নূরা পাগলা, আমার স্মৃতি ও বিচিত্রার প্রচ্ছদ রচনা

১৩ পঠিত ... ৬ ঘন্টা ১১ মিনিট আগে

লেখা: সাহাদাত পারভেজ

আমি যে এলাকায় জন্মেছি বহু বছর আগে সেখানে এক আধ্যাত্মিক সাধক ঘুরে বেড়াতেন। ওই সাধককে সবাই ডাকতেন ‘লেংটা’। তার প্রকৃত নাম সোলায়মান শাহ (রা.)। নেংটি পড়ে থাকতেন বলেই লোকে তাকে এমন শিরোপা দিয়েছিল। তাকে নিয়ে বহু মিথ এখনও আমাদের এলাকার মানুষের মুখে মুখে ঘুরে বেড়ায়। আমার দাদী কার্তিকজানের কাছে ছোটবেলায় তার অনেক গল্প শুনেছি। দাদির মুখে শোনা সেই গল্পের নায়ক মারা যান আমাদের পাশের উপজেলা মতলবের বেলতলীতে। ওখানকার বদরপুরায় তার মাজার রয়েছে। আমার জন্মের সঙ্গে ওই মাজারের একটা যোগসূত্র আছে। সেই গল্প আরেকদিন বিস্তারিত বলব।

তবে আজ আলোচনা করতে চাই নূরা পাগলাকে নিয়ে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দেখলাম নূরা পাগলা নামের একজনের লাশ কবর থেকে তুলে পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। এরকম কাজ ইসলাম সমর্থন করে বলে আমার জানা নাই। এখন বোধ হয় কবরের ভেতর মৃত মানুষও নিরাপদ নয়।

আমি একজন নূরা পাগলাকে চিনতাম। আশির দশকের মাঝামাঝি সময়ে তাকে দুই তিনবার দেখি মতলবের বদরপুরায় সেই লেংটার মেলায়। তখন আমার বয়স সাত-আট। একটি হাতির উপর বসা এক দীর্ঘদেহী মানুষ। লম্বা লম্বা চুল-দাড়ি। গায়ে নেংটি ছাড়া আর কিছু নেই। তার পায়ের উরুতে চাকু বসান। সেখানে সামান্য জমাটবাধা রক্ত। দেখে গা ছমছম করে উঠল। আব্বা আমাকে তার কাছে নিয়ে গেলেন। কী যেন বললেন? নূরা পাগলা আমার মাথায় হাত রেখে একটা ফুঁ দিলেন-এতটুকু মনে করতে পারি।

এর বহু বছর পর বাংলা একাডেমির লাইব্রেরিতে পুরনো পত্রিকা ঘাঁটতে গিয়ে হঠাৎ নূরা পাগলাকে নিয়ে সাপ্তাহিক বিচিত্রায় একটি প্রচ্ছদ প্রতিবেদন পেয়ে যাই। প্রতিবেদনটি ছাপা হয়েছিল ১৯৭৩ সালের ১০ আগস্ট। প্রচ্ছদ রচনার শিরোনাম ‘নূরা পাগলা ও আজম: সঙ্গীতে আধ্যাত্মিক প্রেরণা।’ এই প্রচ্ছদ মূলত নূরা পাগলা ও সঙ্গীতগুরু আজম খানকে নিয়ে লেখা। বিচিত্রার প্রতিবেদক তার একটা দীর্ঘ সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন। তারই ভিত্তিতে প্রচ্ছদ কাহিনিটি রচিত।

বিচিত্রার প্রতিবেদকের সঙ্গে শুরুতেই নূরা পাগলা বলেন, ‘আবার ভাসানী গিয়ে শেখ আসুক, আমার তাতে মাথা ব্যথা নেই। আমি জেহাদ করব তখন যখন ইন্ডিয়া এদেশে আসবে, যখন পাকিস্তান এদেশে আসবে, এছাড়া অন্য কোনো ব্যাপারে আমি নাক গলাই না। আমাকে কাদের সিদ্দিকী দাওয়াত দিয়েছিল তার ভাইয়ের বিয়েতে, আমি গিয়েছি সেখানে। সে দেশের জন্য কাজ করেছে। আমি পাঁচশ টাকার মালা দিয়েছি। ছেলেদের নিয়ে জঙ্গলে বসে খেয়েছি। শেখ সাহেব যখন ঢাকা এলেন আমি তাকে এয়ারপোর্টে গিয়ে এনেছি। কিন্তু আমার নিজের কাজে কখনও তার কাছে যাইনি। আমার ছেলেদের যে মেরেছে তার জন্য আমি টাকাও চাইনি। শুনেছি সবাই নাকি দুই হাজার করে টাকা পেয়েছে, আমি নেইনি। অথচ সাংবাদিকরা লেখে আমি জয় বাংলা করি …।’

নূরা পাগলা একনাগাড়ে বলেই চলেন। বার যার গাঁজার প্রসঙ্গ টানেন। বলেন, ‘কেন ওরা লিখল আমি গাঁজা খাই? আমার আত্মীয় স্বজনরা ভাববে আমি এই জন্যই বুঝি ঘর ছেড়েছি। ওই যে দেখুন কারা গাঁজা খাচ্ছে। ওদের ওখানে আমার কোনো ছেলেই যায় না।’ নূরা পাগলার আসরের পাশে বটতলার নিচে কয়েকজন জটাধারী সাঙ্গ-পাঙ্গ নিয়ে গাঁজার দম দিচ্ছিলেন। নূরা পাগলা ওদের ওপর মহাবিরক্ত।

বিচিত্রা লিখেছে, নূরা পাগলার বয়স আশির ওপরে। অথচ পেশীবহুল পেটানো শরীর দেখে মনে হবে কোনোক্রমেই ষাট পেরোয়নি। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে তিনি বৃটিশ আর্মিতে ছিলেন। মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধ করেছেন। বসরার কথা তার এখনও মনে আছে। ফেরার পথে আজমীরে খাজা বাবার দরগায় গিয়েছিলেন। সেখানে এক ফকিরের সঙ্গে তার দেখা হয়েছিল। সেই ফকিরই তার আধ্যাত্মিক গুরু। যখন নূরা পাগলা রোগের চিকিৎসা করেন তখন নাকি সেই ফকিরের রূপ ধারণ করেন।

তার আসল নাম কেউ জানে না। তিনি নিজেও জানেন না তার স্ত্রী-পুত্র কে কোথায় আছে। বাড়ি নোয়াখালীতে। অনেক বছর বাড়ির সঙ্গে কোনো সম্পর্ক নেই। লোকে যা টাকা পয়সা দেয় তাতেই খাওয়াটা হয়ে যায়। উদ্বৃত্তটা ভিখিরীদের দেওয়া হয়। লেখাপড়া কতদূরে শিখেছেন তাও বললেন না। কেউ কেউ বলে নূরা পাগলা নাকি পুলিশ বিভাগে চাকুরি করতেন। সাব-ইন্সপেক্টর ছিলেন। তবে কথার মাঝে মাঝে নূরা পাগলা প্রচুর ইংরেজি শব্দ ব্যবহার করেন।

গভীর আধ্যাত্মিক প্রেরণা থেকে নূরা পাগলা গান করেন। গাইবার সময় বুকের ভেতর থেকে কান্না ঠেলে বেরুতে চায়। গাইতে গাইতে পারিপার্শ্বিকতা ভুলে যান, বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের কিছুই তখন তার মনে থাকে না। মনে হয় তিনি অন্য কোনো জগতের বাসিন্দা।

সঙ্গীদের সম্পর্কে নূরা পাগলা বলেন, দু’দিনের জন্য এসেছে। মোহ কেটে গেলেই চলে যাবে। অনেকেই তো এলো। যখন আসল যন্ত্রাণার সামনে আসবে তখন সবকটা পালাবে। মাত্র দুটো ছেলে এখনও টিকে আছে। পায়ে ছুরির গভীর ক্ষতচিহ্ন দেখিয়ে যন্ত্রণার স্বরূপ বোঝাবার চেষ্টা করলেন নূরা পাগলা । তার সঙ্গীটিও তাই। সঙ্গী ছেলেটি একটা চোখও হারিয়েছে। তবু সে যায় না। তার বাপ-চাচা বহুবার এসে বুঝিয়েছে, সে যায়নি। আরেকজন সরকারী কর্মচারী ছিলেন। তিনিও সব কিছু ছেড়ে দীর্ঘদিন নূরা পাগলার সঙ্গে রয়ে গেছেন। শরীরটা শুকিয়ে কাঠির মতো হয়ে গেছে। আলবদরের লোকেরা পিটিয়ে তার দাঁত ভেঙ্গে দিয়েছে। অনেক অত্যাচারের পরও ফিরে যায়নি।

নূরা পাগলা জানালেন, সারাদেশে তার সাতাশ হাজার পাঁচশ ছেলে রয়েছে। ওরা ভাবে আল্লাহর দেখা পাওয়া বুঝি খুবই সহজ। কদিন পর যখন দেখে ব্যাপারটা যতোটা সহজ ভেবেছিল ততোটা নয় তখন সবাই কেটে পড়ে। তবু এর মধ্যে কয়েকজন টিকে যায়।

কোন কাগজ তার বিরুদ্ধে লিখেছে এটি বিচিত্রার প্রতিনিধিকে জানাতে পারেন না নূরা পাগলা । অবশ্য আরেকজন সঙ্গী তাকে পত্রিকার নামটি মনে করিয়ে দেন। ‘দৈনিক বাংলা’ শুনে বিচিত্রার প্রতিনিধি লজ্জায় অধোবদন হলেন। নূরা পাগলা যে সাংবাদিকদের অপছন্দ করেন তা নয়। বিচিত্রার আলোকচিত্রগ্রাহক যখন ছবি তোলার অনুমতি প্রার্থনা করলেন তখন নূরা পাগলা স্বচছন্দে অনুমতি দেন। ছবিকে প্রাণবন্ত করার জন্য সঙ্গীতের প্রয়োজন একথা জানতে পেরে নূরা পাগলার সঙ্গীরা ড্রামে ঘা দিলেন। তাল-লয় ঠিক রেখে সঙ্গীতের সঙ্গে উদ্বাহ হয়ে নাচলেন অনেকটা কীর্তনীয়াদের মতো।

নূরা পাগলার যথেষ্ট মৌলিকতা রয়েছে একথা স্বীকার করেন পপ সঙ্গীতের গুরু আজম খান। উচ্চারণ গোষ্ঠীর আজম খান সেদিন ঢাকার এক মঞ্চে গাইলেন-

‘হাইকোর্টের মাজারে

কত ফকির ঘোরে

কয়জনা আসল ফকির

প্রেমের বাজারে।’

আজম খান গাইলেন ঠিক সেই ভাবে-যেভাবে হাইকোর্টের মাজারে নূরা পাগলা গান। আসিক আর প্রকরণের দিক থেকে কোনো পার্থক্য নেই। আজম খান বলেন, যে উদ্দেশ্যে নূরা পাগলা গান, সেই উদ্দেশ্যে আমিও গাই। গাইবার সময় আমার ভেতরে এক অদ্ভুত ধরনের প্রেরণা অনুভব করি।

১৩ পঠিত ... ৬ ঘন্টা ১১ মিনিট আগে

আরও eআরকি

পাঠকের মন্তব্য

আইডিয়া

কৌতুক

রম্য

সঙবাদ

স্যাটায়ার


Top