ছক্কা ছয়ফুর: সিলেটের কেজরিওয়াল

৫২৩৯ পঠিত ... ১৬:৪৭, নভেম্বর ২৬, ২০১৮

দিল্লীর আম আদমি পার্টি আর তাদের নেতা কেজরিওয়ালের গল্প আমরা সকলেই জানি। কিন্তু বাংলাদেশে, বিশেষ করে আমাদের সিলেটে এরকম একেবারে তৃণমূল পর্যায় থেকে নেতা হয়েছিলেন, তাঁর গল্প আমরা কয়জন জানি? আসুন, তাঁর গল্পটি জানার চেষ্টা করি।

তাঁর নাম ছয়ফুর রহমান। পেশায় ছিলেন বাবুর্চি। খুব নামিদামি বাবুর্চি এমন নয়। সিলেটের সালুটিকর নামের একেবারেই গ্রাম্য বাজারের পাশের ছাপড়া ঘরের দিন আনি দিন খাই বাবুর্চি। তাঁর দ্বিতীয় পেশা ছিল ঠেলাগাড়ি চালনা। যখন বাবুর্চিগিরি করে আয় রোজগার হতো না, তখন ঠেলাগাড়ি চালাতেন। কিন্তু এই লোকটির ছিল অসম সাহস। যেকোনো ইস্যুতে তিনি একেবারেই জনসম্পৃক্ত রাজনীতি করতেন। ধরুন সালুটিকর থেকে শহরে আসার বাসভাড়া আটআনা বেড়ে গেছে, ছয়ফুর রহমান কোর্ট পয়েন্টে একটা মাইক বেঁধে নিয়ে ওইদিন বিকালে প্রতিবাদ সভা করবেনই করবেন। বক্তা হিসেবে অসম্ভব রসিক লোক ছিলেন। ছড়ার সুরে সুরে বক্তৃতা করবেন, তারপর মূল ইস্যু নিয়ে অনেক রসিকতা করবেন, কিন্তু দাবি তাঁর ঠিকই থাকবে।

তার বক্তৃতা শুনতে সাধারণ শ্রমজীবি মানুষের ভিড় হতো। তো, বক্তৃতা শেষ হওয়ার পরেই তিনি একটুকরো কাপড় বের করে সামনে রাখতেন, তারপর সবাইকে সিলেটের আঞ্চলিক ভাষায় বলতেন, 'আমি এই যে আপনাদের জন্য আন্দোলন করতেছি, আমার মাইকের খরচ দিবে কে? মাইকের খরচ দেন।' অদ্ভুত ব্যাপার হলো আমি তার অসংখ্য জনসভা কাছ থেকে দেখেছি, কোনোদিনই মাইকের খরচ উঠতে দেরি হয়েছে এমনটা দেখিনি। দুইটাকা, একটাকা করে তার সামনের কাপড়টি ভরে উঠত। তারপর যখন তিনশ টাকা হয়ে গেল তখন মাইকের খরচ উঠে গেছে, তিনি তার কাপড়টি বন্ধ করে দিতেন। অনেক সময় তার লেখা বই বিক্রি করেও জনসভার খরচ তুলতেন। অদ্ভুত কয়েকটি চটি সাইজের বই ছিল তার। একটির নাম এখনও মনে আছে--'বাবুর্চি প্রেসিডেন্ট হতে চায়।' সেই বইটির পেছনে তার দাঁত-মুখ খিচানো একটা সাদাকালো ছবি, নিচে লেখা 'দুর্নীতিবাজদেরকে দেখলেই এরকম ভ্যাংচি দিতে হবে।'

ছয়ফুর রহমান প্রথম দৃষ্টি আকর্ষণ করেন আশির দশকের শুরুতে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রার্থী হয়ে। তখন দেশে সরাসরি নির্বাচনের মধ্য দিয়ে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হতেন। তো, সব প্রেসিডেন্ট প্রার্থীর নিরাপত্তার জন্যই সঙ্গে পুলিশ দেয়া হলো। ছয়ফুর তাঁর নিরাপত্তার জন্য দেয়া পুলিশ প্রত্যাখ্যান করে বললেন, 'এদেরকে খাওয়ানোর সাধ্য আমার নাই।' তবু সরকারি চাপাচাপিতে তাকে নূন্যতম দুইজন পুলিশ সঙ্গে নিতে হলো। সে সময় দেখা যেত, রিক্সায় দুইপাশে দুই কনস্টেবল আর ছয়ফুর রহমান রিক্সার মাঝখানে উঁচু হয়ে বসে কোথাও যাচ্ছেন। নির্বাচনে খারাপ করেননি, সেই প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে তিনি ৬০/৬৫ জন প্রার্থীর মাঝে ৮ নম্বর হয়েছিলেন। তারপর এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, 'আমি দেশের ৮ নম্বর প্রেসিডেন্ট। ইলেকশনের দিন বাকি ৭ জন মরে গেলে আমি প্রেসিডেন্ট হতে পারতাম।'

অদ্ভুত এবং মজাদার সব নির্বাচনী অঙ্গীকার ছিল তাঁর। যেমন, দেশের কোনো রাস্তাঘাট পাকা করার দরকার নেই। রাস্তা তুলে দিয়ে সেখানে খাল করে ফেলতে হবে। নদীমাতৃক দেশে সেই খাল দিয়ে নৌকায় লোকজন চলাচল করবে, খালের পানিতে সেচ হবে--সব সমস্যার সহজ সমাধান। তাঁর দলের নাম ছিল 'ইসলামি সমাজতান্ত্রিক দল'। সেই দলে কোনো সদস্য নেয়া হতো না। এমনকি উনার স্ত্রীকেও সদস্য করেননি। উনি বলতেন, 'একের বেশি লোক হলেই দল দুইভাগ হয়ে যাবে।'


ছক্কা ছয়ফুর বেশ কয়েকবার নির্বাচন করেছেন, কখনোই তাঁকে গুরুত্ব দেয়া হয়নি, সবাই মজার ক্যান্ডিডেট হিসেবেই নিয়েছিল। কিন্তু তিনি ১৯৯০ সালের উপজেলা নির্বাচনে সিলেট সদর উপজেলায় নির্বাচিত হয়েছিলেন। সে এক কাণ্ড ছিল বটে।

যথারীতি ছয়ফুর রহমান প্রার্থী হয়েছেন। তাঁর প্রতীক ডাব। তিনি একটা হ্যান্ডমাইক বগলে নিয়ে একা একা প্রচার চালিয়ে যাচ্ছেন। পোস্টার লিফলেট কিছুই নেই। কিন্তু বক্তৃতা তীর্যক, বাকি প্রার্থীদেরকে তুলাধুনা করে ফেলছেন। এরকম এক সন্ধ্যায় সিলেটের টিলাগড়ে তার উপর অন্য এক প্রার্থীর কয়েকজন পান্ডা হামলা করে বসল।

পরের দিন সেই খবর গোটা শহরে ছড়িয়ে পড়ল। সাধারণ মানুষ বিরক্ত হলো--আহা, একেবারেই সাধারণ একটা মানুষ, তাঁর সঙ্গে গুন্ডামি করার কী দরকার ছিল!

ওইদিন বিকালে স্কুল ছুটির পর প্রথম মিছিল বের হলো সিলেট পাইলট স্কুলের ছাত্রদের উদ্যোগে। মিছিল লালদীঘির রাস্তা হয়ে বন্দর বাজারে রাজা স্কুলের সামনে আসার পর রাজা স্কুলের ছেলেরাও যোগ দিল। ব্যস, বাকিটুকু ইতিহাস। মুহুর্তেই যেন সারা শহরে খবর হয়ে গেল। সন্ধ্যার মধ্যেই পাড়া মহল্লা থেকে মিছিল শুরু হলো ছয়ফুরের ডাব মার্কার সমর্থনে। একেবারেই সাধারণ নির্দলীয় মানুষের মিছিল। পাড়া মহল্লার দোকানগুলোর সামনে আস্ত আস্ত ডাব ঝুলতে থাকল। রিক্সাওয়ালারা ট্রাফিক জ্যামে আটকেই জোরে জোরে 'ডাব, ডাব' বলে চিৎকার শুরু করে, সেই স্লোগান মেক্সিকান ওয়েভসের মতো প্রতিধ্বনি হয়ে এক রাস্তা থেকে আরেক রাস্তায় চলে যায়। অনেক প্রেসমালিক নিজেদের সাধ্যমতো হাজার দুইহাজার পোস্টার ছাপিয়ে নিজেদের এলাকায় মারতে থাকলেন। পাড়া মহল্লার ক্লাব-সমিতিগুলো নিজেদের উদ্যোগে অফিস বসিয়ে ক্যাম্পেইন করতে থাকল।

অবস্থা এমন হলো যে ছয়ফুর রহমানকে নির্বাচনী সভায় আনার এপয়েন্টমেন্ট পাওয়াই মুশকিল হয়ে গেল।

ছয়ফুর রহমান ছিলেন বীর মুক্তিযোদ্ধা। স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা সংসদ তাঁদের অফিস ছেড়ে দিল ছয়ফুরের নির্বাচনী প্রচার অফিস হিসেবে। পাড়ায় পাড়ায় ছেলেরা তাঁর নির্বাচনী জনসভার উদ্যোগ নিয়েছে। কিন্তু সেখানে আনতে হলেও আগে মূল অফিসে গিয়ে ৫শ টাকা এডভান্স করে আসতে হয়, নইলে ছয়ফুর রহমান আসেন না, কারণ তাঁর বাবুর্চিগিরি বন্ধ হয়ে গেছে, ফুলটাইম নির্বাচন করতে হলে সংসার খরচ দরকার। আমি জীবনে প্রথমবার (হয়তো শেষবারও) দেখলাম যে একজন প্রার্থীকে তাঁরই নির্বাচনী জনসভায় নিয়ে আসার জন্য উল্টো টাকা দিতে হচ্ছে।

নির্বাচনের দিন কী হলো, সেটা এখানে নিশ্চয়ই বলার প্রয়োজন নেই। খুব সম্ভবত শুধুমাত্র আওয়ামী লীগের প্রার্থী কোনোরকম জামানত রক্ষা করতে পেরেছিলেন, বাকি সবারই জামানত বাজেয়াপ্ত হলো। দক্ষিণ সুরমার এক কেন্দ্রে ছয়ফুর রহমানের ডাব পেয়েছিল ১৮০০+ ভোট, ঐ কেন্দ্রে দ্বিতীয় স্থানে থাকা প্রজাপতি মার্কা পেয়েছে সাকুল্যে ১ ভোট।

নির্বাচনের পরে ছয়ফুর রহমানের নাম পড়ে গেল ছক্কা ছয়ফুর। তিনি হাসিমুখে সেই উপাধি মেনে নিয়ে বললেন, 'নির্বাচনে ছক্কা পিটানোয় মানুষ এই নাম দিয়েছে।'

শেষ কথা:
উপজেলা চেয়ারম্যান হিসেবে ছক্কা ছয়ফুর সফল ছিলেন। তাঁর মূল ফোকাস ছিল প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষা ঠিক করা। হুটহাট যেকোনো প্রত্যন্ত অঞ্চলের প্রাইমারি স্কুলে ঢুকে পড়তেন। শিক্ষক অনুপস্থিত থাকলেই শো কজ করে দিতেন। সেই সময় প্রাইমারি স্কুলগুলো উপজেলা পরিষদের নিয়ন্ত্রণে ছিল অনেকটাই।

তবে ছয়ফুর রহমানকে চ্যালেঞ্জ নিতে হয় বিভিন্ন ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানদের কারণে। ইউনিয়ন পরিষদের দুর্নীতি বন্ধে তিনি ছিলেন আপোষহীন। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে চেয়ারম্যানরা একজোট হয়ে তাঁর বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব দিলে যতদূর মনে পড়ে তাঁর উপজেলা চেয়ারম্যানশিপ স্থগিত করে মন্ত্রণালয়। পরে ১৯৯১ সালে বিএনপি ক্ষমতায় এসে উপজেলা পরিষদ বাতিল করে দিলে ছক্কা ছয়ফুরের স্বল্পমেয়াদী জনপ্রতিনিধিত্বের চিরতরে ইতি ঘটে।

শেষ জীবনে তিনি অসুস্থ ও চিরকালীন দারিদ্রের সঙ্গে যুদ্ধ করেই মারা গেছেন। তাঁর মৃত্যুর তারিখ আমি নিশ্চিত জানি না। তাঁর শেষ সাক্ষাতকার আমরা সিলেটের দর্পন পত্রিকায় ছেপেছিলাম। পরবর্তী সময়ে দৈনিক কালের কণ্ঠের রাজকূট ম্যাগাজিনের জন্য তাঁর একটি সাক্ষাতকার নেয়ার জন্য সিলেট অফিসকে অনুরোধ করলে তাঁরা জানিয়েছিল ছক্কা ছয়ফুর কয়েক বছর আগে মারা গেছেন।

আজ অনেকদিন পর মফস্বল শহরের ছক্কা ছয়ফুরের কথা মনে পড়ল, আর গল্পটা শুনিয়েই দিলাম।

৫২৩৯ পঠিত ... ১৬:৪৭, নভেম্বর ২৬, ২০১৮

আরও eআরকি

পাঠকের মন্তব্য

 

ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে

আপনার পরিচয় গোপন রাখতে
আমি নীতিমালা মেনে মন্তব্য করছি।

আইডিয়া

কৌতুক

রম্য

সঙবাদ

স্যাটায়ার


Top