'ছোট অপরাধ' ঢাকতে রেলমন্ত্রী টানা যেসব মিথ্যা বলে গেলেন

৩৪১ পঠিত ... ১৭:০১, মে ০৯, ২০২২

Rail-montri-mitthachar

রেলওয়ের টিটিকে বরখাস্ত করার ঘটনায় কী কী সমস্যা হয়েছে, তা আমরা সবাই কমবেশি বুঝতে পারি। খোলা চোখে দুইটা সমস্যা প্রকটভাবে ধরা পড়বে:

১. মন্ত্রীর আত্মীয় পরিচয় দিয়ে বিনা টিকেটে ট্রেনে ওঠা; ২. মন্ত্রীর স্ত্রীর ফোনে রেলের একজন কর্মচারির বরখাস্ত হওয়া।

মন্ত্রীর আত্মীয় পরিচয়ে ট্রেনে ওঠা তো বাংলাদেশের বিচারে অত্যন্ত মামুলী একটা ঘটনা। মন্ত্রীদের আত্মীয় পরিচয়ে বাংলাদেশে যে কী কী সম্ভব, তা আমরা সবাই বুঝি ও জানি। তাই দিন শেষে সবাই ভাববেন, একটু ট্রেনেই তো উঠেছে, আর তো কিছু না! ১০০ কোটি টাকা তো আর চুরি করে নাই (অবশ্য করলেও কিছু যায় আসতো না)। কিন্তু আপনি যদি এই ছোট্ট একটা কেলেঙ্কারির একটু গভীরে যান, তাহলেও দেখবেন যে বিষয়টা আসলে অত্যন্ত সিস্টেম্যাটিক।  

টিটির বরখাস্ত হওয়ার ঘটনা প্রথম আলোতে প্রকাশিত হওয়ার পরই মন্ত্রী একটা সংবাদ সম্মেলন করলেন। সেখানে তিনি সরাসরি অস্বীকার করে বললেন যে ট্রেনের আরোহীরা তার আত্মীয় নন; তিনি তাদেরকে চেনেনও না। টিটিকে বরখাস্ত করা হয়েছে যাত্রীর সাথে খারাপ আচরণের জন্য। মন্ত্রী আরও বলেছিলেন, যাত্রীর অভিযোগের ভিত্তিতেই টিটিকে বরখাস্ত করা হয়েছে।

এরই মধ্যে ফেসবুকের একটি পেইজের বরাতে আমরা ওই যাত্রীদের একটি অভিযোগ সম্বলিত চিঠি দেখতে পাই। সেখানে তারা বর্ণনা করেছেন কীভাবে টিটি তাদের সাথে খারাপ ব্যবহার করেছেন আর ঘুষ চেয়েছেন। বাংলাদেশে সরকারি সেবাগ্রহীতারা যে পদে পদে হয়রানির শিকার হন, তা আমরা সবাই জানি। ফলে মানুষও ভাবতে শুরু করলো, টিকেট ছাড়া তো বেশিরভাগ মানুষই ট্রেনে উঠে; তাই বলে এভাবে খারাপ ব্যবহার করতে হবে!  

কিন্তু আসল সমস্যাটি ধরতে পেরেছেন বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের ডেপুটি এডিটর মুবিন এস খান। তিনি এক কলামে লিখলেন যে, এই যাত্রীদ্বয় যদি মন্ত্রীর আত্মীয় না-ই হন, তাহলে তাদের অভিযোগের ভিত্তিতে এত দ্রুত তড়িৎগতিতে কীভাবে একজন টিটি বরখাস্ত হতে পারেন? বাংলাদেশে সরকারি সেবার বিষয়ে অভিযোগ জানিয়ে প্রতিকার পাওয়া গেছে, এরকম ঘটনা তো অমাবস্যার চাঁদের মতই বিরল। প্রথমত, কোন ফরমে, কোন ব্যাক্তিকে, কোথায়, কীভাবে অভিযোগ জানাতে হবে, সেটাই তো সাধারণ মানুষ জানে না! দ্বিতীয়ত, সেই অভিযোগ কার কাছে কোথায় জমা দিতে হবে, তা-ই জানতে গলদগর্ম। এরপর সেই অভিযোগ নিয়ে আদৌ কি কোনো তদন্ত হবে? তদন্ত হলে ব্যবস্থা নেয়া হবে? স্রেফ চিন্তা করুন যে, আপনার ওই অভিযোগ (আদৌ যদি কেউ আমলে নেয়) নিষ্পত্তি হতে কয় বছর বা যুগ লেগে যেতে পারে!

তাহলে কীভাবে একটা তারিখবিহীন সাদা কাগজে, কোনো কর্মকর্তা বা পদাধিকারীকে উদ্দেশ্য না করে লেখা যেনতেনভাবে লেখা একটি অভিযোগের ভিত্তিতে একজন সরকারি কর্মচারি বরখাস্ত হয়? বাংলাদেশে কবে যাত্রীদের বা সেবাপ্রার্থীদের অভিযোগকে এত গুরুতরভাবে আমলে নিয়ে বিদ্যুতগতিতে প্রতিকার দেয়া হয়েছে? কখনই না।

এরপরের কাহিনী সবার জানা।

প্রথম আলোতে খোদ যাত্রীদ্বয়ের মা, যিনি মন্ত্রীর নববিবাহিত স্ত্রীর বোন, সাক্ষাৎকার দিয়ে বস্তুত বলেই দিয়েছেন যে, মন্ত্রীর স্ত্রীর ফোনেই তারা বিনাটিকেটে ট্রেনে উঠতে পেরেছেন। তার ফোনেই টিটি বরখাস্ত হয়েছেন। পরবর্তীতে মন্ত্রী তাকে ফোনও দিয়েছেন দুঃখ প্রকাশ করতে। এখানে সমস্যা কয়েকটা। প্রথম সমস্যা হলো, মন্ত্রী একটা মিথ্যুক! দ্বিতীয় সমস্যা হলো, মন্ত্রী একটা মিথ্যুক। তৃতীয় সমস্যা হলো, মন্ত্রী একটা মিথ্যুক।

মন্ত্রী জেনেশুনে মিথ্যা কথা বলেছেন। তিনি জানতেন, কেন কী কারণে টিটিকে বরখাস্ত করা হয়েছে। তিনি জানতেন, তার আত্মীয় পরিচয়ে ট্রেনে উঠেছে যাত্রীরা। তিনি নিশ্চয়ই এ-ও জানতেন যে, কার ইশারায় কেন টিটিকে বরখাস্ত করা হয়েছে। কিন্তু জেনেশুনে তিনি প্রকাশ্যে সংবাদ সম্মেলন ডেকে মিথ্যা কথা বলেছেন। উল্টো টিটির উপর দায় চাপিয়েছেন। উধোর পিণ্ডি বুধোর ঘাড়ে চাপিয়েছেন।

এই পর্যায়ে এসে সমস্যাটা কেবল দুই জন ব্যক্তির মন্ত্রীর আত্মীয় হবার সুবাধে সামান্য ‘ফেভার’ নেয়ার মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। সমস্যাটা এখন অনেক বড়। একজন মন্ত্রী অত্যন্ত এলাবোরেট মিথ্যা ফেঁদেছেন। সামান্য একটি বিব্রতকর ঘটনা ধামাচাপা দিতে তিনি অবলীলায় মিথ্যা বলে গেছেন। আর এর মাধ্যমে এই পদে থাকার আস্থা ও যোগ্যতা তিনি হারিয়েছেন। বাংলাদেশে মিথ্যা বলা কোনো বড় অপরাধ নয়। প্রতি মিনিটে সেকেন্ডে এখানে সর্বোচ্চ ক্ষমতাধর ব্যক্তিরা মিথ্যা বলে। এমনকি তারা জানে যে, দেশের মানুষও জানে তারা মিথ্যা বলছে; এরপরও তারা মিথ্যা বলে।

এরপরের সমস্যা হলো, কীভাবে মন্ত্রীর স্ত্রীর ফোন কলে একজন কর্মচারি বরখাস্ত হন। এখানে সমস্যা কী, তা আমরা বুঝি। কোনো সরকারি পদে না থাকা সত্ত্বেও, স্রেফ প্রভাবের জোরে একজন ব্যাক্তির কথায় আরেকজনের চাকরি চলে গেল। এখানেও সমস্যা কেবল টিটি’র বরখাস্ত হওয়ার মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। বৃহত্তর সমস্যা হলো, এভাবেও বাংলাদেশে অনৈতিকভাবে ক্ষমতা প্রয়োগ হয়। কিন্তু এটাও আমরা জানি। কিন্তু যেটার দিকে আমরা নজর দিই না বেশি, সেটা হলো, প্রক্রিয়াগত বিষয়গুলো।

রেলওয়ের যেই ডিসিও তাকে বহিষ্কার করেছেন, তিনিও একটা এলাবোরেট মিথ্যার আশ্রয় নিয়েছেন। তার আচরণ ছিল আমলাদের মতো: নিজের অন্যায় পদক্ষেপকে জাস্টিফাই করতে তিনি ওই যাত্রীদের দ্বারা একটি অভিযোগপত্র লিখিয়ে নিয়েছেন। এমন হলেও অবাক হওয়ার কিছু নাই যে, যখন পত্রপত্রিকায় খবর প্রকাশিত হয়েছে, ঠিক তখন তিনি রেট্রোস্পেটক্টিভলি ওই অভিযোগ লিখিয়ে নিয়েছেন। এই কাভার-আপ-এ মন্ত্রীর সম্পৃক্ততা থাকলেও বিস্মিত হওয়ার কিছু থাকবে না।

ওই অভিযোগে, ডিসিও একজন অধস্তন সরকারি কর্মচারির বিরুদ্ধে কিছু গুরুতর অভিযোগ উৎপাদন করতে সহায়তা করেছেন। টিটির বিরুদ্ধে ঘুষ চাওয়া, যাত্রীর সঙ্গে খারাপ আচরণ করার অভিযোগ আনিয়েছেন। এগুলোর কিছু কিছু সত্যও হয়ে থাকতে পারে, কিন্তু এই পর্যায়ে সেগুলো আর প্রাসঙ্গিক নয়। কারণ হলো, টিটি জানতো যে, তারা রেলমন্ত্রীর আত্মীয়। তার মানে হলো, যাত্রীরা তাকে সেই কথা বলেছেনও। কিন্তু নিজেদের অভিযোগে যাত্রীরা এই বিষয়টি এড়িয়ে গেছেন। অর্থাৎ, তারাও মিথ্যার আশ্রয় নিয়েছেন। অভিযোগের ভিত্তিতে ডিসিও টিটির বক্তব্য জানতে চেয়েছেন বলেও কোনো প্রমাণ নেই। স্রেফ, একটা ফোন কলে তাকে বরখাস্ত করে দিয়েছেন।

এরপর যাত্রীদের মা’র সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে জানা গেল, মন্ত্রীর স্ত্রী নিজেই বিনা টিকেটে তাদের যাত্রার ব্যবস্থা করেছেন। যাত্রীরা ট্রেনে উঠার পর কেউ একজন অতি সমাদর দেখিয়ে তাদের এসি রুমে নিয়ে গেছেন। শুধু কেউ একজন টিটিকে আগাম বলে রাখতে ভুলে গেছেন।

ওই সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে সংবাদ প্রকাশের পর মন্ত্রী ফের সংবাদ সম্মেলন ডেকেছেন। এবার তিনি মিথ্যার উপর আরও দশ মিথ্যা বলেছেন। তিনি দোষ চাপিয়েছেন তার অবুঝ নতুন স্ত্রীর ঘাড়ে। টিটির বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহারের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। আর দোষ চেপেছে ডিসিওর ঘাড়ে। কিন্তু তিনি আরও বলেছেন, তারা যে তার আত্মীয় তা তিনি নাকি আগে জানতেন না। অথচ, নাকে খত দিয়ে পল্টি নেয়ার আগে তিনি তাদেরকে ফোন করে সান্ত্বনাও দিয়েছেন। হাতেনাতে তার পূর্বের মিথ্যা প্রমাণ না হলে তিনি কিন্তু এসবের কিছুই করতেন না।

এই পুরো অধ্যায় থেকে আমাদের যদি কিছু জানার থাকে, শেখার থাকে, তা হলো কতটা মিথ্যুক এই পুরো ব্যবস্থা। মূল অপরাধ এখানে বড় বিষয় নয়। বড় বিষয় হলো, তারা একটা ছোট অপরাধকে মাটিচাপা দিতে গিয়ে দশগুণ বড় আরও দশটা অপরাধ করেছেন। এই ব্যক্তিরা যে আরও বড় অপরাধ ধামাচাপা দিতে কী কী করতে পারবে, তা নিশ্চয়ই আর বলার অপেক্ষা রাখে না।

৩৪১ পঠিত ... ১৭:০১, মে ০৯, ২০২২

আরও eআরকি

পাঠকের মন্তব্য

আইডিয়া

কৌতুক

রম্য

সঙবাদ

স্যাটায়ার


Top