ছাত্রলীগ একটি ঐতিহ্যবাহী ছাত্রসংগঠন। বাংলাদেশের স্বাধিকার আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ ও নব্বুই-এর গণতন্ত্রযুদ্ধে এই ছাত্রসংগঠনটির গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। জাতির জনক শেখ মুজিব ষাটের ও সত্তর দশকের মেধাবী ছাত্রদের ছাত্রলীগে সম্পৃক্ত করেন। বিংশ শতকে আওয়ামী লীগের মাঝে প্রচেষ্টা ছিলো ছাত্রলীগের ভালো নেতাদের জাতীয় রাজনীতিতে নিয়ে আসার। সে ছিলো বাংলাদেশের সোনালী যুগের ছাত্র রাজনীতি।
একবিংশ শতকের প্রথম আলোয় জ্ঞান নির্ভর সমাজ যাত্রা শুরু করে টেকাটুকা নির্ভর সমাজের দিকে। তখন আর জাতীয় রাজনীতিতে ছাত্ররাজনীতির উজ্জ্বল নক্ষত্রদের প্রয়োজন হয়নি। তারা রয়ে যায় ক্ষমতায় যাবার আর ক্ষমতা ধরে রাখার ফুট সোলজার হিসেবে। ফলে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো হয়ে পড়ে ফুটসোলজার নিবাস।
সংসদ আলো করে বসে থাকে গার্মেন্টস মালিক, জলমহাল-বালুমহালের মালিক, কালো-টাকা ও পেশীশক্তির মালিক, মৃত সাংসদ ও মন্ত্রীর বিধবা স্ত্রী-ছেলে-মেয়ে। ছাত্র রাজনীতির উজ্বল নেতাদের জীবনের অপচয়ের বিষাদসিন্ধু এই বেদনাময় বাংলাদেশ রাজনীতি।
ছাত্রলীগে তখন রবার্ট মুগাবের যুগ শুরু হয়। হাতিতে চড়ে মুগাবে পৌঁছে যায় টিএসসিতে। বিংশ শতকের ছাত্রনেতারা পায়ে হেঁটে ও রিক্সায় চড়ে সাংগঠনিক কাজ করে বেড়াতো। আর একবিংশ শতকে অছাত্রনেতাদের বাহন হয় হাতি ও বিলাসবহুল গাড়ি। ব্যাংক খাওয়ার অংশীদারিত্ব ও বিলেতে সেকেন্ড হোম হয়ে যায় এই প্রস্তর যুগে।
একবিংশের পরশ পাথর যুগের ছাত্র রাজনীতি থেকে তৈরি হওয়া রাজনীতি সচেতনতা বিশ্বে প্রথমবারের মতো প্রতিটি পেশার মধ্যে দলীয় রাজনীতির সুগন্ধ প্রবেশ করায়।
জন্ম লাভ করে প্রশাসন লীগ, পুলিশ লীগ, বিচারক লীগ, চিকিৎসক লীগ, প্রকৌশলী লীগ, কৃষিবিদ লীগ, আইনজীবী লীগ, সাংবাদিক লীগ, কথাসাহিত্যিক লীগ, কবি লীগ, চিত্রকর লীগ, গায়ক লীগ, নায়ক লীগ, বিশিষ্ট নাগরিক লীগ, উপাচার্য ও শিক্ষক লীগ, জাস্টিফিকেশন লীগ, টাইম মেশিন লীগ, শতবর্ষ পালন লীগ, অর্ধশতক পালন লীগ, টকশো লীগ, ব্যাংক খেকো লীগ, টাকা পাচার লীগ, সেকেন্ড হোম লীগ, ক্যাশিয়ার লীগ, রবার্ট মুগাবে লীগ, হেলমেট লীগ, প্রমোদে ঢালিয়া দিনু মন লীগ, প্রশ্ন নয় প্রশংসা লীগ, উন্নয়ন লীগ, গুজব লীগ, ফেসবুক লীগ, ইতিহাস লীগ, মোদি প্রগতিশীল লীগ, ওমরাহ লীগ, লজ্জা ঘৃণা ভয় জয় লীগ, শিক্ষা শিকেয় তোলা লীগ, ভাতের হোটেল লীগ, জুজু লীগ, শুদ্ধাচার ও দুর্নীতি লীগ, নির্বাচন কমিশন লীগ, নিশি ও ডামি লীগ ইত্যাদি।
অতএব তোমরা কীরুপে অস্বীকার করিবে এই সর্বব্যাপী রাজনীতি সচেতনতার ফজিলত।
বুয়েট ও কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়কে জাতির জনক শেখ মুজিব নষ্ট হবার হাত থেকে বাঁচাতে প্রচলিত ছাত্র রাজনীতি মুক্ত রাখতে চেয়েছিলেন। বরেণ্য শিক্ষাবিদ আইনুন নিশাতের ভাষ্যে উঠে আসে ত্রিকালদর্শী মুজিবের এই পরিকল্পনার কথা।
কিন্তু বারোরকম লীগ দুর্নীতির যে প্রাসাদ গড়েছে; তা পাহারা দিতে ফুট সোলজার প্রয়োজন। তাইতো তারা বুয়েটে ছাত্রলীগের প্রসাদ বিতরণের জন্য অস্থির হয়ে ওঠে।
অতীতে ছাত্রদলের নিষ্ঠুরতায় ছাত্রমৃত্যু ঘটেছে। আর সম্প্রতি ছাত্রলীগের অনক্যামেরা আবরার হত্যাযজ্ঞ বুয়েটে ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধের পটভূমি তৈরি করেছিল।
কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সানগ্লাস পরা মুগাবেরা অস্থির হয়ে ওঠে বুয়েটে ছাত্রলীগের প্রসাদ বিতরণের জন্য। তারা ছাত্রলীগের ডিএনএ আছে এমন আদালত লীগের শরণাপন্ন হয়। আদালত কবুল কবুল বলে। প্রস্তুত ছিলেন উপাচার্য লীগের যুধিষ্ঠির সত্য প্রসাদ, তিনি ডেইলি স্টারে বলেন, ছাত্রলীগের ভালো কাজ দেখলে বুয়েটের শিক্ষার্থীদের ভয় কেটে যাবে।
এর আগে ২৪ ঘন্টা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সক্রিয় ছিলো গান্ধা কইরা লীগ। তারা বুয়েটের সাধারণ ছাত্র-ছাত্রীদের শিবির, হিজবুত তাহরির, পাকিস্তান ইত্যাদি বিশেষণে ভূষিত করে।
নির্দয় ও রক্ষণশীল শৈশব থেকে উঠে আসা লোকজন মনে করে, বড় গলায় ইসলামোফোবিয়া চর্চা হচ্ছে প্রগতিশীলতার মূল হাতিয়ার। মঙ্গা এলাকার লোক পার্টি করে চর্বি হলে টি শার্ট ও সানগ্লাস পরে একে ওকে শিবির তকমা দিলে; তারা মনে করে কাস্ট সিস্টেমে তাদের কোলে তুলে নেবে কালচাঁড়াল ফ্রন্টের পোগোতিচিল সংস্কৃতি মামারা।
হয়তো তাদের মনে নাই; আশির দশকে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘রগ কাটা’-র নিষ্ঠুরতার কারণে সাধারণ মানুষ যে চোখে শিবিরকে দেখতো; গত এক যুগে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে বিশ্বজিত হত্যা, বুয়েটে আবরার হত্যা, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ধর্ষণ, রাজশাহী ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে গণরুম নির্যাতন, কোটা সংস্কার আন্দোলনে সাধারণ শিক্ষার্থীদের নির্যাতন, নিরাপদ সড়ক আন্দোলনে শিশু-কিশোর নির্যাতনের পেডোফিলিক কর্মযজ্ঞ ইত্যাদির মাঝ দিয়ে ছাত্রলীগকে একই চোখে দেখে। এ সমাজে শিবির যেমন ট্যাবু, লীগও তেমনি ট্যাবু; এটা সূর্যালোকের মতো স্পষ্ট।
ভারতের অভ্যন্তরে নতুন দিল্লির জওহরলাল ইউনিভার্সিটি ও কলকাতায় যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে মোদী বিরোধী অনেক বিক্ষোভ অনুষ্ঠিত হয়। কেউ সেখানে তাদের বাধা দেয় না। কিন্তু মোদি বাংলাদেশ সফরকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাম ছাত্র সংগঠনগুলো বিক্ষোভ করলে; ছাত্রলীগ তাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে মোদি প্রগতিশীলতার ব্যান্ড হাতে পরে। সে কারণে বুয়েটকে তারা পাকিস্তানের সঙ্গে তুলনা করে বলে, বুয়েট ki পাকিস্তান যে সেখানে যেতে ভিসা নিতে হবে!
ভারত ও পাকিস্তানের খ্যাতনামা প্রকৌশল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে ছাত্রলীগ স্টাইলের ছাত্র রাজনীতি প্রচলিত নেই। আর সভ্য দুনিয়ায় ছাত্র রাজনীতির আঙ্গিক ও প্রকরণ একেবারেই ভিন্ন। এইরকম ছাত্রলীগ-ছাত্রদল স্টাইলে চাঁদাবাজি, সাধারণ ছাত্র নির্যাতন, হলে রুম দখল করে ভি আই পি নেতা কক্ষ তৈরি, ছাত্রীদের হাত ধরে টান দিয়ে ঝোঁপের আড়ালে নিয়ে যাওয়া, আওয়ামী লীগ ও বিএনপির ক্ষমতা প্রাসাদ পাহারা দিতে অতন্দ্র প্রহরী কিংবা চর দখলের লেঠেল হিসেবে কাজ করা আদিম চর্চার কথা পৃথিবীর কোন দেশের বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্ররা কল্পনাও করতে পারেনা।
বাংলাদেশের দুর্ভাগ্য শীর্ষ নেতৃত্ব মেধাপ্রিয় ও বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষিত নয়। জাতির জনক শিক্ষার যে গুরুত্বটি বুঝেছিলেন, যে কারণে তাজউদ্দিন আহমদ, তোফায়েল আহমদের মতো মেধাবী ছাত্রদের রাজনীতিতে আকৃষ্ট করেছিলেন; সেরকম মেধার গুরুত্ব বোঝার মানুষ আর নেই নীতি নির্ধারণে। অথচ কালের করাল গ্রাসে ছাত্র রাজনীতি এখন খারাপ ছাত্রদের শ্রেষ্ঠত্ব দাবি করে গলাবাজি করার কুরুক্ষেত্র; জীবনে উজ্জ্বল ছাত্র হিসেবে প্রমাণিত বুয়েট শিক্ষার্থীদের টেনে কষে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়া পান্ডারা বলছে, বাঘে ছুঁলে ১৮ ঘা, আর ছাত্রলীগ ছুঁলে ৩৬ ঘা। সেই ঔপনিবেশিক পাকিস্তান আমলের আইয়ুবজান্তার এন এস এফ-এর অছাত্র পান্ডারা ঠিক এরকম ভাষায় মেধাবী ছাত্রদের ভয়ভীতি প্রদর্শন করতো। স্বাধীন বাংলাদেশে যেন সেই পেশীবহুল পরাজিত প্রেতায়িত আত্মার দেঁজাভু দেখতে হয়!
ছাত্রনং অধ্যয়নং তপঃ
অধ্যয়নই ছাত্রের তপস্যা।
পাঠকের মন্তব্য
ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে
লগইন