জুলাই বিপ্লবে যে রিক্সাচালক, হকার, মেহনতি মানুষ বৈষম্যবিরোধী ছাত্রদের সঙ্গে ফ্যাসিজমবিরোধী যুদ্ধে অংশ নিলেন; ঠিক ঐ রকম মেহনতি মানুষেরা মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন। জুলাই বিপ্লবে যে মা জুলাই-যোদ্ধাদের মুখে খাবার তুলে দিয়েছিলেন; ঐ রকম মায়েরাই মুক্তিযোদ্ধাদের মুখে খাবার তুলে দিয়েছিলেন; জুলাই বিপ্লবে জননী সাহসিকা যেভাবে ছেলেকে দেশের জন্য প্রাণ দিতে পাঠালেন; মুক্তিযুদ্ধে জননী সাহসিকা ঠিক ঐভাবে সন্তানকে দেশের জন্য প্রাণ দিতে পাঠিয়েছিলেন।
বৃটিশবিরোধী আন্দোলন, পাকিস্তানবিরোধী মুক্তিযুদ্ধে প্রাণ দিয়েছেন বাংলাদেশের ছোটোখাটো মানুষের ঈশ্বরেরা। আর শার্ট-প্যান্ট পরা, একটু শিক্ষিতরা দু'চারটি শ্লোগান নিয়ে; রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের সুফল কুড়িয়েছে। ছাপরা থেকে দালান তুলে এরপর অন্যদের ছাপড়ি বলেছে। ভিক্ষুক পিতাকে হজ্জ্ব করিয়ে তাকে সম্ভ্রান্ত মুসলিম সাজিয়ে এরপর অন্যদের ফকিন্নি বলেছে। আয়নার সামনে বসে মেকআপ চর্চিত হয়ে নিজের ডাকাত চেহারাকে পেলব করে অন্যদের ডাকাত ডেকেছে। বৃটিশ-পাকিস্তানের ভ্যাগাবন্ডেরা কলোনিয়াল মাস্টার সেজে যাদের ছোটলোক বলে তুচ্ছ করেছে; তারাই স্বাধীন বাংলাদেশের ভ্যাগাবন্ড রুলিং এলিট সেজে অন্যদের ছোটলোক বলেছে।
বৃটিশ আমলে হরিপদ কেরানি ও ভাট্টি সেরেস্তাদার জমিদার হয়ে উঠে যেরকম কাল্পনিক আর্য হয়ে উঠেছিল; পাকিস্তান আমলে রেললাইনের ধারে প্রাতঃক্রিয়ার লোকেরা যেভাবে রাতারাতি রুলিং এলিট হয়ে কমোডে বসতে শিখেছিলো; স্বাধীন বাংলাদেশেও তেমনি রাতারাতি সবুজ লুঙ্গি ও দাঁতপাড় শাড়ি খুলে জোড়াসাঁকোর ঠাকুর বাড়ির পোশাক পরে বিরাট অভিজাত সমাজ গড়ে তোলে। ভুলে যায় নিজের পূর্বপুরুষের কৃষক জীবনের কথা। কথায় কথায় লোকজনকে ক্ষ্যাত বলতে শেখে তারা।
কোট-টাই পরে, চোখে কাজল দিয়ে তারা টিভি টকশোতে বসে এমন করে সারাদেশের মানুষকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করে; দেখে মনে হয় তারা বৃটিশ ও সুইডিশ রাজবংশের নীল রক্ত বহন করছে শরীরে।
আশির দশকে ফকিন্নি তকমা ঘুচাতে ছেলে-মেয়েরা আওয়ামী লীগের কালচারাল উইং-এ যোগ দেয়। আওয়ামী কালচারাল উইং আর কিছু নয়; কলকাতায় হরিপদ কেরানির ছেলেমেয়ে যেভাবে নদীয়ার আঞ্চলিক ভাষা রপ্ত করে, কবিতা আবৃত্তি করা শেখে, টুকটাক কবিতা লিখতে শেখে; তারপর বিরাট অভিজাত হয়ে উঠে অন্যদের নিম্নবর্গের বলে তকমা দেয়া শেখে। কল্পনায় সে আর্য হয়ে ওঠে। একইভাবে ঢাকায় গেদু মিয়ার ছেলে-মেয়ে জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবারের মতো পোশাক পরে অকস্মাৎ গম্ভীর হয়ে যায়। আভিজাত্যের কাল্পনিক অহমে অন্যকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করা অভিধান রচনায় বসে পড়ে। ওদিকে লাহোরে ভাট্টি সেরেস্তাদারের ছেলে মুঘল কস্টিউম পরে গজল শোনে, কোবতে পাঠের আসর করে; আর কাল্পনিক আর্য অহমে সবাইকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করতে শেখে। কৃত্রিমভাবে আভিজাত্য নির্মাণের এইসব ব্যর্থ চেষ্টাকেই এরা সংস্কৃতি চর্চা বলে মনে করে।
গোটা পৃথিবী যেখানে অচল শ্রেণীপ্রথা, অসাড় আভিজাত্যের ফাঁপা অহমকে আউটডেটেড বুঝে একটা সহজাত সমাজ নির্মাণে সক্রিয় ; পাবলিক ট্রান্সপোর্টে কমলা পোশাক পরা শ্রমিক ও বড় কোম্পানির সিইও পাশাপাশি গল্প করতে করতে ভ্রমণ করেন; দক্ষিণ এশিয়ার সমাজগুলো সেখানে নতুন করে শ্রেণীপ্রথা তৈরি করে; হিন্দু ধর্মের শ্রেণীপ্রথা ও ইসলাম ধর্মের আশরাফ-আতরাফ ব্যবধানের অস্থিধারণ করে।
জুলাই বিপ্লবটি বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন থেকে সূচিত। এর মাঝে সাম্যভিত্তিক সমাজ গঠনের দৃঢ় প্রত্যয় রয়েছে। এ কারণে এই বিপ্লব দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশের তারুণ্যের মাঝে উদ্দীপনা তৈরি করেছে। কারণ আজকের বিশ্বের প্রতিটি তরুণ একজন বিশ্বনাগরিক। সে যখন দেখছে বিশ্বে গণতান্ত্রিক কল্যাণরাষ্ট্রগুলোতে সমাজ মানসে সাম্যের চর্চা রয়েছে; সে কেন দক্ষিণ এশিয়ার পিছিয়ে পড়া সমাজের জাঢ্য-জরদগব শ্রেণীপ্রথার কুষ্ঠ মেনে নেবে।
পৃথিবীতে সম্পদের কাঙ্ক্ষিত সুষম বণ্টন সম্ভব নয়। কেউ সম্পদে ধনী কিন্তু ভালোবাসায় গরীব; কেউ ভালোবাসায় ধনী কিন্তু সম্পদে গরীব । কিন্তু প্রতিটি মানুষ সমান মর্যাদা লাভ করবে; সমাজ হতে হবে পারস্পরিক সম্মানের। কাজেই রাজনৈতিক পট পরিবর্তনে ও দুর্নীতি বসন্তে আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ হয়ে ওঠা নতুন ধনী কিংবা কলকাতার সাংস্কৃতিক আভিজাত্যের যাত্রাপালা দেখে শেখা ঢাকার কালচারাল আভিজাত্যের আলকাপ নৃত্যকে তো বিন্দুমাত্র পাত্তা দেওয়ার দরকার নাই। এরা হচ্ছে প্রদর্শনবাদীতার ভাঁড়।
কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে ধীরে ধীরে সামাজিক গতিশীলতা ঘটে পৃথিবীর অধিকাংশ সমাজে। কিন্তু বাংলাদেশে ১৯৪৬ সালে যে কুঁড়েঘরে বসবাস করত, ১৯৪৮ সালে সে উচ্ছেদ হয়ে যাওয়া হিন্দুর দালান দখল করে রাতারাতি বুর্জোয়া হয়েছে; ১৯৭০ সালে যে পাতলা খান লেনে টিনশেডে বসবাস করত ১৯৭২ সালে সে ধানমণ্ডি থেকে উচ্ছেদ হয়ে যাওয়া অবাঙ্গালির দালান দখল রাতারাতি অভিজাত এলাকার বাসিন্দা হয়েছে। এরপর রহমান অ্যান্ড রহমান কোম্পানির কোটাল পুত্র হতে দেশের নানা প্রান্ত থেকে ৩৫ টাকা নিয়ে ছুটে আসা বাচ্চু-কাচ্চু-লালু-দুলু বাংলাদেশ লুণ্ঠন করে গাড়ি-বাড়ি-ভুঁড়ি-নারী হাসিল করেছে। দেশের সম্পদ বিদেশে পাচার করে সেকেন্ড হোম গড়েছে। আবার ধর্মের নামে রাজনীতি করে দাঁড়িপাল্লা ভরে সোনার মোহর তুলেছে ধর্ম মামা।
এটা খুব অদ্ভুত সমাজ। এখানে রাজনীতি ধর্মের মতো আবার ধর্ম রাজনীতির মতো করে চর্চিত। মুয়াজ্জিনের নাতনি কালচারাল উইং হয়ে প্রতিদিন দাড়ি-টুপিওয়ালা নিয়ে হাসাহাসি করে। সংশয়বাদীর নাতি রেলিজিয়াস উইং হয়ে শ্লাট-শেমিং করে বেড়ায়। মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস ঢাকায় আরামে থাকা পরিবারের ছেলে চেতনা সৈনিক হয়ে; মুক্তিযুদ্ধে শহীদ, শরণার্থী পরিবারের ছেলেদের ‘রাজাকার’ তকমা দেয়। বৃটিশের এঁকে যাওয়া বিভাজনের বিষবৃক্ষের নীচে দাঁড়িয়ে একবিংশের হিন্দু তরুণ মুসলিম তরুণকে পাকিস্তানি বলে; মুসলিম ছেলে হিন্দু ছেলেকে ভারতীয় বলে। আর দুঃখিনী মায়ের কষ্টার্জিত উপার্জনে ছেলেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানোর পর সে সাংবাদিক হয়ে, অন্যদের বান্দির পুত বলে ডাকে। আরেকজন মানুষকে তকমা দেয়া আর রায় বা অনুসিদ্ধান্ত দিয়ে কথা বলার মাঝ দিয়ে ইনফেরিয়রের সুপিরিয়র সাজার প্রাণান্ত চেষ্টা চারপাশে।
এরকম সামাজিক বিশৃঙ্খলার দেশ পৃথিবীতে আর একটাও নেই। যেখানে ইনফেরিয়রের সুপিরিয়র সাজাই জীবনের লক্ষ্য। এক একজন নিজেকে এমন বিশুদ্ধ দাবী করে অন্যের সম্পর্কে কথা বলে যে, সেরকম বিশুদ্ধ মানুষ কেবল কল্পনাতেই উপস্থিত। নিজেকে জানার পরিবর্তে অন্যকে জানাই এই বিষাক্ত সমাজের একমাত্র কাজ।
একটি রাষ্ট্র কল্যাণরাষ্ট্র না হতে পারলে সেটি কোনো রাষ্ট্রই নয়। শত শত বছরের রক্ত ও ত্যাগের মাধ্যমে অর্জিত স্বাধীন বাংলাদেশের ৫৪ বছর নষ্ট হয়েছে অন্ধ মতাদর্শের জুয়াঘরে শিং ঘষাঘষি করে। ডান-বাম, আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জামায়াত; এসবই রাজনীতির লিপসার্ভিস দিয়ে আখের গোছানোর ছল। রাজনৈতিক, আমলা, ব্যবসায়ী, ধর্ম-মোল্লা, প্রগতি পুরোহিত মিলে দেশটাকে খুবলে খাওয়ার লাশকাটা ঘর আমাদের মাতৃভূমি। এই অচল চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের অবসান না ঘটানো গেলে; বাংলাদেশ একই দুষ্টচক্রে ঘুরপাক খাবে।
পাঠকের মন্তব্য