চার বছর বয়সী পুত্র বুলবুলকে বাঁচানোর জন্য কবি পাগলের মতো হয়ে গিয়েছিলেন।
বুলবুলের গুটিবসন্ত। দরিদ্র কবি ওষুধ-পথ্যের কমতি করলেন না। কিন্তু কোনো লাভ হলো না। বসন্তের দাপটে বুলবুলকে চেনা যায় না। একটি চোখও আক্রান্ত হলো ছোট্ট বুলবুলের। প্রায় অন্ধ বুলবুলের পাশেই সারাদিন বসে থাকেন কবি, অলৌকিক কিছু ঘটার আশায়।
কবি খবর পেলেন এক সাধুর কাছে নাকি সব রোগের ওষুধ আছে। সহচর মঈনুদ্দিনকে পাঠালেন ঐ সাধুকে নিয়ে আসার জন্য।
কিন্তু দুর্ভাগ্য, ঐ সাধুকে পাওয়া গেলো না। বিফল মঈনউদ্দিন ভারী পায়ে এসে দাঁড়ালেন কবি নজরুলের বাড়ির উঠানে। তাঁকে দেখে ছুটে আসলেন কবি। জড়িয়ে ধরে চিৎকার করে বলতে লাগলেন, ‘আচ্ছা, বলতে পারিস, সাধু মরা দেহে প্রাণ ফিরিয়ে আনতে পারেন কি না? বল্–বল্, তিনি কি মরা দেহে প্রাণ দিতে পারেন?’
মঈনউদ্দিন যা বুঝার বুঝে গেলেন। বুলবুল আর নেই!
ছোট্ট বুলবুল মোটরগাড়ি খুব পছন্দ করতো। গাড়ির আওয়াজ শুনলেই সে ঘর থেকে বাইরে দৌড় দিতো।
পুত্রশোকে কাতর পিতা পুত্র বুলবুলকে শেষবারের মতো গাড়িতে চড়ালেন। একটা গাড়িতে করে তাঁকে নিয়ে গেলেন কবরে।
প্রাণাধিক প্রিয় পুত্রকে হারিয়ে কবির বাকি জীবন হয়ে উঠে বেদনার এক মহা উপাখ্যান। প্রিয় বুলবুলের সাথে আর কখনও তাঁর দেখা হবে না, এই সত্য তিনি মেনেই নিতে পারেননি। কবি আধ্যাত্মিকতার দিকে ঝুঁকে পড়েন। কথিত আছে, কবি প্ল্যানচেটেরও আশ্রয়ও নিয়েছিলেন। একটাবার যদি প্রিয় বুলবুলের দেখা পাওয়া যায়। একটা বার... একটা বার...
প্রবল আকুতি নিয়ে কবি বলেছেন,
'তুই ফিরে এলে, ওরে চঞ্চল
আবার ফুটিবে বন ফুল–দল
ধূসর আকাশ হইবে সুনীল তোর চোখের চাওয়ায়।'
বুলবুল আর ফেরেনি। তার চোখের চাওয়ায় ধূসর আকাশও আর সুনীল হয়নি।
নিজেকে 'দাবানল-দাহ' দাবী করে পুরো বিশ্বকে দাহন করতে চাওয়া নজরুল বাকিটা জীবন পুত্রশোকেই দগ্ধ হয়ে গেছেন।
চির-দুরন্ত দুর্মদ কবি কাছের মানুষজন পেলেই জড়িয়ে ধরে কেঁদে কেঁদে বলতেন, 'আমার বুলবুলি উড়ে গেছে রে...'
শেষ জীবনটা নির্বাক কেটেছে নজরুলের। কথা বলতে পারতেন না। শুধু ঠোঁট নাড়তেন। চিকিৎসকরা অনেক কষ্ট করে ডায়াগনোসিস করেছিলেন, 'পিক ডিজিজ'।
অথচ চিকিৎসকদের আগেই নিজের নীরব হয়ে যাওয়ার কারণ লিখে রেখেছিলেন নজরুল,
'গানের পাখি গেছে উড়ে শূন্য নীড়
কণ্ঠে আমার নাই সে আগের কথার ভিড়
আলেয়ার এ আলোতে আর আসবে না কেউ কুল ভুলি।।
ঘুমিয়ে গেছে শ্রান্ত হয়ে আমার গানের বুলবুলি।'
বিষের বাঁশি, ভাঙার গান, প্রলয়শিখা তখন বাজেয়াপ্ত। কলকাতা পুলিশ তবুও হানা দিলো নজরুলের বাড়িতে। যদি বাজেয়াপ্ত করার মতো নতুন কিছু পাওয়া যায়। বাড়ি তল্লাশিতে নজরুল নিজেই সাহায্য করলেন পুলিশ সদস্যদের। কিন্তু একটা ছোট বাক্সের দিকে পুলিশের নজর যাওয়ামাত্র কবি পাগলপ্রায় হয়ে গেলেন। ঐ বাক্সের কাছেও ঘেঁষতে দেবেন না কাউকে তিনি।
নাছোড়বান্দা পুলিশ সদস্যরা বাক্সটি আনলেন এবং খুললেন। বেরিয়ে এলো ছোট শিশুর জামা ও খেলনা।
প্রিয় সন্তানের এই স্মৃতিগুলো পরম মমতায় আগলে রেখেছিলেন কবি। তরুণ পুলিশ সদস্য দেখলেন পিতা নজরুলের চোখে উথালপাতাল জলরাশি।
শুভ জন্মদিন, আমাদের দুখু মিয়া।
পাঠকের মন্তব্য
ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে
লগইন