টাকের কর্নেল (চতুর্থ পর্ব)

২৫ পঠিত ... ৯ ঘন্টা ২৭ মিনিট আগে

প্রত্যুষে ঘুম থেকে জেগে অধ্যাপক কর্নেল কলিমুল্লাহ ড্রাইকেক খেতে খেতে ছোট কটা টুকরো ছিটিয়ে দেন জানালার কার্নিশে। কয়েকটা চড়ুই পাখি এসে ঠোকরাতে থাকে সেগুলো। এই অপরুপ দৃশ্য দেখে রবীন্দ্র ভাব জেগে ওঠে তার মাঝে। তিনি আবৃত্তি করেন,

তবু তুমি একবার খুলিয়া দক্ষিণদ্বার

বসি বাতায়নে

সুদূর দিগন্তে চাহি কল্পনায় অবগাহি

ভেবে দেখো মনে–

হঠাত গলা খাকারি দিয়ে লম্বা করে সালাম দিয়ে দরজার কাছে দাঁড়িয়ে প্রবেশের অনুমতি প্রার্থনা করেন ওলামায়ে কেরাম শরিয়তুল্লাহ।

অধ্যাপক কর্নেল মনে মনে বলেন, দক্ষিণদ্বারের কথা বলতেই দক্ষিণপন্থী হাজির হয়েছেন।

–আসুন আসুন মৌলভি মহোদয়।

–উপাচার্য মহোদয় আমি শরিয়তুল্লাহ; সেই নরেন্দ্র মোদীর আগমনের প্রতিবাদ করতে গিয়ে গ্রেফতার হয়েছি, আজো জামিন হলো না।

–এতো ভারী অন্যায় হয়েছে আপনার সঙ্গে শরিয়ত মহোদয়।

–স্যার জেলখানায় আপনার ওয়াজের প্রশংসা সবার মুখে। আজ বাদ আসর যদি মসজিদে একটু আসেন; ধর্মপ্রাণ মানুষেরা আপনার কথা শুনতে চায় জনাব।

–নিশ্চয়ই। আমি স্পিরিচুয়ালিটির দিকটিকে খুব গুরুত্ব দিই। মওলানা রুমি যেরকম প্রতি প্রত্যুষে কবুতরদের সঙ্গে ব্রেকফাস্ট করতেন; আমিও চেষ্টা করি পাখিদের নিয়ে সকালের নাশতা করতে।

শরিয়তুল্লাহ লুকিয়ে অশ্রু মোছেন। দুই হাত দিয়ে মুসাবিদা করে বিদায় নেন।

তিনি বেরিয়ে যেতেই প্রবেশ করেন রাশেদ খান মেনন। অধ্যাপক কর্নেল মনে মনে বলেন, দক্ষিণপন্থী বেরিয়ে যেতেই উত্তরপন্থীর আগমন। মেনন বলেন, কি ব্যাপার আপনার কাছে ডানপন্থীদের আনাগোণা লক্ষ্য করছি।

অধ্যাপক উত্তর দেন,

উড়ায়ে চঞ্চল পাখা পুষ্পরেণুগন্ধমাখা

দক্ষিণসমীর–

সহসা আসিয়া ত্বরা রাঙায়ে দিয়েছে ধরা

যৌবনের রাগে

মেনন হাসতে হাসতে বলেন, রবীন্দ্রনাথ দক্ষিণপন্থী ছিলেন নাকি! আলখাল্লা টুপি পরতেন আবার দক্ষিণ সমীর, দক্ষিণ দুয়ার নিয়ে বড্ড আকুল ছিলেন।

–টিএসএলিয়টও সেদিক থেকে দক্ষিণপন্থী ছিলেন। বিশুদ্ধতাবাদী এক কবি। খ্রিস্টিয়ানিটি প্রতিপালনে তার কোন রাখ ঢাক ছিলো না। রবীন্দ্রনাথের গোরা উপন্যাসে মুসলমানদের প্রতি যে দরদ আমরা দেখি; আবার মহানবীকে নিয়েও উচ্ছ্বসিত ছিলেন।

–লিও টলস্টয় রেলস্টেশনে অসুস্থ হয়ে মারা গেলে তার ওভারকোটের পকেটে কুরান পাওয়া গিয়েছিলো।

–আপনিও তো হজ্জ্ব করে এসেছেন।

–শেখ হাসিনা যখন মদিনা সনদের অধীনে দেশ চালাচ্ছিলেন, তখন মক্কা মদিনা দর্শন আমাদের কর্তব্য। উনি কওমি জননী হলে আমাদেরকেও একটু ধর্মে একটু জিরাফে থাকতে হয়েছে। তবে শুনলাম মির্জা ফখরুল বলেছেন, দেশ ড ইউনুসের অধীনে দক্ষিণপন্থার দিকে চলে গেছে। আজ রাতের ক্লাসে এ বিষয়ে একটু কথা বলবেন নাকি। সাম্রাজ্যবাদী আমেরিকার সঙ্গে ইউনুস এডমিনিস্ট্রেশনের ঢলাঢলিটাও মাত্রা ছাড়িয়েছে।

–নিশ্চয়ই মেনন মহোদয়। আজ সে বিষয়ে কথা বলবো।

বাদ আসর মসজিদে উপচে পড়া ভীড়। অধ্যাপক কর্নেল প্রবেশ করলে মুসল্লিরা করতালি দেয়। দরবেশ বের হয়ে যেতে যেতে বিড় বিড় করেন, যন্ত্রণাটা এখানেও এসেছে ভ্যাজর ভ্যাজর করতে।

অধ্যাপক কর্নেল তার বক্তব্য শুরু করেন, জুলাই বিপ্লবের পরে আপনাদের তো জেলখানায় থাকার কথা নয়। বিপ্লব হাতছাড়া হয়ে গেছে। যাত্রাবাড়ির লেনিনগ্রাদে তুর্কী তরুণেরা জীবন দিয়েছেন; অথচ সে বিপ্লব বৃথা গেলো। তাই আপনাদের আবার ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। ইরানের বিপ্লব থেকে অনুপ্রেরণা নিতে হবে।

ইরানের কথা শুনে মুসল্লীদের উচ্ছ্বাস না পেয়ে অধ্যাপক বলেন, আমি জানি ওরা শিয়া বলে আপনারা বিশেষ আগ্রহ পাননা; কিন্তু আত্মনির্ভরশীল দেশ গড়ে পৃথিবীতে দৃষ্টান্ত হয়েছে ইরান। ইজরাইলকে দাঁতভাঙ্গা জবাব দিয়েছে চাপিয়ে দেয়া যুদ্ধে। তাই আমার কথাটা ভেবে দেখবেন।

শরিয়তুল্লাহ ঘোষণা দেন, আমরা সফল হলে অধ্যাপক সাহেব আমাদের শিক্ষা মন্ত্রী হবেন। তিনি আমাদের সবার ওস্তাদ। আল্লাহ তাকে ইনকিলাবের পথে কবুল করুন।

একজন একটি খেজুর ভর্তি পাত্র মেলে ধরে অধ্যাপকের সামনে। তিনি বিসমিল্লাহ বলে খেজুরে কামড় দেন।

এরপর যা হয়, জেলখানার পথে পথে সবাই তাকে সালাম দেয়। একজনকে সালাম না দিতে দেখে অধ্যাপক অবাক হন, দাড়িওয়ালা লোক অথচ সালাম দিলোনা। পরে ভালো করে তাকিয়ে দেখেন আসাদুজ্জামান নূর। নূর মুচকি হেসে বলেন, আপনি তো মোল্লাদের হার্ট থ্রব হয়ে গেলেন?

–নূর মহোদয়, আমি শিক্ষক মানুষ; তাই কারো আমন্ত্রণ ফেলে দিতে পারিনা। এজন্যই বলা হয়, ওস্তাদে প্রণাম করো পিতা হন্তে বাড়ো। চলুন এবার নৈশক্লাসে যাই।

আসাদুজ্জামান নূর হাসিনার পনেরো বছর, নূরলদীনের কথা মনে পড়ে যায় কবিতার লাইনগুলো বলতে পারেননি। কারণ তখন সবাইকে ঘুম পাড়িয়ে রাখার জন্য সমস্ত সংস্কৃতি কর্ম নিবেদিত ছিলো। তাই ক্লাসের শুরুতেই তিনি বলে ওঠেন,

 অভাগা মানুষ যেন জেগে ওঠে আবার এ আশায়

যে, আবার নূরলদীন একদিন আসিবে বাংলায়,

আবার নূরলদীন একদিন কাল পূর্ণিমায়

দিবে ডাক, “জাগো, বাহে, কোনঠে সবায়?”

আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা করতালিতে ফেটে পড়ে। অধ্যাপক কর্নেল বলেন, আজ বড্ড মন খারাপ নিয়ে আপনাদের সামনে উপস্থিত হয়েছি। বাংলাদেশ এখন দক্ষিণ পন্থার হাতে জিম্মি। তাই আবার মুক্তিযুদ্ধে যেতে হবে আমাদের। আমার মাটি আমার মা পাকিস্তান হবে না। সাম্রাজ্যবাদের দাস হবার জন্য আমাদের জন্ম হয়নি। সাম্রাজ্যবাদী আমেরিকাকে আমরা স্বামী হিসেবে চাইনা। স্বামী হিসেবে পছন্দ ভারতকে। এমেরিকান ধলা সাহেবের জন্য সেজে গুজে নাচবো না। আমরা ভারতের ঘনশ্যাম স্বামীর বাঁশীর সুরে নাচবো।

মোজাম্মেল বাবু আর্তনাদ করে ওঠেন, জয় বাংলা জয় হিন্দ। রাধার মতো লাজুক চোখে তাকান শ্যামল দত্ত।

পুনশ্চঃ  অতীতে সফদার ডাক্তার মাথা ভরা টাক তার, ক্ষিদে পেলে পানি খায় চিবিয়ের যুগে; টাক ছিলো খানিকটা হাসাহাসির পাত্র। কিন্তু সমকালে পশ্চিমে হেয়ার ডু হিসেবে হেড শেভিং খুব স্টাইলিশ ফ্যাশান হিসেবে সমাদৃত। হলিউডের সুদর্শন অভিনেতা কেভিন কস্টনার থেকে জেসন স্ট্যাথাম, ভিন ডিজেল এই ফ্যাশানে নতুন মাত্রা এনেছেন। অনেক আগে টিভি সিরিজ কোজাকেও আমরা দেখেছি এই ফ্যাশানের শুরুটা। পশ্চিমা এই ফ্যাশান বাংলাদেশে প্রচলন করেছেন যারা, তাদের মধ্যে অধ্যাপক কর্ণেল কলিমুল্লাহ অন্যতম। এটা তার অগ্রসর চিন্তার সূচক।

(চলবে)

 

তৃতীয় পর্বের লিংক 

২৫ পঠিত ... ৯ ঘন্টা ২৭ মিনিট আগে

আরও

পাঠকের মন্তব্য

আইডিয়া

গল্প

সঙবাদ

সাক্ষাৎকারকি

স্যাটায়ার


Top