হিটলারের পতনের পর জার্মানির সমাজে ডিনাযিফিকেশন করা হয়েছিলো। এতে করে জার্মানির সমাজে হিটলার ও নাতসিদের মানবতাবিরোধী অপরাধ সম্পর্কে জনসচেতনতা তৈরি হয়েছিলো। তারা বুঝেছিলো উন্নয়নের নামে কোন স্বৈরাচার উত্থিত হলে; আর স্বৈরাচার টিকিয়ে রাখতে মানবতাবিরোধী অপরাধ করলে; তা সমাজের উত্তরণকে আটকে রাখে।
হাসিনার পতনের পর একবছর অতিবাহিত হয়েছে। কিন্তু সমাজে কোনো ডিআওয়ামিফিকেশন ঘটেনি। ফলে বাংলাদেশ আশানুরুপ স্থিতিশীলতা অর্জন করতে পারেনি। ডিআওয়ামী ফিকেশন না ঘটায়; ফ্যাসিজম সম্পর্কে সচেতনতা তৈরি হয়নি। সে কারণেই অপ্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপির ছায়াতলে জড়ো হয়েছে বসন্তের কোকিলেরা। তারা জ্যোতিষীর ঢঙ্গে বলে বেড়াচ্ছে, বিএনপি অন্তত তিনটি টার্ম ক্ষমতায় থাকবে। পনেরো বছরের জন্য জীবন নিশ্চিত হবে এই আশায় নাগরিক সমাজ, পুলিশ, প্রশাসন, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকের একটি অংশ বিএনপির সঙ্গে ঘন হচ্ছে।
বিএনপির সঙ্গে কতটা ঘন হতে পেরেছে তা প্রমাণে কতিপয় সোশ্যাল ইনফ্লুয়েন্সার জুলাই বিপ্লবীদের ছিদ্রান্বেষণে আদাজল খেয়ে লেগেছে। এই বয়স্ক ইনফ্লুয়েন্সাররা বয়সে নবীন জুলাই বিপ্লবীদের ব্যাপারে ঈর্ষান্বিত। পেলোপনেশিয়ান যুদ্ধের যোদ্ধা থুসিডাইসিস যেভাবে নিজহাতে ইতিহাস লিখেছেন; জুলাই বিপ্লবীরা ঠিক সেইভাবে জুলাই বিপ্লবে নিজ নিজ হাতে ইতিহাস লিখেছে। কিন্তু বয়েসী ইনফ্লুয়েন্সাররা অন ক্যামেরা ঘটে যাওয়া একটি বিপ্লবের ‘পেছনের গল্প’ নিয়ে হাজির হবার ভান করে; কৃতিত্ব বিতরণী সভার আয়োজন করেছে। বয়েসী লোকেরা জুলাই বিপ্লবীদের মাঝে ক্রেডিট গোজ টু হুম টাইপের ইঁদুর দৌড় সৃষ্টি করে বিভাজন ও বিদ্বেষের ছক কষেছে।
পৃথিবীর বিপ্লব ও অভ্যুত্থানের ইতিহাসে বাংলাদেশের জুলাই বিপ্লব একমাত্র বিপ্লব যা অন ক্যামেরা ঘটেছে; সোশ্যাল মিডিয়ার যুগে এই বিপ্লবের প্রতি সেকেন্ড ঘটেছে জনমানুষের সামনে। বৈষম্য বিরোধী ছাত্রদের আহবানে সাড়া দিয়ে জনতা পথে নেমেছে; ফ্যাসিস্ট বিরোধী প্রতিবাদ ও প্রতিরোধে জীবন দিয়েছে।
কিন্তু ঐ যে মুক্তিযুদ্ধে সম্মুখ সমরে না গিয়ে; আরামে পাকিস্তান সরকারের চাকরি করা আত্মীয়ের বাড়িতে লুকিয়ে থেকে; তারপর ১৬ ডিসেম্বর সিক্সটিন্থ ডিভিশন হিসেবে বেরিয়ে এসে; মুক্তিযুদ্ধ গবেষক ও ইতিহাসবিদ হয়ে যেমন জাতিকে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষ-বিপক্ষ শক্তিতে বিভাজিত করে বিদ্বেষের ব্যবসা চালিয়ে যাবার কালো ঐতিহ্য; তারই ধারাবাহিকতায় আরামে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কক্ষে বসে কৃত্রিম উত্তেজনায় ঘাম ঝরিয়ে, ৬ অগাস্ট হাজির হয়ে যায় বিপ্লবের আদু ভাইয়েরা; যারা নিজেরা একটা অথোরিটি ক্রিয়েট করে; জুলাই বিপ্লবী তরুণদের কার কতটুকু কৃতিত্ব তা বাটখারা দিয়ে মাপামাপি করতে থাকে। আবার সেই বিভাজন সৃষ্টি করে বিএনপির তিনটি টার্ম আর রিফাইন্ড লীগের ফিরে আসার কারিগর এসব আদু ভাই।
এদের খুব বিশিষ্ট নাগরিক হবার শখ। বয়সকালে এক্সপোজার না পেয়ে প্রৌঢ়ত্বে এসে বিলম্বিত যৌবনের অস্থিরতা এদের। এদের যেরকম আক্রোশ জুলাই বিপ্লবী তারুণ্যের প্রতি; তা ঈর্ষা ও ইনফেরিয়রিটি কমপ্লেক্সজাত সুপিরিওরিটির প্রকাশ।
জুলাই বিপ্লবীদের বয়স সবারই প্রায় তিরিশের নীচে; এরা হঠাত করে আন্দোলনে আসেনি। নিরাপদ সড়ক আন্দোলন, ২০১৮-র কোটাবিরোধী আন্দোলন, পাঠচক্র, বিতর্ক চর্চার মাঝ দিয়ে প্রস্তুতি নিয়ে অবশেষে চব্বিশের জুলাই বিপ্লবে চূড়ান্ত লক্ষ্যে পৌঁছেছে।
এই লক্ষ্য স্বৈরাচারমুক্ত বৈষম্যহীন কল্যাণ রাষ্ট্র ও সভ্য সমাজ। গোটা দুনিয়ার প্রগতিশীল ও ইসলামপন্থী সম্পর্কে এরা স্পষ্ট ধারণা পেয়েছে ইন্টারনেটের মাধ্যমে। বাংলাদেশ সমাজের মতো কট্টর প্রগতিশীল ও কট্টর ইসলামপন্থী তারা পৃথিবীর কোথাও দেখেনি। তাই তো তারা অন্তর্ভুক্তিমূলক স্বাভাবিক সমাজের স্বপ্ন দেখেছে। এরা বাংলাদেশের পশ্চাদপদ ভি আইপি সিস্টেমের অবসান চেয়েছে। বুয়েটের ছাত্র আবরার হত্যাকাণ্ডের পর থেকে দেশের সার্বভৌমত্ব ফিরে পাবার স্বপ্ন দেখেছে। ফলে তারা দিল্লির ক্ষমতাকাঠামোর হেজিমনিকে চ্যালেঞ্জ করেছে। আর এক্ষেত্রে চব্বিশের জুলাই-এ ভারতের বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদের বন্ধুত্বপূর্ণ সমর্থন পেয়েছে তারা।
আসলে চিন্তার জগতে পিছিয়ে থাকা লোকগুলো জুলাই বিপ্লবীদের মনস্তত্ব বুঝতেই পারেনি। নিজেদের ছেলে মেয়েদের পশ্চিমের বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়িয়ে বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের দলীয় ফুট সোলজার বানানোর যে অর্ধশত বছরের আদিমতা; তার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়েছে জুলাই বিপ্লবীরা।
ফলে ধর্ম ও সংস্কৃতি নিয়ে ব্যবসা করা স্বার্থপর লোকগুলো জুলাই পরবর্তী সমাজে অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়েছে। তাই তো তারা জুলাই তরুণদের মাঝে বিভাজন সৃষ্টি করে তাদের শতবর্ষের বিভাজন ও বিদ্বেষের ব্যবসাটা চালু রাখতে চায়।
বাংলাদেশের দলীয় প্রবীণ ও প্রৌঢ়দের অভিজ্ঞতা মানে ব্যর্থ সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থা। সুতরাং তাদের অভিজ্ঞতা নবীনদের প্রয়োজন নেই। বরং সেই অভিজ্ঞতা থেকে দূরে থাকাই সফলতার পথ।
যেসব লোক গত জুলাইয়ে প্রোপিক লাল করবো নাকি কালো করবো, একটা স্কেচ আঁকলে কি বেশি বিপদ হবে, নয় দফা ঠিক আছে, কিন্তু একদফায় নেই ইত্যাদি তবে কিন্তু করেছিলো; তার চেয়ে পথে নেমে আসা প্রবীণ, প্রৌঢ় শ্রমজীবী মানুষ, জননী সাহসিকারা অনেক ঋজুতার সঙ্গে বিপ্লবী তরুণদের পাশে দাঁড়িয়েছিলো।
কাজেই জুলাই বিপ্লবীদের চাণক্য বৃদ্ধ ও ম্যাকিয়াভেলি প্রৌঢ়দের কাছ খুব সাবধান থাকতে হবে। এরা আওয়ামী লীগ ও বিএনপির পাওয়ার করিডোরের ওম নিয়ে রুলিং এলিট সেজে থাকতে পছন্দ করে। এরা বৈষম্যমুক্ত সমাজের শত্রু। এরা চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের অনুকরণে ভি আই পি কালচার লালনের সারিন্দা।
পিংক ফ্লয়েডের ‘উই ডোন্ট নিড নো এডুকেশন’ সংগীতে কিশোর ছাত্রের প্রতি নিষ্ঠুর যে শিক্ষককে আমরা দেখি, ফ্রানয কাফকার "মেটামরফসিস" নভেল্লাতে তরুণ গ্রেগর সামসার প্রতি যে আক্রোশ দেখি তার পিতার মাঝে; জুলাই বিপ্লবের পর পুরোনো রাজনৈতিক ব্যবস্থা ও ভি আই পি কালচারের প্রবীণ ও প্রৌঢ়ের মাঝে ঠিক সেরকম আক্রোশ ও নিষ্ঠুরতা দেখেছি জুলাই বিপ্লবীদের প্রতি। এই পুরোনো চিন্তার মানুষদের প্রতি কোন পরামর্শ রেখে লাভ নেই; কারণ তারা ক্রিস্টোফার মার্লোর নাটকের ড ফস্টাসের মতো পণ্ডিতন্মন্য লোকজন; যাদের মস্তিষ্কে মেফিস্টোফিলিসের আনাগোণা।
তাই জুলাই বিপ্লবীদের প্রতি পরামর্শ রাখি, নিজেদের মধ্যে মতবিরোধ বিতর্ক ও সংলাপের মাধ্যমে সমাধানের চেষ্টা করতে হবে। এখানে পুরোনো চিন্তার লোকেদের বিভাজনের উস্কানির ফাঁদে কোনভাবেই পা দেয়া যাবে না। কারণ বহুত্ববাদী কল্যাণরাষ্ট্র গড়ার স্বপ্ন সফল করতে পারলে তবেই জুলাই বিপ্লব সফল বলে সুচিহ্নিত হবে ইতিহাসে। বৈষম্যের জগদ্দল পাথরের বিপরীতে ঐক্যের আলোক সরণি তৈরিই এই বিপ্লবের গন্তব্য।
পাঠকের মন্তব্য