এই তো কিছুকাল আগে ফেসবুকে শামীম নামের এক তরুণের সাহিত্য-সমালোচনা দেখে ভাল লাগল। এত অল্পবয়সে বিশ্বসাহিত্যের ওপর এমন দখল; বিশ্বসাহিত্য নিয়ে নির্মেদ আলোচনা করার ক্ষমতা সব মানুষের থাকে না। তার এসব সাহিত্য ও সমাজ আলোচনার প্রেক্ষিতে কক্ষনোও একটিও নেতিবাচক মন্তব্য চোখে পড়েনি।
কিন্তু যখনই ছেলেটি স্বতন্ত্রভাবে ডাকসু ইলেকশনে অংশ নিতে গেছে; ‘দুধভাতে উৎপাত’ দেখে তীর-ধনুক হাতে বেরিয়ে এসেছে অন্ধ মতাদর্শের কইয়া দিমুরা। আমাদের গ্রামে একজন মানুষকে গান্ধা কইরা দেওয়ার ১০১টি পদ্ধতি শত শত বছর ধরে চালু আছে। পারিবারিক পরচর্চা আড্ডায় অপরকে গান্ধা কইরা দেওয়াই এখানে ঐতিহ্যগত বিনোদন।
কাউকে ডিফেম করতে একেক সময়ে একেক কৌশল জনপ্রিয় থাকে। আওয়ামী লীগ রাষ্ট্রক্ষমতায় থাকলে কাউকে ডিফেম করতে তাকে বিএনপি-জামায়াত বলে দেওয়া হতো। চব্বিশের ৫ অগাস্টের পর কাউকে ডিফেম করতে তাকে আওয়ামী লীগ বলে দিলেই যথেষ্ট।
এই ছেলেটির ক্ষেত্রেও তা ব্যতিক্রম হয়নি। তাকে ফেসবুকের কুখ্যাত সুপারকপ লীগের সাগরেদ হিসেবে পরিচয় করে দেওয়া হয়েছে। সুপারকপ লীগ ছিল এক অভিনব থিয়েটার। বিদেশী কুকুর নিয়ে ছবি দিয়ে নিজেকে অভিজাত প্রমাণের চেষ্টা; ল্যাপটপের ওপর হার্ভার্ডের স্টিকার লাগিয়ে রেখে শো-অফ, এমনকি বান্দরবানে পুলিশি করার কালে পেছনে বিরাট বুকশেলফ দেখিয়ে নিজেকে পড়ুয়া হিসেবে তুলে ধরা। আমাদের সমাজে নতুন টাকা-পয়সা হলে এরপর যেরকম সাহিত্য সংস্কৃতির ঝোঁক হয়; আর কী করলে লোকে অভিজাত কালচার্ড বলবে; সেই চেষ্টায় মরিয়া ছিল ঐ পুলিশটি। পুলিশ বিভাগ তার ঐ মানসিক রোগ টের পেয়ে নিয়মিত দায়িত্বে না রেখে পুলিশের প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে রেখে দিয়েছিল।
ফেসবুকে সুপারকপের যেরকম কালচারাল পড়ুয়ার ডিসপ্লে ছিল; তাতে বিশ্ববিদ্যালয়ে নতুন ভর্তি হওয়া ছাত্র-ছাত্রীর পক্ষে ঐ নাটক ধরা বেশ কঠিন ছিল।
যেভাবে আওয়ামী লীগের আর পাঁচটা সংস্কৃতি মামা ও খালারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীদের ফিশিং করে কালচারাল ফ্যাসিস্ট বানানোর চেষ্টা করে; সুপারকপও তার ব্যতিক্রম ছিল না।
আলোচিত তরুণের সঙ্গেও ঘনিষ্ঠতা পাতিয়েছিল সুপারকপ; প্রগলভ হয়ে দু'চারটি পোস্টও দিয়েছে তাকে নিয়ে। সংস্কৃতি মামারা খুব তরল হয়, তারা যেকোনো বন্ধুত্ব খলবল করে ফেসবুকে প্রদর্শন করতে বেশ পছন্দ করে।
সুপারকপের সেই প্রগলভতার সূত্র ধরে ডাকসু নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী অন্ধ মতাদর্শের খেলোয়াড়েরা শামীমকে গান্ধা করে দিতে তাকে ছাত্রলীগ বলে তকমা দিয়েছে। অথচ শামীম এই অল্পবয়সে যে প্রজ্ঞা অর্জন করেছে, তার ধারে কাছে পৌঁছাতে সুপারকপ ও ছাত্রলীগকে আবার জন্মাতে হবে। মুক্তিযুদ্ধের পরেও ঠিক এমনি হয়েছিল, মতাদর্শের অন্ধ ষাঁড়েরা কাউকে ঈর্ষা হলেই তাকে রাজাকার তকমা লাগানোর ব্যর্থ চেষ্টা করেছে। ভাল ক্যালিবারের লোকেরা ঠিকই বাংলাদেশ গড়ার কাজে ফিরে গেছে। আর মতাদর্শের অন্ধ ষাঁড়েরা গুঁতাগুতি করে দেশলুণ্ঠন করে ভারতের কোলাবরেটরহুড বরণ করে ক্ষমতার চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের জন্য কোঁদাকুঁদি করেছে।
শামীমের প্রতিটি বক্তব্য শুনলে বোঝা যায়; সে রাজনীতি সচেতন; কিন্তু দলীয় কোঁদাকুঁদির কাদাকুস্তিতে নামার ছেলে নয় সে। যে আওয়ামী লীগ-বাম-বিএনপি-জামায়াত মিলে দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকে দলীয় ফুটসোলজার বানানোর কারখানায় রুপান্তর করেছে; সেখানে দাঁড়িয়ে শামীম শিক্ষাভিত্তিক বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বপ্ন দেখেছে।
বাংলাদেশে একাডেমিক এক্সেলেন্স সবচেয়ে বড় অপরাধ। এখানে জ্ঞানভিত্তিক সমাজ বিনির্মাণের স্বপ্ন ঘৃণিত। কারণ দেশটাকে শিক্ষাহীনতার অন্ধকারে নিমজ্জিত রেখে পরিবারতন্ত্র ও অন্ধ মতাদর্শ তাদের ফুট সোলজার ও গলাবাজদের দিয়ে রাজনীতির নামে জমিদারি ব্যবস্থা জারি রাখতে চায়। বিশ্ববিদ্যালয়ে আদুভাই পুষে তাদের দিয়ে ক্ষমতার পালাবদলের গ্লাডিয়েটরে রক্তের হোলি দেখা বাংলাদেশের শীর্ষ নেতৃত্বের শখ। মরলে শোকাহত পিতা-মাতাকে একটা চেক ধরিয়ে দেওয়া; বাঁচলে লুন্ঠনের লাইসেন্স দিয়ে বলা, যা করে খাগে যা।
অন্ধ মতাদর্শের স্বপ্নের দৈর্ঘ্য সরকারি পদ-পদক-প্লট, গাড়ি-বাড়ি-ভুঁড়ি; তাই আশি-নব্বইয়ের দশকে যারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শ্রেণীহীন সমাজের কথা বলেছে; তারাই পরে দরিদ্র দাড়ি-টুপি নিমূর্লের রাজনীতি করে দশ ফুট বাই দশফুট টিনের ছাপরা থেকে অভিজাত এলাকার দালানে উঠেছে; যারা বাঙালি জাতীয়তাবাদ শিখিয়েছে তারা মানবতাবিরোধী অপরাধ করে ভারতে পালিয়েছে; যারা বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ শিখিয়েছিল তারা হাওয়া ভবনে রাষ্ট্রের মধ্যে রাষ্ট্র হয়ে উঠেছিল। সেইসব অন্ধ মতাদর্শের একবিংশ সংস্করণেরা পট পরিবর্তনের পরে সবাই মিলে পটে টান দিয়ে বলছে, এক টানেতে যেমন তেমন দু'টানেতে রোগী, তিন টানেতে রাজা উজির চার টানেতে সুখী।
শিক্ষা-মেধা ও যোগ্যতার আজন্ম ঈর্ষা এই মিডিওকার জন্মান্ধ গান্ধা কইরা দিমু'র দলের। শ্রেণী শত্রু চিহ্নিত করার নামে শত বছর ধরে এরা মিডিওক্রেসির ফুল'স প্যারাডাইস নির্মাণ করছে। এরা সংঘবদ্ধভাবে কালচারাল ফ্যাসিজমের এস্টাবলিশমেন্ট।
শেখ হাসিনার নিষ্ঠুর ফ্যাসিজমকালে ক্রসফায়ার, গুম, কারানির্যাতনে প্রাণ দিয়েছে সাধারণ মানুষ। বাংলাদেশে ভারতের ফ্যাসিস্ট শাসক মোদির ছায়া উপনিবেশ সফরের প্রতিবাদ জানাতে গিয়ে মাদ্রাসা পড়ুয়া প্রায় ১৭ জন কিশোর-তরুণ নিহত হয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিবাদীরা ছাত্রলীগের পিটুনি খেয়েছে। ঢাকা মেডিকেল কলেজে প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে ছেড়ে দেওয়া গেছে তাদের।
পরিস্থিতিটাই এমন ছিল যেখানে ফ্যাসিস্টদের অঙ্গুলি হেলনে ঢাকা ইউনিভার্সিটির সূর্য উদিত হয়েছে ও অস্ত গেছে। সেখানে গণরুমে নির্যাতনের ভয়ে সাধারণ ছাত্রদের ছাত্রলীগের শ্লোগান দিতে হয়েছে। সংস্কৃতি মামারা ডাকলে তাদের পেলব আসরে যেতে হয়েছে, কাউকে কাউকে ছাত্রলীগে লুকাতে হয়েছে, কেউ কেউ কুসুম প্রতিবাদ করেছে; যেখানে আহত হলে প্রাথমিক চিকিৎসার পরে ছাড়া পেতে পারে। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন দানা বাঁধবার আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এমন কোনো বাহুবলী ছিল না; যারা এখন এসে তারা একাই বীর বলে নিজেকে দাবি করতে পারে। তবে এভাবেই এদের করে কম্মে খেতে হবে। সৃষ্টিকর্তা সে মেধা-যোগ্যতা ও দক্ষতা দেয়নি যে সততার অন্নটুকু জোটাবে। গলাবাজি করে, মেধাবীদের খারিজ করে, দলীয় গ্যাটিস নিয়ে এদের জীবন নির্বাহ করতে হবে। এটাই বাংলাদেশের একমাত্র লাভজনক পেশা।
সুতরাং শামীমের মেধা-যোগ্যতা ও দক্ষতাকে গান্ধা করে দেওয়া যাক সুপারকপের সঙ্গে সখ্যের এভারেস্টসম অভিযোগ তুলে। ঠিকঠাক শিক্ষিত, পড়ালেখা শক্তপোক্তভাবে শিখে বড় হওয়া ছাত্র-ছাত্রীদের খারিজ না করা গেলে ফাঁকিবাজ ছাত্র, ইনডেক্স মুখস্থ করা জ্ঞানে আঁতেল সাজা মতান্ধ বুদ্ধিজীবী, দলীয় ফুটসোলজারেরা কী করে করে-কম্মে খাবে এ সমাজে!
পাঠকের মন্তব্য