গাঙ্গুবাঈ; বোম্বের অগ্নিনারী

১৪৩৫ পঠিত ... ১৭:০৩, জুন ০৬, ২০২২

Gangubai

সঞ্জয়লীলা বানসালি আমাদের দিশাহীন বর্তমানে বসে টাইম মেশিনে করে নিয়ে যান, ইতিহাসের ঝলমলে অতীতে; যখন সমাজ সংস্কার করে দক্ষিণ এশিয়া সভ্যতার পাদপীঠে পৌঁছাতে চেষ্টা করেছিলো। গাঙ্গু বাঈ নামের এক সবল নারী কীভাবে নারী অধিকারের পক্ষে লড়েছেন; ব্যারিস্টারের মেয়ে ফিল্মের হিরোইন হবার স্বপ্ন নিয়ে এক ঠগী প্রেমিকের ছলনায় ভুলে বোম্বে এলে গাঙ্গুকে বেচে দেয়া হয় বোম্বের সেক্স ওয়ার্কার হিসেবে। সেক্স ওয়ার্কার থেকে সোশ্যাল ওয়ার্কার হবার গল্প এই গাঙ্গু বাঈয়ের জীবন। নেতৃত্বের গুণ থাকলে জীবনের যে কোন প্রতিকূলতা থাকলেও যে সুকৃতির বায়োপিকের মতো জীবন রেখে যাওয়া যায়; বানসালি সেই বার্তাটাই দিয়েছেন গল্পে ও সংগীতে।

বানসালি থিয়েটারের মানুষ; তিনি অতীতকে রিকনস্ট্রাক্ট করতে পারেন; শিল্প নির্দেশনার নিখুঁত মুন্সিয়ানায়। বানসালি তার শিল্পের তুলিতে সৃষ্টি করতে পারেন চন্দ্রমুখীর শোবার ঘর-বারান্দা, হয়তো একই সেট একটু এদিক ওদিক করে গাঙ্গু বাইয়ের ঘর-বারান্দা; স্নানাগার; মহল্লার ইংরেজ আমলের স্থাপত্য কোথাওবা মুঘল কিংবা মৌর্যযুগের স্থাপত্য-শিল্প উপাদান। আলোক প্রক্ষেপণেও একই লাইটের গোছা অন্তত দেবদাস, বাজিরাও মাস্তানি, গাঙ্গুবাঈ মুভিতে ব্যবহার করেছেন; অথচ যার যার সময়ের অথেনটিক আলোকসজ্জা ধরে রেখেছেন। গাঙ্গু বাঈ ছবিতে ১০০ কোটি টাকা খরচ করে এরই মাঝে দ্বিগুণ টিকেট বেচে ১০০ কোটির মুনাফা গুনেছেন।

ফলে বানসালি হিন্দুত্ববাদের চোখ রাঙ্গানি উপেক্ষা করে তার চলচ্চিত্রে হিন্দু-মুসলমান, বড় ভাই-ছোট বোন, ছেলেবন্ধু-মেয়েবন্ধু হতে পারে; প্রেমিক-প্রেমিকা কিংবা স্বামী-স্ত্রী হতে পারে; ধ্রুপদী সাহিত্যে ও ইতিহাসে যেরকম সুসম্পর্ক ছিলো হিন্দু-মুসলমানের মাঝে; বানসালি তাই চিত্রায়িত করেছেন।

গাঙ্গুকে প্রেমের ছলনায় ভুলিয়ে বোম্বে এনে তার ঠগী প্রেমিক সঙ্গে নিয়ে গিয়ে শীলা মাসির ললিতলোভনকান্তি মাংসের দোকানে বিক্রি করে দিয়েছে মাত্র এক হাজার টাকার বিনিময়ে। শীলামাসির পরিবেশিত ললিত লোভন কান্তি মাংস পিণ্ড হবার পর; প্রথম সম্মানহানির উপার্জন প্রদীপের আগুনে পুড়িয়ে দেয়; অথবা গাঙ্গু আগুন হয়ে ওঠে।

এক পাঠান সন্ত্রাসী যুবক এসে রিভলবার ঠেকিয়ে ধর্ষণের চেষ্টা করলে; গাঙ্গু প্রতিরোধের চেষ্টা করে। ক্রোধে উন্মত্ত সন্ত্রাসী গাঙ্গুকে পিটিয়ে হাসপাতালে পাঠিয়ে দেয়।

গাঙ্গু এলাকার গড ফাদার আরেক মুসলমান চরিত্রের কাছে গিয়ে তার ওপর নির্যাতনের বিচার চায়। বড় ভাই-ছোট বোনের রসায়ন তৈরি হয়; গাঙ্গুর মাঝে সাহসের আগুন দেখেছিলো সাহসী গডফাদার।

গড ফাদার একদিন প্রকাশ্যে গাঙ্গুর নির্যাতনকারী সন্ত্রাসীকে পিটিয়ে দিলে; গাঙ্গুর নেতৃত্ব বিকাশ ত্বরান্বিত হয়। সে শীলা মাসীকে জানিয়ে দেয়, সপ্তাহে একদিন ছুটি কাটাবে যৌনকর্মীরা। সব চাকরির মতো এই চাকরিতেও সাপ্তাহিক ছুটি থাকতে হবে। সবাইকে নিয়ে মুভি দেখতে গিয়ে নোংরাভাবে ফ্লার্ট করতে আসা যুবকে চড়-ঘুষি দিয়ে জানান দেয়; মাফিয়া রাণীর উদ্ভাস। ছুটলে গাঙ্গুকে থামায় কে! শীলা মাসি মারা যাবার পর গাঙ্গু হয়ে ওঠে গাঙ্গু বাঈ।

গাঙ্গু যৌনকর্মীদের সন্তানদের জীবন পরিচর্যায় মনোযোগ দেয়; যৌন কর্মীদের স্বাস্থ্য ও কল্যাণ চিন্তা মুখ্য হয়; তার এই গাঙ্গু বাঈয়ের দায়িত্ব পালনের সময়। যারা স্বেচ্ছায় এই পেশায় থাকতে চায়; তারাই যেন কাজটা করে; বাকিদের নিজ নিজ বাড়ি পৌঁছে দেবার ব্যবস্থা করে দেয়; এরমাঝে টুকটাক প্রেম করে তার ফ্যাশনেবল তরুণ টেইলর মাস্টারের সঙ্গে। গাঙ্গু শেষ পর্যন্ত রোমান্টিক; যে দেবানন্দের বিপরীতে অভিনয়ের স্বপ্ন নিয়ে বোম্বে এসে প্রেমিকের মাধ্যমে প্রতারিত হয়ে আজ ললিতলোভনকান্তি মাংস বিক্রেতা হয়েছে; কিন্তু তার মানে এই নয় যে, সে এই অতীতের তিক্ততা নিয়ে বিলাপ করবে। জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত সুন্দর করে তোলার আপ্রাণ চেষ্টা করে সে।

পাশের এক চল্লিশ বছরের পুরোনো খ্রিস্টান স্কুল; আদালতে যায় অভিযোগ নিয়ে, শত বছরের পুরনো পতিতালয়ের পরিবেশ ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য ক্ষতিকর; অতএব তা উচ্ছেদ করা হোক।

গাঙ্গু বিস্মিত হয়, পতিত সমাজের লোকেরা যেখানে মুখ লুকিয়ে আসে; ললিতলোভনকান্তি মাংস কিনতে; অথচ ফিরে গিয়ে বিরাট সাধু সেজে পতিতা বলে "তকমা" দেয়; অন্যান্য পেশার মতোই একটি পেশার গায়ে। ডেভেলপাররা সুউচ্চ দালানের ব্যবসা গড়তেই এসব আবদার নিয়ে আসে; গাঙ্গুর গড ফাদার বড়ভাই সে কথা স্কুলের আইনজীবীদের স্পষ্ট করে বলে। 

গাঙ্গু কয়েকটি শিশুকে নিয়ে ঐ বিক্ষুব্ধ মিশনারি স্কুলে ভর্তি করতে গেলে; বোরখা পরা খ্রিস্টান ধর্মযাজিকা নাক সিটকায়। হেড মাস্টার ফাদারের কাছে, এই শিশুদের মাতার নামের  জায়গায় গাঙ্গু বাঈ লিখে দেবার অনুরোধ করে। হেড মাস্টার শিশুদের পিতার নাম চাইলে, গাঙ্গু উত্তর দেয়, মায়ের নাম যথেষ্ট না হলে; পিতার নামের জায়গায় দেবানন্দ লিখে দেন। গাঙ্গুর এই প্রতিবাদের আগুন এক সাংবাদিকের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। সে গাঙ্গুকে নিয়ে একটা কাভার স্টোরি করে। এর মধ্যে গাঙ্গু তার এলাকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে পরাজিত করে মহাপরাক্রমশা্লী এক থার্ড জেন্ডারের নেত্রীকে।

কাজের লাইসেন্স না থাকায় ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খোলা যায় না; তাই যৌন পেশার লাইসেন্স পাওয়ার জন্য আন্দোলন করে গাঙ্গু বাঈ। নারী অধিকার বিষয়ক নাগরিক সমাজে বিতর্ক করেন সমাজের ভুল চিন্তার, ভুল নৈতিকতা, ভুল দম্ভ তুলে ধরতে। গাঙ্গু বাঈ বলেন, মানুষ যেমন মেধা বিক্রি করে; ঠিক তেমনি ভালোবাসা বিক্রি করে। সুতরাং এর স্বীকৃতি থাকবে না কেন?

সাংবাদিক বন্ধুটি গাঙ্গুর সঙ্গে এলাকার সাংসদ প্রার্থীর সখ্য তৈরি করে; প্রধানমন্ত্রীর পনেরো মিনিটের একটি এপয়েনমেন্ট জোগাড় করে দেয়। গাঙ্গু জানতো, মাত্র পনেরো মিনিটে সে প্রধানমন্ত্রীকে তার লাইসেন্স পাওয়ার দাবী, আর উচ্ছেদ ষড়যন্ত্র থেকে রক্ষা করার অনুরোধ তুলে ধরতে পারবে। প্রধানমন্ত্রী গাঙ্গুর মেধা ব্যক্তিত্ব আর যুক্তিবোধে মুগ্ধ হন।

বোম্বের চার হাজার যৌন কর্মীর অধিকার প্রতিষ্ঠায় আর সামাজিক সুবিচার নিশ্চিত করার আন্দোলনে গাঙ্গু এক স্মরণীয় নাম। তার কথা ইতিহাসে আলোচিত না হলেও; চার হাজার নারীর দেয়ালে দেয়ালে তার ছবি ঝুলে থাকে; যা থেকে গাঙ্গু বাঈয়ের চলচ্চিত্রের মতো জীবন রিকন্সট্রাক্ট করেছেন; বানসালি।

১৪৩৫ পঠিত ... ১৭:০৩, জুন ০৬, ২০২২

আরও eআরকি

পাঠকের মন্তব্য

 

ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে

আপনার পরিচয় গোপন রাখতে
আমি নীতিমালা মেনে মন্তব্য করছি।

আইডিয়া

কৌতুক

রম্য

সঙবাদ

স্যাটায়ার


Top