্রাইভারকে দিয়ে আনিয়ে নেই। উদাহরণ-- 

১. মশার কয়েল ২. কিছু কোক আর স্প্রাইট ৩. প্যারাসিটামল/নাপা 

আমি সঙ্গে সঙ্গে ড্রাইভারকে এক হাজার টাকার একটা নোট দিয়ে বললাম, ‘দুইটা মশার কয়েল আর দুই পাতা নাপা কিনবা। বাকি টাকা দিয়ে কোক আর স্প্রাইট কিনে বাসায় দিয়ে আসো।’ 

আধঘণ্টা পরে ফারহানা আলমের ফোন। আমি অন্য প্রান্তে তার ঝংকার শুনতে পেলাম, ‘তুমি ড্রাইভারকে ১৩ লিটার কোক আনতে দিস?’ 

আমি আমতা আমতা করে বললাম, ‘না মানে, ১৩ লিটার তো আনতে বলি নাই।’ 

ফারহানা আলম কঠিন গলায় বলল, ‘তুমি কি ড্রাইভারকে বলস যে মশার কয়েল আর প্যারাসিটামল কেনার পরে যে টাকা বাকি থাকবে, তা দিয়ে কোক কিনে নিয়ে আসতে?’ 

আমি মাথা চুলকে বললাম, ‘ইয়ে মানে... হ্যাঁ। ... অনেক কোক হয়ে গিয়েছে, না? ... বাই দ্য ওয়ে, কোক কোম্পানি কি রিসেন্টলি দাম কমিয়ে দিয়েছে?’ 

‘সব মিলিয়ে মানুষ হইল ১২ জন। আর তুমি কোক আনাইস ১৩ লিটার। সবাই কি ১ লিটার করে কোক খাবে নাকি এই ঠান্ডার দিনে? ...আসো তুমি বাসায়। সব তুমি একা খাবা।’ 

ফারহানা আলম ফোন রেখে দিল। 

কোক-পেপসি-ফান্টা আমার অত্যন্ত প্রিয় পানীয়। ফলে সব কোক আমাকে একাই খেয়ে শেষ করতে হবে শুনে বিশেষ খারাপ লাগল না। আগামী কয়েক দিন পানির বদলে কোক-স্প্রাইট খেয়ে কাটিয়ে দেওয়া যাবে, কোনো সমস্যা নাই। 

বাসায় এতজন গেস্ট আসবে বলে আমি অফিস থেকে আগেভাগে বের হয়ে সন্ধ্যার মধ্যেই বাসায় ফিরে দেখি, কয়েকজন আগেই চলে এসেছে। 

বান্ধবীর হাজব্যান্ড হওয়ার কারণে এমনিতে অন্য সময় আমি বেশ খাতির-যত্ন, গুরুত্ব আর প্রতিপত্তি পেয়ে থাকি। আড্ডার কারণে আমার দিকে কেউ তাকিয়েও দেখল না। কয়েকজন অবশ্য হাত নেড়ে ‘হ্যালো ভাইয়া’, ‘হাই ভাইয়া’ বলে শুকনা হাসি দিয়ে আবার নিজেদের মধ্যে আলাপ আলোচনায় ব্যস্ত হয়ে গেল। 

আমিও ভদ্রতা করে এক কোনে চেয়ার টান দিয়ে বসে গেলাম। 

অনেক দিন পরে সবার মধ্যে দেখা-সাক্ষাৎ হওয়ায় নিশ্চয়ই কঠিন গল্পগুজব হচ্ছে। আমি একটু কান খাড়া বোঝার চেষ্টা করলাম--কী নিয়ে কথাবার্তা হচ্ছে এবং কে বা কারা মূল বক্তা। কিছুক্ষণ পরেই আশ্চর্য হয়ে খেয়াল করে দেখি, আসলে নির্দিষ্ট কোনো বিষয়ে আড্ডা হচ্ছে না। প্রত্যেকেই একসঙ্গে নানা বিষয়ে কথা বলছে। বিষয়বস্তু বা বক্তা বা শ্রোতা কোনোটাই নির্দিষ্ট নয়। জট পাকিয়ে যাওয়া কথাবার্তার মধ্যে থেকে ছাড়া ছাড়া কিছু লাইন কানে এলো, কিন্তু মাথামুন্ডু কিছু বোঝা গেল না। 

একজন হয়তো বলছে, ‘জানিস! অনেক পর অমুকের সঙ্গে দেখা। সে তো আগে কমপ্লিট ক্ষ্যাত ছিল। না পারত ঠিকমতো কথা বলতে, কী যে ড্রেস পরত, এমন ব্যাক-ডেটেড। লাস্ট দুই বছরে সে একদম চেইঞ্জড। আমি তো অবাক। চেনাই যায় না।’ 

আরেকজন হয়তো বলছে, ‘তোদের কি তমুকের কথা মনে আছে? আরে... ওই যে, ট্যাবলেট বলে ডাকত সবাই। মনে নাই? সে দেখি আমারে ফোন দিয়েছে। আমার কাছে তো আর নাম্বার সেভ করা নাই। আমি হ্যালো হ্যালো বলে যাচ্ছি। তারপর দেখি...।’ 

অন্য একজন হয়তো বলছে, ‘একটা গোপন কথা বলি। খবরদার কাউকে বলবি না। অমুকের এক্স আছে না? সে গত মাসে আমাদের অফিসে জয়েন করেছে। বস আবার পরিচয় করায়া দেয়। লাস্ট উইকে, ক্যান্টিনে লাঞ্চের সময় ব্যাটা দেখি আমার টেবিলেই বসছে। আমি তো খুব নরমাল গলায়...।’ 

অন্য আরেকজন হয়তো বলছে, ‘তোরা এগুলো কী-সব ইউজ করিস? আমার বাসায় তো কত কত পড়েই আছে। আমি তো সময়ই পাই না। একদিন আয় না আমার বাসায়। শনিবার আয়। শুধু ডাল-ভাত খাওয়াব। শোন না... মজার একটা ঘটেছে...।’ 

আমি খেয়াল করে দেখলাম, কেউ আসলে কারও কথা শুনছে না। প্রত্যেকেই নিজেদের মতো কিছু না কিছু বলে যাচ্ছে। কে শুনছে, সেটা গুরুত্বপূর্ণ না। 

অবশ্য নির্দিষ্ট কারও দিকে না তাকিয়ে ধারাবাহিকভাবে কথাবার্তা চালিয়ে যাওয়া কঠিন। ফলে, কেউ যদি কোনো কারণে চুপ করে থাকে, বাকি সকলেই তাকে শ্রোতা মেনে নিয়ে তার দিকে তাকিয়ে বক্তৃতা চালিয়ে যাচ্ছে। চুপ থাকা শ্রোতা একবার এর দিকে আরেকবার ওর দিকে তাকিয়ে মাথা নেড়ে সায় দিচ্ছে। 

কেউ কারও কথা সেভাবে শুনছে না বা কে শুনছে না শুনছে তার অপেক্ষায় কেউ বসেও নেই, তারপরেও দেখি, হঠাৎ হঠাৎ একজন আরেকজনের গায়ে হিহিহি করে হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়ছে। হাসির কথাটা কে যে বলেছে, সবাই হয়তো শোনেও নাই, কিন্তু হাসাহাসিতে অংশ নিতে সমস্যা কী। নিঝুম রাতে সম্মিলিত হাসির আওয়াজে গোটা পাড়া একটু পরে পরে কেঁপে কেঁপে উঠছে। 

যাদের দীর্ঘ রজনী থাকার কথা, তারা সবাই আগেই চলে এসেছিল। যাদের খুব জরুরি কাজকর্ম ছিল, তাদের কয়েকজন আধঘণ্টা বা এক ঘণ্টার জন্যে ঝটিকা সফরে এসে সবার সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ করে আবার চলে গেল। 

এই আসা-যাওয়ার মধ্যে প্রত্যেকের মোবাইল ফোনেই নানা ভঙ্গিমায় শতশত সেলফি আর গ্রুপ ফটো তুলে রাখা হলো। 

গ্রুপ ফটো তুলে দেওয়ার মুহূর্তগুলোতে আমি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও চাহিদাসম্পন্ন ব্যক্তিত্ব হয়ে উঠলাম। চারিদিক থেকে ডাক আসতে লাগল, ‘ভাইয়া, একটা ছবি তুলে দেন না প্লিজ।’ ‘দুলাভাই দেখি একদম পাত্তাই দিতেসেন না। এদিকে আসেন। ছবি তোলেন আমাদের।’ ‘আমরা আপনার এতগুলি শালি। আপনি কিন্তু কারও খেয়াল রাখতেসেন না। দেখতেসি কিন্তু। এইবার কাইন্ডলি কয়েকটা ছবি তুলে দেন।’ 

আমি প্রফেশনাল ফটোগ্রাফারদের মতো করে ‘রেডি... ওয়ান টু থ্রি’ বলে বিভিন্নজনের মোবাইল ফোন ব্যবহার করে শ-পাঁচেক ছবি তুলে ফেললাম। গ্রুপ ফটোতে একসঙ্গে সবাইকে সঠিক এক্সপ্রেশনে পাওয়া যায় না। কারও হয়তো চোখ বন্ধ, কেউ আরেকদিকে তাকিয়ে আছে, হাসাহাসি করার কারণে কারও হয়তো চেহারা ঝাপসা এসেছে। কাজেই আমি ঝুঁকি না নিয়ে প্রত্যেকটা পোজের দশ-পনেরাটা করে ছবি তুলে রাখলাম, একটা না একটা তো ভালো আসবেই। 

এত ছবি তুলতে গিয়ে অনেক সময় লেগে গেল। ফলে পুরোটা সময় ধরে আমাকে ছবি তোলার ভঙ্গিমা নিয়ে নানাজনের নানামুখী বিশ্লেষণাত্মক ও হাস্যরসাত্মক মন্তব্য শুনতে হলো। আমার এই লেখাটি ছোট বাচ্চারাও পড়তে পারে, এমন আশংকায় সেইসব মন্তব্য এখানে প্রকাশ করা গেল নাা। 

ছবি তুলতে দীর্ঘ সময় নিয়ে ফেলায় আমি আদৌ ছবি তুলতে জানি কিনা অথবা আমি কি স্টিল ছবি তুলছি নাকি ভিডিও করছি, তা নিয়েও কয়েকজন নানা রকম সন্দেহ প্রকাশ করল। 

এইসব কথাবার্তা আমার কান গরম করে দিলেও, সেটা তো আর প্রকাশ করে ফেলা যায় না। আমি হাসিমুখে সবার চাহিদামতো ছবি তুলে দিলাম। 

এর মধ্যে ডিনার পরিবেশন করা হলো। কেউ কেউ বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে এসেছিল বলে তাদের একটু আগে-আগে খাইয়ে দেওয়ার ব্যাপার ছিল। আর ফারহানা আলমও খুব হাউকাউ শুরু করে দিয়েছিল--বেশি দেরি করলে খাবার-দাবার সব ঠান্ডা হয়ে যাবে এবং পরে সেগুলো খেতে একটুও মজা লাগবে না। 

সপ্তাহের কর্মদিবসগুলোতে প্রায় প্রত্যেক দিনই কাজ শেষ করে বাসায় ফিরতে ফিরতে আমার দেরি হয়ে যায়। ডিনার খেয়ে একটু বইপত্র পড়ে ঘুমাতে ঘুমাতে দেখা যায় রাত একটা কি দুইটা। আজ আগেভাগেই ডিনার শেষ হয়ে যাওয়ার পরে আবার যখন দ্বিতীয় পর্বের আড্ডা শুরু হয়েছে, তখন আমি আবারও ভদ্রতা করে বসার ঘরের এক কোনায় জড়োসড়ো হয়ে বসে মনোযোগী শ্রোতা হিসেবে আড্ডায় অংশগ্রহণের চেষ্টা করলাম। সুনির্দিষ্ট অল্প কয়েকটি বিষয় ছাড়া জগতের বেশিরভাগ গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের প্রতিই আমার আগ্রহ-উৎসাহ খুব সামান্য। যেসব বিষয় নিয়ে সবাই কথাবার্তা বলছিল, আমি অবাক হয়ে দেখছিলাম, বেশিরভাগই আমার আগে থেকে জানা নেই। 

সবাই যখন কোনো একটা হাসির কথা শুনে পেট ফাটিয়ে হেসে উঠছিল, তখনও আমার বিস্ময় বাড়ছিল, এখানে হাসি বা রসিকতার অংশ কোনটা, আমার মাথায় ঢুকছিল না। 

আমি ঠিক আসর জমিয়ে কথাবার্তা বলতে পারি না দেখে চুপচাপ সবার কথা শুনতে শুনতে আমার তন্দ্রা চলে এলো। রাত বারোটা বাজার আগেই বোধহয় আমি মাথা কাত করে গভীর ঘুমে তলিয়ে গেলাম। ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে আমি কি স্বপ্ন দেখলাম, নাকি সত্যি সত্যিই আড্ডার কিছু কিছু বাক্য আমার কানে এসেছিল, জানি না। মনে হলো, কথাবার্তার বিষয়বস্তু ঠিক সুশীল পর্যায়ে আর নাই। 

একজন হয়তো কিছু একটা বলার চেষ্টা করছে (কী বলছে সেটা এখানে বলে ফেলা ঠিক হবে না), আরেকজন হয়তো আমার দিকে ইশারা করে তাকে থামিয়ে দিয়ে বলছে, ‘চুপ! ভাইয়া আছে না এখানে!’ 

অন্যজন হয়তো চুপ করে যাচ্ছে, নয়তো বলছে, ‘ভাইয়া আছে তো কী হয়েছে। উনি কি কচি খোকা নাকি? উনি কিছু বুঝে না, জানে না?’ 

এইসব সতর্কতা বা তর্কাতর্কি ছাড়াও শেষ পর্যন্ত যেটুকু কথাবার্তা কানে ঢুকল, তাতে আমার দুই কান লাল-নীল-বেগুনি হয়ে উঠল। 

রাত আরেকটু গভীর হওয়ার পরে সবার যখন একটু একটু করে হাই উঠতে শুরু করেছে, কিন্তু উৎসাহ একবিন্দুও কমেনি, তখন সবাই মিলে আলোচনা করে ঠিক করা হলো--বসার ঘরে তোশক, জাজিম আর ফোম বিছিয়ে বিশাল বিছানা করা হবে, সেখানে স্কুল-জীবনের বন্ধুরা দশ-বারোজন একসঙ্গে চাপাচাপি করে ঘুমিয়ে যাবে। 

ক্যানাডা-ফেরত একজনের দুই শিশু আগেই ঘুমিয়ে যাওয়ায় তাদেরকে বেডরুমে মশারি টাঙিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল। আমি চাইলে তাদের পাশে গিয়ে ঘুমিয়ে যেতে পারি। 

আমি কথা না বাড়িয়ে (ঘুম পেয়ে গিয়েছিল অনেক) শিশুদের সঙ্গে ঘুমাতে চলে গেলাম। এই দুই শিশুর একজনের বয়স চার, আরেকজনের বয়স ছয়। এরা বাংলাদেশে খুব বেশি আসে না বলে বাংলা ভাষা বোঝে না, কীভাবে কথা বলতে হয়, সেটাও জানে না। 

আমি মশারির মধ্যে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে ছোটটা, যার বয়স চার, সে ঘুম ভেঙে উঠে বসল এবং দুই চোখে সন্দেহ নিয়ে আমাকে দেখে বলল, ‘হু আর ইউ?’ 

আমি বন্ধুত্বের হাসি দিয়ে বললাম, ‘হাই।’ 

শিশুটি আমার বন্ধুত্বের আহ্বান পাত্তাই দিল না। সে আরও উঁচু গলায় বিদেশি শিশুদের অ্যাকসেন্টে ঠোঁট গোল করে বলল, ‘হু আর ইউ?’ 

আমি এর আগের অভিজ্ঞতায় দেখেছি শিশুদের সঙ্গে তাদের ভাষা ও অ্যাপ্রোচেই কথা বললে তারা ঠান্ডা থাকে। আমিও গলা উঁচিয়ে বললাম, ‘হু আর ইউ?’ 

শিশুটি কয়েক সেকেন্ড আমার দিকে কঠিন চোখে তাকিয়েই থাকল। তারপর উদারা-মুদারা-তারার সবচেয়ে উঁচু স্কেলে গলার রগ ফুলিয়ে চিৎকার শুরু করল। শুরু যে করল, চিৎকার করেই গেল, কিছুতেই আর থামে না। 

শিশু নির্যাতনের দায়ে ফেঁসে যাই কিনা, সেই ভয়ে আমি কাকুতি-মিনতি করে অমায়িক গলায় বললাম, ‘হোয়াট হ্যাপেনড? ... প্লিজ স্টপ।’ 

শিশুটি এক সেকেন্ডের জন্য চিৎকার থামিয়ে আমি কী বলছি সেটা শুনল, তারপর পূর্ণোদ্যমে আবার চিৎকার শুরু করল। 

চিৎকার থামাতে আমি কি ওই শিশুর মুখ চেপে ধরতাম কিনা অথবা নিজেও পাল্টা চিৎকার শুরু করতাম কিনা, কে জানে, তার আগেই শিশুটির মা চিৎকার শুনে কোথা থেকে ছুটে এলো এবং ‘ইটস ওকে বেবি’ বলতে বলতে শিশুটিকে বুকের সঙ্গে চেপে ধরে কোথায় জানি নিয়ে গেল। 

বাচ্চা ভয়ংকর কাচ্চা ভয়ংকরের মধ্যে একটা বিদায় হয়েছে। আরেকটা ঘুমাচ্ছে। খুব শিগগিরই জেগে ওঠার সম্ভাবনা ক্ষীণ। আমি আরাম করে ঘুমাতে গেলাম। 

শেষ রাতে সেই শিশুটিও জেগে উঠল, যার বয়স ছয়, সেও ইংরেজি ছাড়া আর কোনো ভাষা জানে না। আমি ঘুমের ঘোরে একটু একটু টের পেলাম, শিশুটি বিস্ময় নিয়ে আমাকে ধাক্কা দিচ্ছে, ‘হেই! ...হু আর ইউ? হোয়ার ইজ মাই মাম্মি?’ 

আমি ঘুমের ঘোরে বললাম, ‘তোমার মা ঘুমায় গেছে। তুমিও ঘুমাও।’ 

বিদেশি শিশু বাংলা জানে না। সে বিপুল বেগে আমাকে ধাক্কাতে ধাক্কাতে বলতে লাগল, ‘হোয়ার ইজ মাই মাম্মি?’ 

আমি গভীর ঘুমের মধ্যে থেকেও মনে মনে এই বাক্যটা ট্রান্সলেশন করার চেষ্টা করলাম, ‘তোমার মা ঘুমিয়ে গিয়েছে। দয়া করে তুমিও এখন ঘুমাও। আমাকেও শান্তিতে ঘুমাতে দাও।’ 

স্কুলে থাকতে ইংরেজি ট্রান্সলেশন ক্লাসে ফাঁকি দেওয়ার ফলাফল হাতে-নাতে মিলে গেল। কিছুতেই ওই গুরুত্বপূর্ণ বাক্যের ট্রান্সলেশন মাথায় এলো না। বরং ঘুমের মধ্যে দেখতে পেলাম, ছোটবেলার ইংরেজি শিক্ষক বেত হাতে হুংকার দিচ্ছেন, ‘কী হলো? গাধার মতো চুপ করে আছিস কেন? এক্ষুনি ট্রান্সলেশন কর--তোমার মা ঘুমিয়ে গিয়েছে। দয়া করে তুমিও এখন ঘুমাও। আমাকেও ঘুমাতে দাও।’ 

আমি মাথা চুলকে নির্বাক হয়ে ইংলিশ স্যারের দিকে তাকিয়ে আছি। এটা তো পৃথিবীর সবচেয়ে জটিল ট্রান্সলেশন। কিছুতেই মাথায় আসছে না। 

আমি চুপ করে আছি দেখে ইংলিশ শিক্ষক আমাকে ধাক্কাধাক্কি শুরু শুরু করেছেন এবং রোবটের মতো বলেই যাচ্ছেন, ‘হোয়ার ইজ মাই মাম্মি? ... হেই ম্যান। টেল মি... হোয়ার ইজ মাই মাম্মি?’ 

স্যারের গলা কেমন জানি ছয় বছর বয়সী দুষ্টু শিশুর মতো শোনাচ্ছে। 

তবে দুঃস্বপ্ন আর দীর্ঘায়িত হলো না। আমি আরও গভীর ঘুমে তলিয়ে গেলাম।

 

বি.দ্র.: লেখকের নানা ধরনের রম্যের একটি সংকলন প্রকাশিত হয়েছে ২০১৮ অমর একুশে বইমেলায় 'অখাদ্য' নামে। পাওয়া যাবে জনান্তিক প্রকাশনীর ২৬০-২৬১ নাম্বার স্টলে।

অলংকরণ: মারজুক রহমান রিফাত

১০০৯৫ পঠিত ... ০৪:৪৮, ফেব্রুয়ারি ১৬, ২০১৮

আরও

পাঠকের মন্তব্য

 

ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে

আপনার পরিচয় গোপন রাখতে
আমি নীতিমালা মেনে মন্তব্য করছি।

আইডিয়া

গল্প

সঙবাদ

সাক্ষাৎকারকি

স্যাটায়ার


Top