মোনালিসা চুরি যাওয়ার পর পাবলো পিকাসোকে সন্দেহ করেছিল পুলিশ!

২৩৮০ পঠিত ... ১৮:৪৬, অক্টোবর ২৫, ২০১৮

 ১৯১১ সালের গ্রীস্মের এক মধ্যরাত। ঘড়ির কাঁটা যখন বারোটা ছুইছুই, প্যারিসের দুই তরুণ তাদের স্টুডিও থেকে সন্তপর্ণে বেরিয়ে আসল একটি লাগেজ নিয়ে। কোন ঘোড়ার গাড়ি ডাকা যাবে না, কাউকে জানতে দেয়া যাবে না। ধীর পায়ে অতি সতর্ক দুই তরুণ যেতে লাগল সেইন নদীর অভিমুখে। খানিক আগেই তারা স্টুডিওতে বেশ কিছু শিল্পকর্ম লাগেজে ভর্তি করে নিয়েছে। এসবের কথা কাউকেই জানানো যাবে না। ল্যুভর মিউজিয়ামে কয়েক দিন আগে যে বড় ধরনের চুরি হয়ে গেছে, তা নিয়ে কেঁচো খুড়তে যদি সাপ বেরিয়ে যায়? পিকাসো ও অ্যাপোলেনিয়ার নামের এই দুই কিংকর্তব্যবিমূঢ় তরুণ মনে প্রচণ্ড ভয় নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে সেইন নদীর পাড়ে গ্রীষ্মের স্যাঁতস্যাঁতে বাতাসে।

২২ আগস্ট, এই ঘটনার সপ্তাহ দুয়েক আগে, ল্যুভর মিউজিয়ামের পরিচালকের কক্ষে এক গার্ড হন্তদন্ত হয়ে এসে জানায়, মোনালিসা হারিয়ে গেছে! শিল্পের প্রতিচ্ছবি, পৃথিবীর ইতিহাসের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না, প্যারিস শহরের সাথে সাথে পুরো ইউরোপ যেন কেঁপে উঠল। শুধু কি ইউরোপ! সেই ধাক্কা গিয়ে লাগলো আটলান্টিকের পশ্চিমেও। সাথে সাথে পুরো ফ্রান্সকে যেন সিল গালা করে দেয়া হল, কোন কাকপক্ষী যেন কারো চোখকে ফাঁকি দিয়ে দেশছাড়া না হতে পারে।

ল্যুভর থেকে এমনিতেই এটা সেটা কখনো সখনো চুরি যায়। কিন্তু এই চুরি (নাকি ডাকাতি!) যেন ল্যুভরকে একেবারে ভয়ানক লজ্জায় ফেলে দিল। তার উপর এর মাসখানেক আগে এক ফ্রেঞ্চ সাংবাদিক সবার অলক্ষ্যে মিউজিয়ামের একটি পাথরের কফিনে রাত কাটিয়ে ল্যুভর-এর নিরাপত্তা ব্যবস্থার ত্রুটি একেবারে হাতেনাতে প্রমাণ করিয়ে দিয়েছিলেন। এমনকি সে নিজ হাতে এখানে সেখানে বিভিন্ন ছবি নিজ হাতে দেয়াল থেকে তুলেছেন আবার বসিয়েছেন। ল্যুভর যেন এক অরক্ষিত ফুলের বাগান। যার যখন খুশি ফুল তুলো, কেউ কিছু বলছে না।

মোনালিসা চুরির পরপর মোটামুটি ২৪ ঘণ্টা সময় যাবার পর সবাই বুঝেছিল যে, এটি খোয়া গেছে। তার আগে রক্ষীরা ভেবেছিল, সংস্কারের জন্য সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। পুরো দেশের গোয়েন্দা সংস্থাগুলো খুঁজে খুঁজে হয়রান, কিন্তু কোথাও কোন 'ক্লু' নেই। হুট করেই তারা যেন মেঘ না চাইতেই জল পেয়ে গেলেন।

 

২৯ আগস্ট বিখ্যাত দৈনিক ‘প্যারিস জার্নাল’-এর অফিসে জোসেফ গ্যারি পাইরেত নামের এক তরুণ যেন বোমা ফাটায়। সে জানায়, গত বেশ কয়েক বছর ধরে অনেকটা যেন শখের বশেই সে ল্যুভর থেকে বিভিন্ন কম গুরুত্বপূর্ণ শিল্পকর্ম চুরি করে আসছে। নিজের কথার সত্যতা প্রমাণ করতে ছোট্ট একটা আইবেরিয়ান ভাস্কর্য বের করে দেখায়। খুব দ্রুতই নিশ্চিত হওয়া যায়, বেশ কিছুদিন আগে এটিও ল্যুভর থেকে চুরি গিয়েছিল। কিন্তু জোসেফের কাছ থেকে মোনালিসার ব্যাপারে কিছু জানা যায় না। এমনকি সে জানাতেও পারে না, কে চুরি করেছে কিংবা করিয়েছে। তবে ছোট্ট একটা সূত্র পাওয়া যায়, প্যারিসেরই এক আগ্রহী শিল্পীর কাছে সে আইবেরিয়ান দুটো ভাস্কর্য বিক্রি করেছিল ল্যুভর থেকেই চুরি করে।

প্যারিস জার্নাল থেকে সরাসরি কোন নাম বলা না হলেও, পত্রিকায় প্রকাশিত জোসেফের স্বীকারোক্তিতে লুকিয়ে ছিল এক ফরাসী কবির ছদ্মনাম। সেটি ধরেই পুলিশ চলে যায় অ্যাপোলিনেয়ারের দরজায়। অবশ্য পুলিশ মনে করেনি এই কবিই এমনটা করেছেন। তাদের সন্দেহ ঘুরে যায় তারই বন্ধু চিত্রকর পাবলো পিকাসোর দিকে। এমনিতেই ঐ সময় পিকাসো বেশ প্রভাবশালী তরুণ শিল্পী এবং তার অনুপ্রেরণায় প্যারিসে একদল তরুণ এমনই ‘পাগলামি’ শুরু করেছিল যে তাদেরকে ডাকা হতো ‘ওয়াইল্ড ম্যান অফ প্যারিস’। পুলিশ ধারণা করে, মোনালিসা চুরির সাথে এই পিকাসোরই হাত আছে।

কিন্তু পুলিশের জন্য ঝামেলা হয়ে দাঁড়ায়, মোনালিসা চুরির সাথে এদের কারোই কোন সম্পর্ক না বের করতে পারায়। দুজনেরই ঘরবাড়ি তল্লাশি করেও কোন হদিস মেলে না কোন সূত্রের। কিন্তু দুই বন্ধু নিশ্চয়ই পুরোপুরি নির্দোষ ছিলেন না। পাইরেতের স্বীকারোক্তি প্রকাশিত হলে ভয় পেয়ে পিকাসো আর অ্যাপোলিনেয়ার সিদ্ধান্ত নেয় স্বদেশ স্পেনে প্রত্যাবর্তনের। সে উদ্দেশ্যেই ৫ সেপ্টেম্বর তারা একটি লাগেজে দুটি আইবেরিয়ান ভাস্কর্য নিয়ে বেরিয়ে পড়েন। কিন্তু সেইন নদীর পাড়ে এসে তারা আর প্যারিসের মায়া ত্যাগ করতে পারেননি।

পিকাসো দুটি ভাস্কর্য নিয়ে পাইরেতের মতো করেই প্যারিস জার্নালে চলে যান। স্বীকারোক্তি দেন। দুই দিনের মাথায় অ্যাপোলিনেয়ার গারদের ওপারে চলে গেলেন। তিনি সেখানে পিকাসো আর পাইরেতের নাম বললেন। জানা গেল, একটা সময় পাইরেত তার সহকারী ছিল। দিন কয়েক জেলে কাটানোর পর দুই বন্ধুর আবার দেখা হলো, এবার আদালতে।

অ্যাপোলেনিয়ার আদালতে সব স্বীকার করলেন- পাইরেতকে আশ্রয় দেয়া, চুরি যাওয়া শিল্পকর্ম লুকিয়ে রাখা, তথ্য প্রমাণ গোপন করা। কিন্তু পিকাসো যেন একটি নাটক মঞ্চায়িত করলেন আদালতে। আদালতে প্রকাশ্যে কাঁদলেন। কাঁদতে কাঁদতে এক পর্যায়ে অ্যাপোলেনিয়ারের দিকে আঙুল তুলে হিস্টিরিয়া রোগীর মতো পিকাসো বলতে লাগলেন, তার সাথে কখনো দেখাই হয়নি। এমন নাটকীয় অবস্থায় সাক্ষ্যের অসঙ্গতি এবং সবকিছু মিলিয়ে বিচারক দুজনকে খানিকটা উপদেশ দিয়ে খালাস করে দিলেন।

দুই বছর পর ১৯১৩ সালের ডিসেম্বরে ইতালির ফ্লোরেন্সে ঠিক আগের মতই হাস্যোজ্জ্বল মোনালিসাকে আবারও দেখা যায়। মোনালিসাকে ল্যুভর থেকে সরিয়ে নেয়া ভিনসেঞ্জো পেরুজ্জিয়া জানায়, মোনালিসাকে স্বদেশে ফিরিয়ে আনতেই সে ঐ ‘চুরি’ করেছিল। যদিও আজকাল ঐতিহাসিকদের যথেষ্ট সন্দেহ আছে, পেরুজ্জিয়ার ‘দেশপ্রেম’ নিয়ে। অবশ্য ফ্লোরেন্সে মোনালিসার খোঁজ পাওয়ার পর নিশ্চয়ই প্যারিসে এক অসাধারণ চিত্রকর হাফ ছেড়ে বেঁচেছিলেন।

২৩৮০ পঠিত ... ১৮:৪৬, অক্টোবর ২৫, ২০১৮

আরও eআরকি

পাঠকের মন্তব্য

 

ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে

আপনার পরিচয় গোপন রাখতে
আমি নীতিমালা মেনে মন্তব্য করছি।

আইডিয়া

কৌতুক

রম্য

সঙবাদ

স্যাটায়ার


Top