এপ্রিল ফুল সম্পর্কে প্রচলিত তিনটি গল্প এবং আসলে যা ঘটেছিল

১৫৮১১ পঠিত ... ১৩:০২, এপ্রিল ০১, ২০১৯

বিশ্বজুড়ে এপ্রিলের ১ তারিখ দিনটিকে এপ্রিল'স ফুল ডে হিসেবে পালন করা হয়। একে অপরকে নির্দোষ বোকা বানাবার মাধ্যমে দিনটি উদযাপন করা হয়। এই দিনটি নিয়ে বাংলাদেশসহ পৃথিবীর অনেক দেশের মুসলিম জনগোষ্ঠীর অনেকেরই বিশ্বাস এ দিনে মুসলমানদের বোকা বানিয়ে গণহত্যা চালানো হয়েছিল। তাই পশ্চিমারা এই দিনটিকে একে অপরকে বোকা বানানোর দিবস হিসেবে পালন করে। ফলে এই দিনটি 'এপ্রিল ফুল'স ডে' হিসেবে পালন তো দূরের কথা এই উৎসবকে নিয়ে রীতিমত ক্ষোভ রয়ে গেছে মুসলমানদের এই অংশের মনে। কিন্তু কী ঘটেছিল এপ্রিলের ১ তারিখ? একেবারে নিশ্চিত করে কী ঘটেছিল তা বলতে না পারলেও, যেটা একেবারেই ঘটেনি সেই বিষয়েই জেনে নিন। 

প্রচলিত ঘটনা-১

৭১১ খ্রিস্টাব্দে স্পেনে শুরু হওয়া দীর্ঘদিনের মুসলিম শাসনে জ্ঞান-বিজ্ঞানে আর সভ্যতায় ইউরোপের অন্যান্য অনেক অঞ্চলের চেয়ে মুসলিম শাসনে স্পেন এগিয়ে যায় অনেকদূর। দীর্ঘদিন যুদ্ধের পর ১৫ শতকের শেষদিকে যখন ফার্ডিনান্ড-ইসাবেলার নেতৃত্বে মুসলমানদের কাছ থেকে বিভিন্ন অঞ্চলের দখল করে নেয় তখনো গ্রানাডা ছিল মুসলিমদের অধিকারেই। দীর্ঘদিন অবরুদ্ধ থাকার পর অবশেষে ১৪৯২ সালের এপ্রিলের ১ তারিখ মুসলিম শাসকগণ সম্মত হন আত্মসমর্পণের চুক্তি করার। তখন শহরে ঢোকার সময় স্প্যানিশদের পক্ষ থেকে বলা হয়, যেসব মুসলমান মসজিদে আশ্রয় নিবে তাদেরকে কিছু করা হবে না। ফলে, শহরের সকল মুসলমান মসজিদে আশ্রয় নেয়। এরপর সৈন্যরা শহরে ঢুকে মসজিদগুলোর দরজা বন্ধ করে আগুন লাগিয়ে দেয়। হত্যা করা হয় লক্ষ লক্ষ মুসলমানকে। মুসলমানদের বোকা বানিয়ে হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে ইউরোপ থেকে মুসলিমদের বিতাড়িত করার দিন হিসেবে এখনো এপ্রিলের ১ তারিখকে বোকা বানাবার দিন হিসেবে পালন করে পশ্চিমারা।

 

প্রচলিত ঘটনা-২

১৮৯২ সালে ফার্ডিনান্দ-ইসাবেলার বাহিনী গ্রানাডা প্রবেশের আগে মুসলিমদের সাথে চুক্তি করে যে তাদেরকে জাহাজে করে আরবে পাঠিয়ে দেয়া হবে। পরে শহর দখল করে যখন জাহাজে করে সবাইকে পাঠিয়ে দেয়া হচ্ছিল ভূমধ্যসাগর দিয়ে, তখন মাঝসাগরে এসে সবগুলো জাহাজ ডুবিয়ে দেয়া হয়। লক্ষ লক্ষ মুসলমানকে সাগরে ডুবিয়ে হত্যা করা হয়। কোথাও কোথাও বলা হয়্‌ জাহাজেই স্প্যানিশরা সব মুসলিমকে হত্যা করে পানিতে ফেলে দেয়। দিনটি ছিল ১ এপ্রিল। এখনো পশ্চিমারা মুসলমানদের বোকা বানাবার দিনকে ‘এপ্রিল ফুলস ডে’ হিসেবে পালন করে।

 

প্রচলিত ঘটনা-৩

দীর্ঘদিন যুদ্ধ করেও যখন মুসলিমদের হাত থেকে কোনভাবেই গ্রানাডা দখল যাচ্ছিল না, তখন স্প্যানিশরা চিন্তায় পড়ে যায়। এরপর তারা এক ষড়যন্ত্র করে। নানাম ছলছুতায় প্রচুর পরিমাণ মদ এবং সিগারেট শহরের ভিতর পাঠায়। এসব পেয়ে গ্রানাডার মুসলিমরা মদ এবং সিগারেটের নেশায় বুদ হয়ে যায়। একসময় মন থেকে আল্লাহভীতি হারিয়ে দুর্বল হয়ে পড়ে। এরপর এপ্রিলের ১ তারিখ গ্রানাডার পতন হয়। মুসলমানদের পানীয় এবং সিগারেট দিয়ে বোকা বানিয়ে গ্রানাডা দখল করার দিবস হিসেবে পশ্চিমারা এখনো এই দিনটিকে ‘এপ্রিল ফুল’স ডে’ হিসেবে পালন করে।

 

গ্রানাডা দখল যেভাবে হয়েছিল

৭১১ খ্রিস্টাব্দে শুরু হওয়া মুসলিম শাসন চলেছে প্রায় ৮ শতাব্দী ধরে। মুসলমানদের পরাজিত করেন মূলত রানী ইসাবেলা আর রাজা ফার্ডিনান্দের যৌথ শক্তি। ১৪৮২ সালে তারা ইউরোপের বিভিন্ন দেশের কাছ থেকে সৈন্য সংগ্রহ শুরু করে। এরপর ধীরে ধীরে স্পেনের বেশ কিছু অঞ্চলে মুসলমানদের পরাজিত করে নিজেদের দখল প্রতিষ্ঠা করে। কিন্তু গ্রানাডা তখনো তৎকালীন মুসলিম শাসক দ্বাদশ মুহাম্মদের অধীনে ছিল।

গ্রানাডার বিভিন্ন অঞ্চল দখল করতে করতে ১৪৯১ সালে মূল শহরের বাইরে অবস্থান নেয় ইসাবেলা-ফার্ডিনান্দের সৈন্যবাহিনী। বেশ কিছুদিন অবরুদ্ধ থাকার পর দ্বাদশ মুহাম্মদ আত্মসমর্পণ করার সিদ্ধান্ত নেন। ১৪৯২ সালের ২ জানুয়ারি ইসাবেলা এবং ফার্ডিনান্দ শহরে প্রবেশ করেন এবং দ্বাদশ মুহাম্মদের কাছ থেকে নগরের চাবি নেন।

পেগি লিসের লেখা ‘ইসাবেল দ্য কুইন’, জন এডওয়ার্ডের লেখা ‘ফার্ডিনান্দ এন্ড ইসাবেলা’ কিংবা আই.এল.প্লাঙ্কেটের লেখা ‘আ হিস্ট্রি অফ মেডিভাল স্পেন’ এসব বই থেকে জানা যায় যে, ২ জানুয়ারিতেই গ্রানাডা নগরীর পতন হয়। ঐদিন মসজিদে মানুষদের আটকিয়ে আগুন লাগিয়ে দেয়ার কোন প্রমাণ কোথাও পাওয়া যায়নি। এমনকি ঐদিন কোন গণহত্যা হয়েছে সেটাও কোন সমর্থিত সূত্র থেকে কখনো পাওয়া যায়নি।

তবে মানব সভ্যতার ইতিহাসে অন্যান্য সব যুদ্ধ কিংবা শহর-রাজ্য দখলের ঘটনার মত এই দিনটিকেও একেবারে রক্তপাতহীন মনে করার কোন কারণ নেই। তবে ভুমধ্যসাগরে জাহাজডুবি কিংবা হত্যাকাণ্ডেরও কোন প্রমাণ কোথাও নেই। বরং সমর্থিত সকল সূত্র বলে যে, ১৬০৯ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে মুসলমানদের একটা অংশকে স্পেন থেকে ফেরত পাঠানো শুরু হয়। তবে অনেককে জোর করে খ্রিষ্টান ধর্মে ধর্মান্তরিত করার প্রচেষ্টাও চলেছে বেশ অনেক জায়গায়।

আর মদ্যপানের সাথে বাকি পৃথিবীর মতো আরবরাও পরিচিত ছিল হাজার বছরের বেশি সময় ধরে। আর সিগারেট ইউরোপে এসেছেই কলম্বাস আমেরিকা আবিস্কারের পর। কলম্বাস প্রথম ইউরোপিয়ান হিসেবে আমেরিকা আবিষ্কার করেন ১৪৯২ সালে। স্যার ওয়াল্টার র‍্যালেই ১৫৮৬ সালে আমেরিকা থেকে প্রথমবারের মত ইউরোপে তামাক নিয়ে আসেন।  ইউরোপেই সিগারেট জনপ্রিয় হতে আরও এক শতাব্দী কেটে গিয়েছিল।

 

এপ্রিল ফুল’স ডে

এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকার তথ্যমতে প্রাচীন রোমান উৎসব হিলারিয়া (যা উদযাপিত হত ২৫শে মার্চ) থেকেই এপ্রিল ফুল’স ডের উৎপত্তি।

জুলিয়ান ক্যালেন্ডার অনুসারে বছর শুরু হত ২৫ মার্চ। আর টানা ৮ দিনের উৎসবের শেষ দিন অর্থাৎ এপ্রিলের ১ তারিখ নববর্ষ উদযাপন হত। এরপর ষোল শতকে যখন গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার ব্যবহার শুরু হয়, তখন নববর্ষ সরে যায় ১ জানুয়ারি। কোন কোন সূত্রমতে, ক্যালেন্ডার বদলাবার খবর অনেকেই না জানায় তারা ১ এপ্রিলেই নববর্ষ উদযাপন করতে যেয়ে বোকা বনে যায়। তখন থেকেই এই এপ্রিলের ১ তারিখে নিজেরা নিজেদের বোকা বানিয়ে মজা নেয়।

এপ্রিল ফুল’স ডে’র উৎপত্তি নিয়ে আরও কিছু মতবাদ থাকলেও কোন সমর্থিত সূত্রেই মুসলমানদের বোকা বানিয়ে গণহত্যার কোন বর্ণনা নেই।

 

১৫৮১১ পঠিত ... ১৩:০২, এপ্রিল ০১, ২০১৯

আরও eআরকি

পাঠকের মন্তব্য

 

ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে

আপনার পরিচয় গোপন রাখতে
আমি নীতিমালা মেনে মন্তব্য করছি।

আইডিয়া

কৌতুক

রম্য

সঙবাদ

স্যাটায়ার


Top