ক্রাইস্টচার্চে জঙ্গি হামলায় সর্বশেষ পাওয়া খবর অনুযায়ী মারা গেছেন ৫০ জন নিরীহ মানুষ। ১৭ মিনিটের এক ভিডিওতে দেখা যায় খুনী অস্ত্র হাতে গুলি করতে করতে মসজিদে ঢুকছে, ভেতরে ঢুকে যাকে সামনে পাচ্ছে তাকেই গুলি করছে। এই ঘটনায় হতবাক হয়ে গেছে পুরো বিশ্ব। সেই সঙ্গে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে চলছে নানান আলোচনা। সেইসব আলোচনা থেকে কিছু মন্তব্য ও বাস্তব অবস্থার একটি চিত্র তুলো ধরা eআরকি পাঠকদের জন্য।
মন্তব্য: মুসলমান হলে ‘ইসলামি জঙ্গি’ বলা হয়, এখন ‘খ্রিস্টান জঙ্গি’ বলা হচ্ছে না।
বাস্তব অবস্থা: এই মন্তব্যটি ঠিক। কোনো মুসলিম যদি সন্ত্রাসী হামলা চালায়, তবে তাকে ইসলামি জঙ্গি বা মুসলিম জঙ্গি বলে আখ্যায়িত করা হয়, যেটা খ্রিস্টান হামলাকারীর ক্ষেত্রে বলা হয় না। এটার অবশ্য কারণও আছে। ইসলামিক স্টেট বা আল কায়েদাসহ মুসলিম-নামধারী যেসব গোষ্ঠী সন্ত্রাসী হামলা চালায়, তারা সেটিকে ‘জিহাদ’ বলে উল্লেখ করে এবং তাদের মূল উদ্দেশ্য ‘কাফের’দের দূর করা কিংবা ইসলামি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা। ফলে এ ধরনের হামলায় সরাসরি ‘ইসলাম’ শব্দটা চলেই আসে। অন্যদিকে, খ্রিস্টান কোনো ব্যক্তির সন্ত্রাসী হামলার উদ্দেশ্য খ্রিস্টান ধর্ম প্রতিষ্ঠা করা--এমনটা সাধারণত দেখা যায় না। ফলে এমন হামলার ঘটনায় মুসলমান কেউ জড়িত থাকলে প্রথমেই ‘ইসলামি জঙ্গি’ কথাটি মাথায় আসে, খ্রিস্টান কারো ক্ষেত্রে 'খ্রিস্টান জঙ্গি’ কথাটি আসে না।
ক্রাইস্টচার্চের মসজিদে আজ যে হামলাটি হয়েছে সেটি পুরোপুরি মুসলমানদের বা মুসলিম সম্প্রদায়কে লক্ষ্য করে করা হয়েছে। তবে হামলাকারীর (বা হামলাকারীদের একজনের) প্রকাশিত ৭৪ পৃষ্ঠার ম্যানিফেস্টো থেকে মোটামুটি ধারণা করা যায় যে খ্রিস্টান ধর্ম বা আদর্শ প্রতিষ্ঠার জন্য সে এই হামলা করেনি। এটি একটি বর্ণবাদী হামলা, প্রচণ্ড রকম মুসলিম-বিদ্বেষ থেকে সে এই হামলা ঘটিয়েছে। হামলাকারী শ্বেতাঙ্গ এবং সে বিশ্বাস করে যে মুসলিম অভিবাসীদের জন্য শ্বেতাঙ্গরা জায়গা হারাচ্ছে, ফলে সে মুসলিমদের নির্মূল করতে চায়। এই হামলাটি সেক্ষেত্রে অবশ্যই উগ্রবাদী বা জঙ্গি হামলা। কিন্তু তারপরও এখানে তাকে 'খ্রিস্টান জঙ্গি’ বলার সুযোগ বোধহয় নেই। ঘটনার কয়েক ঘণ্টা পেরিয়েছে মাত্র, ফলে নিশ্চিত করে এখনই কিছু বলা ঠিক না। পুরো বিষয়টি স্পষ্ট হবে আরও তদন্তের পর।
২০১৭ সালে কানাডার কুইবেকের এক মসজিদে এ রকম একটি হামলা হয়েছিল। সেটিও ছিল প্রচণ্ড মুসলিমবিদ্বেষ থেকে এবং মুসলিমদের লক্ষ্য করে। সেই ঘটনায় হামলাকারীকে তার পরিবার মানসিক ভারসাম্যহীন বলে দাবি করেছিল। কিন্তু কানাডার আদালত হামলাকারীকে সে দেশের আইন অনুযায়ী সর্বোচ্চ শাস্তি যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিয়েছিল।
মন্তব্য: নিউজিল্যান্ড পুলিশ প্রমাণ সরিয়ে ফেলার জন্য ভিডিও শেয়ার করতে নিষেধ করেছে।
বাস্তব অবস্থা: সহিংসতার ছবি বা ভিডিও আমরা যেভাবে প্রচার করি, সচেতন দেশগুলো সেভাবে তা করে না। এ ধরনের ছবি বা ভিডিও মানসিক চাপ তৈরি করে, নতুন কোনো সহিংস ঘটনা ঘটাতে উদ্বুদ্ধও করে। ফেসবুক, টুইটারসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলো সন্ত্রাস বা জঙ্গিবাদকে উস্কে দেয় এমন যেকোনো ছবি বা ভিডিও দেখলে সরিয়ে নিতে সবসময়েই তৎপর থাকে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলো, বিশেষ করে ফেসবুক ও টুইটার এ ধরনের যে পরিমাণ ভিডিও ইতোমধ্যে সরিয়ে নিয়েছে, তার ৯৯ ভাগেরও বেশি আল কায়েদা বা আইসিসের পোস্ট করা। আজকের ঘটনার পরও টুইটার হামলাকারী ব্রেন্টন ট্র্যান্টের আইডি সাসপেন্ড করে দিয়েছে। প্রতিষ্ঠানগুলো সহিংসতার ভিডিও অপসারণ করার জন্য প্রতিনিয়ত অর্থ বিনিয়োগ করছে এবং স্বয়ংক্রিয়ভাবে এমন ছবি-ভিডিও চিহ্নিত করার পদ্ধতি উন্নত করার চেষ্টা করে যাচ্ছে।
সুতরাং নিউজিল্যান্ড পুলিশ প্রমাণ সরিয়ে ফেলার জন্য ভিডিও শেয়ার করতে নিষেধ করেছে কথাটি ঠিক নয়। বরং এই ঘটনার পর পুলিশ সম্ভাব্য সব ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। হামলা যেহেতু মুসলমানদের লক্ষ্য করে হয়েছে, তাই তাদের মসজিদসহ সব জায়গায় যেতে নিষেধ করেছে। ক্রাইস্টচার্চে শিশুদের নিয়ে একটি অনুষ্ঠান হওয়ার কথা ছিল, সেটিসহ সব ধরনের অনুষ্ঠান বাতিল করেছে, জরুরি হেল্পলাইন চালু করেছে এবং দায় কারো ওপর চাপিয়ে না দিয়ে এই ঘটনায় পুলিশের আগে থেকেই কী ব্যবস্থা নেওয়ার ছিল এবং পুলিশ কেন সেই ব্যবস্থা নিতে পারেনি, তা খতিয়ে দেখছে।
মন্তব্য : পাকিস্তানে হামলার কারণে সে দেশে ক্রিকেট খেলতে যায় না কেউ, নিউজিল্যান্ডকেও একইভাবে নিষিদ্ধ করতে হবে!
বাস্তব অবস্থা : এটি অত্যন্ত হাস্যকর তুলনা। নিউজিল্যান্ড বিশ্ব শান্তি সূচকে আছে দ্বিতীয় স্থানে। অর্থাৎ বিশ্বের দ্বিতীয় শান্তিপূর্ণ দেশ এটি। এই দেশের ক্রাইম রেট খুবই কম এবং যতটুকু ক্রাইম আছে, তার মাত্রাও দেশটি গত দশ বছরে অর্ধেকের কোঠায় নিয়ে এসেছে। অভিবাসীবান্ধব এই দেশে ধর্ম, বর্ণ নিয়ে কোনো ভেদাভেদের তেমন কোনো খবর জানা যায় না। আজকের যে হামলা, এটি একটি বিরল ঘটনা। এ ধরনের সর্বশেষ হামলাটি নিউজিল্যান্ডে হয়েছিল ৩০ বছর আগে। হামলাটিও ক্রিকেটারদের লক্ষ্য করে হয়নি।
অন্যদিকে, পাকিস্তান, ভারত কিংবা বাংলাদেশের মতো দেশগুলোর পরিস্থিতি এমন সুখকর না। এসব দেশের রাজনৈতিক পরিবেশই সহিংস। পরিস্থিতি কখনোই অনুমেয় বা স্থির না। অন্য কোনো দেশ খেলতে এলে বাংলাদেশ যে ধরনের নিরাপত্তার ব্যবস্থা করে সেটি অসাধারণ। কিন্তু পাকিস্তান যতই নিরাপত্তার ব্যবস্থা করুক, তাতে সন্দেহ থেকেই যায়। বিশ্বের সবচেয়ে অনিরাপদ দেশগুলোর একটি তারা। এখানে ক্রিকেটারদেরই টার্গেটে পরিণত করার সমূহ সম্ভাবনা থাকে।
ফলে নিউজিল্যান্ডের মতো দেশের এমন ঘটনাকে দূর্ঘটনা হিসেবে দেখা যায়, যা কালেভদ্রে ঘটে। যদিও সেটিও কাম্য নয়। কেউ নিশ্চয় কখনো ভাবেওনি যে নিউজিল্যান্ডে এমন ঘটনা ঘটতে পারে। নিউজিল্যান্ড এখন নিশ্চয় নিরাপত্তার বিষয়টি আরও ভেবে দেখবে এবং সেই অনুযায়ী ব্যবস্থা নেবে। তবে বিসিবিকে আরও সতর্ক হতে হবে। যতই শান্তির দেশ হোক, এটা প্রমাণিত যে উগ্রবাদী, সন্ত্রাসী বা জঙ্গি হামলা যেকোনো দেশে যখন তখন ঘটতে পারে। ফলে ক্রিকেটারদের এভাবে নিরাপত্তাশূণ্য করে চলাচলের সুযোগ আর কখনোই কোনো দেশে দেওয়া যাবে না। এই বিষয়টি বিসিবিকে সফরের আগেই চূড়ান্ত করে নিতে হবে।
মন্তব্য : বাংলাদেশ দল তো মসজিদে ঢোকেইনি, এটাকে মিডিয়া ‘অল্পের জন্য বেঁচে গেল’ লিখছে কেন?
বাস্তব অবস্থা : আজ যে ঘটনা ঘটেছে, তাতে আমাদের ক্রিকেটাররা সত্যিই অল্পের জন্য বেঁচে ফিরেছেন। হামলাকারী যেভাবে ঠান্ডা মাথায় গুলি করেছে এবং আহত বা নিহত মানুষগুলোর ওপর পুনরায় গুলি করে মৃত্যু নিশ্চিত করেছে, তাতে মসজিদের ভেতরে থাকলে আমাদের ক্রিকেটারদের বেঁচে ফেরার সুযোগ খুব বেশি ছিল না বোধহয়। এটি খুবই ভাগ্যের ব্যাপার, যেকোনো কারণেই হোক তাদের পৌঁছাতে দেরি হয়েছিল, রক্তাক্ত কেউ ছুটতে ছুটতে এসে তাদের সতর্ক করেছিল এবং আমাদের ছেলেরাও বুদ্ধি দিয়ে পরিস্থিতি মোকাবেলা করেছিল। ভিডিওতে দেখা গিয়েছে, হামলাকারী ভেতরে হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে বাইরে এসে রাস্তায় থাকা মানুষের ওপরও হামলা চালিয়েছে। ফলে বাসে বসে থাকাটা সত্যিই নিরাপদ ছিল না। সাহস করে তাদের বের হয়ে চলে আসাটা সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত ছিল।
ঘটনার পর টিম ম্যানেজার খালেদ মাসুদ বলেছেন নিউজিল্যান্ড বোর্ড কীভাবে সহযোগিতা করেছে। ম্যাচ বাতিল করা হয়েছে, ক্রিকেটারদের ফেরার ব্যবস্থা করা হচ্ছে। তাদের নিরাপদে ফিরে আসাই আমাদের প্রথম প্রত্যাশা।
মন্তব্য : প্রকৃত জঙ্গি ইহুদি-খ্রিস্টারাই! / ইহুদি-খ্রিস্টানদের ওপরও এমন হামলা করতে হবে!
বাস্তব অবস্থা : ঘটনার পর বাংলাদেশি যারা বিভিন্ন মিডিয়ায় ইহুদী-খ্রিস্টানদের মুণ্ডুপাত করছেন, তাদের এসব মন্তব্যে আসলে এ ধরনের ঘটনা কমবে না। বরং ভালোবাসা, সম্প্রীতি ছড়িয়ে দেওয়াই আমাদের কাজ হওয়া উচিত। নিউজিল্যান্ডের লোকজনের কমেন্টও দেখা যাচ্ছে তারা দুঃখ প্রকাশ করছে, এ ধরনের ঘটনা ঘটতে পারে তারা কখনোই ভাবেনি বলে জানাচ্ছে। অভিবাসীরা যে তাদেরই অংশ সেটিও বলছে। তাদের প্রধানমন্ত্রী নিজেও বলেছেন, নিউজিল্যান্ড দেশটি অভিবাসীদেরও। আমাদেরও কি উচিত না সন্ত্রাস বা উগ্রবাদের বিরুদ্ধে এক হয়ে কথা বলা? আজকের হামলার জন্য হয়তো আবার কোনো মুসলমান খ্রিস্টানদের ওপর হামলা করবে, সেই হামলার জন্য কোনো খ্রিস্টান আবারও হামলা করবে কোনো মুসলমানের ওপর। এই বিদ্বেষ হামলা দিয়ে মেটানোর নয়।
এটা প্রমাণিত যে উগ্র বা জঙ্গি হামলা যেকোনো ধর্মের যেকোনো মানুষই করতে পারে। ফলে 'ইসলামি জঙ্গি’, ‘মুসলিম সন্ত্রাসী’ জাতীয় শব্দ বা বাক্যগুলো এখনই পুরোপুরি নির্মূল করা উচিত। অন্য ধর্মের অনুসারীদের প্রতি যে বিরূপ মন্তব্য আমরা প্রতিনিয়ত ছুঁড়ছি, তা দিয়ে জয়লাভ করা কখনোই সম্ভব না। অতীতেও আঘাত করে হিংসা-বিদ্বেষ দূর করা যায়নি, ভবিষ্যতেও যাবে না। হিংসা কখনো হিংসা নির্মূল করে না, বরং বাড়িয়ে দেয়। একটা সহিংস ঘটনা আরও অনেক সহিংস ঘটনার জন্ম দেবে।
আমাদের মনে কেন এত বিদ্বেষ? এই বিদ্বেষ দিয়ে আমরা কি পারতাম আজ আমাদের প্রিয় ক্রিকেটারদের বাঁচাতে? তারা বেঁচে ফিরেছেন, আমাদের তো কামনা করা উচিৎ এমন ঘটনার যেন কখনো পুনরাবৃত্তি না ঘটে। দুজন বাংলাদেশিসহ ৫০ জন মারা গেছে সম্পূর্ণ বিনা কারণে। ধর্ম, বর্ণ বা মতের ভিন্নতা, রেষারেষি, হিংসা-বিদ্বেষ তো পারেনি তাদের বাঁচাতে।
আমরা কেন বলি না যে আমার সম্প্রদায়ের ওপর যে হামলা তুমি করেছ, তোমার সম্প্রদায়ের ওপর সেই হামলা আমরা কখনোই করব না! আমরা কেন ভালোবাসা ছড়িয়ে দেই না?
পাঠকের মন্তব্য