শাহরিয়ার কবিরকে একবার জিজ্ঞেস করেছিলাম, শৈশবে আপনি আমাদের প্রিয় কথাসাহিত্যিক ছিলেন। এমন সৃজনশীল মানুষ হয়ে কেন অযথা এই অসৃজনশীল বৃত্তে জড়ালেন! উনি উত্তর দিলেন, দেশটা এমন হয়েছে যেখানে কাজ করতে গেলে প্রধান দুটো বৃত্তের যেকোনো একটাতে থাকতে হয়; নাহলে বদরুদ্দীন উমরের মতো একা হয়ে যেতে হয়।
বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবীরা একা থাকতে ভয় পান; তাইতো ১০১জন বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবীর প্রেস রিলিজ হয়ে তাদের বাঁচতে হয়; আর শেষ পর্যন্ত তার বুদ্ধিজীবী হয়ে ওঠা হয় না। জনগণের পক্ষে বুদ্ধিবৃত্তিক সক্রিয়তা জারি রাখার ভান করে বৃত্তবদ্ধ বুদ্ধিজীবী হওয়ার সুযোগ খুঁজতে হয়।
বদরুদ্দীন উমর অক্সফোর্ডে পড়ালেখা করেছিলেন। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগ গড়েছিলেন। পাকিস্তানের সে সময়ের সেনাশাসনের সঙ্গে দ্বন্দ্বে জড়িয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতা ছেড়েছিলেন। পাকিস্তান আমলের আইয়ুব খান থেকে স্বাধীন বাংলাদেশে হাসিনা আমল; সবসময় তার কাছে গোয়েন্দা সংস্থার ফোন এসেছে; অভিযোগ একটাই, সরকারের বিরুদ্ধে উস্কানি দিয়েছেন তিনি। নির্মোহভাবে সত্যি কথাটা বলা; ক্ষমতা কাঠামো ও লোভাতুর প্রতিষ্ঠানের চোখে সবসময় উস্কানি দেওয়া। চেয়ারের লোভ সত্য শব্দের প্রতিশব্দ হিসেবে উস্কানিকে অভিধানভুক্ত করে।
উমর এই দক্ষিণ এশীয় পদ-পদবি-পদকের লোভের উঞ্ছজীবনের বিপরীতে বেছে নিয়েছিলেন এক বৃহৎ জীবন। তাই তো স্বাধীনতা পদক, বাংলা একাডেমি পদকসহ একের পর এক পদক প্রত্যাখান করে জানান দিয়েছিলেন, অসাড় প্রতিষ্ঠানের মানুষকে মূল্যায়নের যে দুই ইঞ্চি গজফিতা; ওনার দৈর্ঘ্য তার চেয়ে বেশি।
উমর এই জনপদের দেড়শ বছরের ইতিহাস বর্ণনা করেছেন নৈর্ব্যক্তিকভাবে। এতে ইতিহাসের দলীয় ও ধর্মীয় স্বার্থের বয়ানগুলো ভেঙে পড়েছে। শতমুখে বলে প্রতিষ্ঠা করা মিথ্যা ও শঠতার কলকব্জা বিকল হয়ে গেছে উমরের সত্য উচ্চারণের সক্রিয়তায়।
তিনি দেড়শ বছরের ইতিহাস পর্যালোচনা করে বুঝেছিলেন, কৃষক ও শ্রমিকের গড়ে তোলা অভ্যুত্থান ও জনযুদ্ধের কৃতিত্ব ছিনতাই করে কীভাবে প্রতিষ্ঠানের ফড়িয়ারা আখের গুছিয়েছে। তিনি তাই কখনও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াতে যাননি। কারণ তার কাছে মনে হয়েছে, বৃটিশ, পাকিস্তান আমল হয়ে স্বাধীন বাংলাদেশে এই বিশ্ববিদ্যালয় একইভাবে ক্ষমতার ভৃত্য ও ফুটসোলজার তৈরি করেছে। কৃষক ও মেহনতী মানুষের ছেলে এই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে, রাজনীতিক, আমলা ও বুদ্ধিজীবী হয়ে নিজের ফেলে আসা অতীতকে পীড়ন নির্যাতন করেছে। নিজেরা কলকাতার বাবু সেজে বসেছে; ছেলে-মেয়েকে বৃটিশ সাহেব বানানোর চেষ্টায় মরিয়া হয়েছে।
১৯৫০-এ বর্ধমানে তার প্রপিতামহের গৃহটি পুড়ে যায় সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষে। ভারতের পশ্চিমবঙ্গ থেকে পাকিস্তানের পূর্ববঙ্গে চলে আসতে হয় তাদের। এই ইতিহাস বর্ণনায় তিনি কখনও কেঁদে আকুল হননি; আর পাঁচটা বুদ্ধিজীবীর মতো দেশভাগের যন্ত্রণা বর্ণনা করতে গিয়ে কৌশলে ‘সংখ্যালঘু’ নির্যাতনের ন্যারেটিভ প্রতিষ্ঠা করে পররাষ্ট্রীয় আগ্রাসনের রেশমী চাদর বিছিয়ে দেননি। ওসব লস্ট হাভেলি ফিরে পাওয়ার আকুতি খেলনা মানুষের থাকে।
উমর তার ছেড়ে আসা উচ্চবিত্ত জীবনের বিপরীতে ঢাকার মধ্যবিত্ত জীবনে জ্ঞান-সাধনায় নিমগ্ন থেকেছেন। বেতের সোফায় শার্ট ও লুঙ্গি পরে বসে থাকা উমরের পাশে ম্লান হয়ে গেছে নতুন উচ্চবিত্তদের থ্রি-পিস স্যুট, রেশমি পোশাকের ঝলমল। ক্ষমতামুখী রাজনীতিকদের সঙ্গে জনতামুখী রাজনীতিক হিসেবে উমরের প্রতি তুলনা সত্যজিত রায়ের জলসাঘর মুভির লব্ধ প্রতিষ্ঠিত ঠিকাদার আর ধ্রুপদী সঙ্গীত প্রিয় অভিজাত প্রবীণের। দেশ নিয়ে জুয়া খেলার সংসদে যখন লাইলাতুল ইলেকশনের ঠিকাদারেরা ‘বুক ফাইটা যায়’ শুনে উচ্ছ্বসিত; উমর তখন কৃষক স্বার্থের রাজনীতি করেছেন।
তার ‘চিরস্থায়ী বন্দোবস্তে বাংলার কৃষক’ গ্রন্থটি যে অমোঘ বাস্তবতা বর্ণনা করে বাংলাদেশ রাজনীতির চিরস্থায়ী বন্দোবস্তেও আমরা তার নির্মম পুনরাবৃত্তি দেখি। অতীতের আয়নায় বর্তমানকে দেখার চোখটি উমর আমাদের উপহার দিয়েছেন। তার ‘ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ও উনিশ শতকের বাঙালি সমাজ’ গ্রন্থে অতীতের আয়নায় আমরা দেখতে পাই ঢাকার কথিত প্রগতিশীল ও সংস্কৃতিঘন মামা-খালাকে। যারা শেষ পর্যন্ত একটি কাল্পনিক ‘উচ্চশ্রেণী’ নির্মাণ করে অধিকার বঞ্চিত মানুষকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করে অর্থহীন ও ফাঁপা জীবন-যাপন করে।
বঙ্গভঙ্গ ও ভারতভাগের দায় যে কংগ্রেসের নেতাদের তা উঠে আসে তার ‘বঙ্গভঙ্গ ও সাম্প্রদায়িক রাজনীতি’ ও ‘ভারতীয় জাতীয় আন্দোলন’ গ্রন্থে; আর তাতেই বিপদে পড়ে যায় ছোটবেলা থেকে সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষে পাখি পড়ানোর মতো শেখানো বয়ানের ব্লাফগুলো।
ভাষা আন্দোলন, কৃষক আন্দোলন, উনসত্তরের অভ্যুত্থান থেকে স্বাধীনতাসংগ্রাম হয়ে যুদ্ধোত্তর বাংলাদেশের পাঁচটি দশকের রাজনৈতিক ইতিহাস উমর লিখেছেন গ্রিক ইতিহাসবিদ থুসিডাইসিসের মতো।
উমরের চিন্তা ২০২৪-এর জুলাই বিপ্লবকে প্রভাবিত করেছে। তিনি ফ্যাসিস্টকে মেরে তাড়ানোর দীপ্ত উচ্চারণ করার অল্পসময়ের মধ্যেই ঘটনাটি ঘটেছে। জুলাই বিপ্লবের সময়, তিনি এটিকে এই জনপদের ইতিহাসের সবচেয়ে বড় অভ্যুত্থান বলেছেন। তবে বারবার গণ-অভ্যুত্থান ও জনযুদ্ধের সুফল যেভাবে ফড়িয়া শ্রেণী হাইজ্যাক করে; সে ব্যাপারে সাবধান করেছেন তিনি। কারণ ক্ষমতার দুধের মাছি খাতক সমাজকে হাড়ে হাড়ে চিনেছেন তিনি।
আওয়ামী লীগের দলান্ধ লোকেরা উনাকে বদ উমর বলে, আর ধর্মান্ধ লোকেরা উনাকে নাস্তিক বলে; ঐ যে চিন্তার দুই ইঞ্চি গজফিতা দিয়ে গালিভরকে মাপার যে লিলিপুটিয় ও ব্লেফুসকুডিয়ান নেশা; সেই কৌতুক আমাদের সমাজে রয়ে যায় যুগ থেকে যুগান্তরে।
জেনজি তাদের ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য থাকার পরেও ক্ষীণবুদ্ধি ফেসবুক বুদ্ধিজীবীদের কাছ থেকে রাজনীতির আলোচনায় গোবর ছুঁড়তে শিখছে। কথা বলছে বহু ব্যবহারে জীর্ণ ক্লিশে ভোকাবুলারিতে।
বদরুদ্দীন উমরের মতো ত্রিকালদর্শী চিন্তক বাংলাদেশের যে রাজনীতির জীবনী লিখেছেন; তা অমূল্য জ্ঞানের আকর হয়ে রইল। এ অনেকটা বাংলাদেশ জাদুঘর পরিভ্রমণের অভিজ্ঞতা। উমরের গ্রন্থগুলো পড়তে শুরু করলে বাংলাদেশে মিথ্যার মোমে গড়া রাজনীতিপূজার মূর্তিগুলো গলে পড়তে থাকে। আর ফেসবুকে গজিয়ে ওঠা মেগালোম্যানিয়াক বুদ্ধিজীবীগুলোকে খর্বকায় দেখায়।
বদরুদ্দীন উমর সত্য কথাটা যেভাবে নির্ভয়ে, নির্দ্বিধায়, নৈর্ব্যক্তিকতায় স্বচ্ছ ও নির্মোহভাবে উচ্চারণ করেছেন; তাতে নতুন প্রজন্মের জন্য তিনি হতে পারেন বৈষম্যমুক্ত বাংলাদেশ বিনির্মাণের অনন্ত অনুপ্রেরণা।
পাঠকের মন্তব্য