আগুনের দিন শেষ হয় না। ছোটোবেলায় আমার মায়ে বলত, আগুন নিয়ে খেলিস না বাপ, বিপদ হয়।
অথচ খানিক বড় হতেই দেখলাম বড়রা তাই করে বেড়াচ্ছে। আগুনের দিন কখনই শেষ হয় না। যদিও কোন লেখক জানি বলছিলেন, সমস্ত কিছুই শেষ হয়, তাই যুদ্ধ একদিন থামে।
কিন্তু এই উপত্যকার মানুষগুলো বড়ই অদ্ভুত। এরা একইসঙ্গে ভালো ও খারাপ। পরষ্পরকে স্নেহ করে, অপরের বেদনায় আকুল হয়। আবার দুইদিন বাদে তারে লাথি মারতেও দ্বিধা করে না। মৃত্যুকে ভয় পায় বলে বেঁচে থাকার ফন্দিফিকির বানায়! আবার দুই হাত শুন্যে তুলে সটান বুকে মৃত্যুকে জড়ায় নেয় ভয়ডরহীন ।
কিন্তু আমার বাপে বলত ভিন্ন কথা। আমার মায়েও। তারা বলত জল আর তেলের মেলা তফাৎ। বিশ্বাস রাখলে তারাও মিলে যায়। আমিও বিশ্বাস রাখছি, বাপে একদিন পঙ্গুত্ব ফেলায়ে একাই উঠে দাঁড়াবে। বিশ্বাস রাখছি, ভালো দিন আসবে আর দুনিয়াতে ভাল মানুষের সংখ্যা বেশি হবে। কিন্তু যে লোক আজ ভালো, দুদিন বাদে সে খারাপ হবে না তার নিশ্চয়তা কী? আমি নিজের বিশ্বাস ভাঙ্গাতে চাই না, কিন্তু মনের ভিতর কেবল প্রশ্ন জাগে এই উপত্যকায় কি স্বাভাবিক মৃত্যুর দিন শ্যাষ হতে চলেছে? বইয়ে পড়ছিলাম, মানুষের আয়ু একশত ত্রিশ বছর। একটা শিশুর বয়স কত? বা ধরেন আমার বয়সী একজন যুবকের বয়স? তারা ক্যান মরে যাচ্ছে? ইনসাফ বিকিয়ে দিয়ে স্থিতিশীলতা পেতে যারা রাজি নয় তাদের জীবন-মৃত্যুর হিসেব আলাদা। এইসব প্রশ্নের উত্তর নিশ্চয় তাদের অজানা নয়। আমার মতো করে আমারও জানা । তবে সে উত্তর অন্য কারও পছন্দ হবে কি? কে জানে! কার কাছে জানতে চাইব? কাউকেই তো চিনি নাই এই উপত্যকায়। আমার বাপের বাপ কিংবা মায়ের মায় চিনত। তারা তাদের দেশে থাকত, কিন্তু আমি তো আমার দেশে থাকি নাই, আমি থাকতাম একটা গার্মেন্টসে, যেখানে আমার শৈশব, কৈশোর থাকেনা, পরিচিত কেউ থাকে না। ওইখানের লোকেদের কাছে আমি অনেকের মতন একটা খেটে খাওয়া মানুষ, যে নগদে বীভৎস আগুন হয়ে উঠতে পারে না, আবার বড় নায়কও হয়ে উঠতে পারে না। আমি প্রায় সারাজীবন বিশ্বাস রাখছি অনেক কিছু নিয়াই, তাও এইসবের কিছুই কখনও হতে চাই নাই। কাজ করে দুইবেলা খেয়ে-পরে স্বাভাবিকভাবে মরতে চাইছিলাম।
তা পাইতেছি না দেখে জীবনে কেবল একবারই বিশ্বাস ভেঙে তর্ক করছি। সেই খেসারত আজ আমার পুরা পরিবার দিতেছে। কেবল আমিই জানি আজ কত দূরে আছি । শুধু তখন যদি জানতাম এমন পরিণতি, তাহলে হাজার কষ্ট হলেও তর্কে যাইতাম না। একাকী দূরে গিয়ে পরিবারের সাথে যে বেইনসাফি করলাম তা কী করে সহ্য করি? আমার ফ্লোর ইনচার্জ এটুকু যদি আগাম বলে দিতেন, এমন ভুল কি কোনোদিন হতো? আমি জানি, হতো না। সবাই বলত আমি কেবল অংকেই কাঁচা ছিলাম, কিন্তু এখন জানি ব্যাপারটা সত্য নয়। দুনিয়ার সকল বিষয়াদির হিসেবেই আমি কাঁচা, শিশুর মতো সহজ শিকার। তাতে কী? এই উপত্যকা অদ্ভুত। পবিত্র জিনিস এখানে দ্রুত শ্যাষ হয়। বড়দের আগুনের খেলায় পুড়ে, বহুতল গর্তে সময় নিয়ে ধীরে, যেখানে যেভাবেই হোক তারা শ্যাষ হয়ে যায়।
আমার খালি আফসোস হয় যদি শৈশবকে দূরে ফেলে, বাপের কথায় বিশ্বাস রেখে আরও কিছুদিন বেঁচে থাকা যেত, যদি আরও কিছুদিন এই দুনিয়ার আলো-বাতাস, বুকভরে নিশ্বাস নেওয়া যেত, কারও কি ক্ষতি হতো তাতে? জানি না। এখানে কেউ কিছু জানে না।
কাউকে চেনে না কেউ। বন্ধু বন্ধুকে নয়, ভাই তার বোনকে নয়। এমনকি বাপ তার সন্তানকে, নিজেও নিজেকে না। তবু তাদের জন্য বুকের ভেতরে ব্যথা হচ্ছে, সবাইকে কত আপন মনে হচ্ছে এখন! দুনিয়ার শেষ দিনে কত মানুষ আমারে স্নেহ করল, সাথে করে শহর ঘুরে ঘুরে, শীতের রাতে আগুন জ্বালায়ে নিজেরা উষ্ণতা নিল, আমারেও দিল। উল্লাস শেষে সকলেই বাড়ি ফেরে গেলো, কেবল আমিই ফিরতে পারলাম না। জানি না এ কেমন স্নেহের বিদায়! মায়ের কথা মনে পড়ছে। ছোটোকালে শোনা কথাটাও।
অপরাধী হলে হয়তো মাফ পাওয়া যেত। বাপের কথা ভুলে যাওয়া ছাড়া কোনো অপরাধ নাই বলে আমারে কেউ মাফও করে নাই। এখন সৃষ্টিকর্তা যদি মরা মানুষের দোষ মাফ করে আমারে দয়া দেখায়, তাহলে শুধু একটাই আকুতি করব, আমার পঙ্গু বাপ, আমার মা, বউ বাচ্চা সবাইরে যাতে আমার কাছে নিয়া আসে। আর কিচ্ছু চাইছি না। ওই মৃত্যু উপত্যকার চেয়ে এই জায়গাটাই এখন বেশি নিরাপদ।
দীপু দাস
গার্মেন্টসকর্মী
(যে কথা বলতে পারেননি)



পাঠকের মন্তব্য