আমি হাম্বীর, আমি ছায়ানট, আমি হিন্দোল

১২৬৫ পঠিত ... ১২:৪৯, ডিসেম্বর ২০, ২০২৫

সনজিদা খাতুনের বাবার নাম কাজী মোতাহার হোসেন। ওই যে বিখ্যাত সাহিত্যিক, কিন্তু পেশায় পরিসংখ্যানবিদ। আপাদমস্তক মওলানা। মাথায় টুপি আর মুখে ইয়া বড় বড় দাড়ি! অনেক সমালোচক বলেন, এই বাংলায় জন্ম নেওয়া সবচেয়ে মুক্ত পুরুষদের একজন এই কাজী মোতাহার হোসেন।

নজরুলের সঙ্গে ছিল খুব খাতির। ততদিনে নজরুল ‘বিদ্রোহী’ লিখে ফেলেছেন। তার খ্যাতি চারদিকে। মোতাহার হোসেনের মেয়েরাও গাইছেন ‘ভুলি কেমনে আজো যে মনে’, ‘বসিয়া বিজনে কেন একা মন ‘।

মোতাহার হোসেন শুনলেন একদিন। মেয়েরা কী নতুন সব গান গাইছে? গানের খাতা টেনে নিলেন। একটানে সব পড়ে ফেললেন। বললেন, ছোকরাতো ভালোই লেখে! নজরুলের সঙ্গে তার খাতির হয়ে গেল। নজরুল ঢাকায় আসলে ‘ওই কাজী’র বাড়িতেই ওঠতেন!

ভোরবেলা পায়চারি করতে করতে মোতাহার হোসেনও রবীন্দ্র-নজরুলের গান গুণগুণ করতেন। রবীন্দ্রনাথের ‘যদি বারণ কর তবে গাহিব না’, ‘মম যৌবননিকুঞ্জে গাহে পাখি—’। নজরুলের গানের মধ্যে ‘ভুলি কেমনে আজো যে মনে’। কিন্তু সুরতাল ছিল খুবই খারাপ। সবাই হেসে কুটিকুটি হয়ে যেত।

তখন ৫০ এর দশক। সনজিদা খাতুন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলার ছাত্রী, ওই দাড়িওয়ালা বড় টুপি পরা লোকটার মেয়ে গোটা আর্টস ফ্যাকাল্টিতে সবচেয়ে বেশি নম্বর পেয়ে বসে আছে। পরে শান্তিনিকতেন পড়তে গিয়েও সনজিদা খাতুন ‍খুব ভাল রেজাল্ট করেছিলেন। ফার্স্ট ক্লাস পেয়েছিলেন…

৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারিও তার ক্লাস ছিল। বাড়ি এসে সন্ধ্যার আজাদী পত্রিকায় দেখেন, পরের দিন কামরুন্নেসা স্কুলের গলিতে একটা মিটিং হবে। কিন্তু রাস্তায় সেনাদের টহল। মা তো একা ছাড়বে না। শেষমেষ মাও গেলেন সাথে। সনজিদা খাতুন তার জীবনের প্রথম বক্তৃতা দিয়ে ফেললেন। সেই সভায় তখনকার নামিদামি নারী নেত্রীরাও ছিলেন বটে, কিন্তু ভয়ে কেউ সভাপতিত্ব করতে রাজি হল না। সনজিদার মা হয়ে গেলেন সভাপতি।

৬০ এর দশকের মাঝামাঝি হুট করে পূর্ববঙ্গের রেডিও টিভিতে গান বাজনা সীমিত হয়ে গেল। বিশেষ করে রবীন্দ্র সংগীতের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করলো পাকিস্তান সরকার। বলা হল, ‘রবীন্দ্র সংগীত রাষ্ট্রের আদর্শের সঙ্গে সাংঘর্ষিক’। এরা রবীন্দ্রনাথকে ‘ভারতীয়’ ও ‘হিন্দু সংস্কৃতির প্রতীক’ মনে করত।

সনজীদারী গানে গানেই প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন। এই প্রতিবাদের মুখে সরকার বেশিদিন টিকতে পারেনি অবশ্য, ৬৮ সালের দিকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে নেয়।

কিন্তু তখন তো এই বাংলার প্রায় সব মানুষের মুখে মুখে ছিল গান। মানুষ ধান কাটতে, ধান ভানতে, হাঁটতে-বসতে গুণগুণ করতো। ঘরে ঘরে পুঁথির সুর। শিক্ষিত মানুষের অন্দরমহলে রবীন্দ্রনাথ ততদিনে অপরিহার্য হয়ে উঠেছেন।

৬১ সালে রবীন্দ্রনাথের জন্মশত বর্ষের কথা। সেই উৎসব উদযাপনের জন্য বহু সমমনা মানুষ সংগীতের নানা পসরা নিয়ে একত্রিত হয়েছিলেন। সেই মিলিত হওয়াটাই ছায়ানটে রূপ নিল।

‘ছায়ানট’ হয়ে ওঠার ইতিহাসটা খুব মজার। প্রথমে আসলে অনানুষ্ঠিকভাবে শ্রোতার আসর হতো। কে গাননি সেখানে? ফিরোজা বেগম, বারীণ মজুমদার, ইলা মজুমদার। সেতার বাজাতেন খাদেম হোসেন খান। ব্যস, আরতো শিল্পী নেই। সনজিদার বোন ফাহমিদাও গাইতেন মাঝেসাঝে।

একদিন ওয়াহিদুল হক (সনজিদা খাতুনের স্বামী) বলে বসলেন, ‘আমরা একটা স্কুল করব।’ কিন্তু এ কথা পাস করানো কঠিন। হাতে নেই কানাকড়ি। ওয়াহিদুল হক বললেন, ‘আমরা সবাই চাঁদা দেব।’ আস্তে আস্তে কে কত দেবেন, কথা হলো। প্রস্তাবটা পাস হয়ে গেল। সে বছরই ছায়ানট হয়ে গেল। নজরুলেরই গান থেকে শব্দটা নেয়া...

‘আমি হাম্বীর, আমি ছায়ানট, আমি হিন্দোল,

আমি চল-চঞ্চল, ঠুমকি ছমকি

পথে যেতে যেতে চকিতে চমকি—

ফিং দিয়া দিই তিন দোল্!

আমি চপলা-চপল হিন্দোল!’

শাস্ত্রীয় সংগীতের প্রাচীন ও মর্যাদাসম্পন্ন রাগও এই ছায়ানট!

তত দিনে মানুষ বুঝে গেছে, গোটা বাঙালি সংস্কৃতিটাই বিপদের মুখে পড়েছে। পাকিস্তানিরা আমাদের পাকিস্তানি মুসলমান বানাতে চায়, বাঙালি বলে স্বীকার করতে রাজি নয়। ওটা বুঝতে পেরেই সেই স্কুলে নজরুলগীতি, রবীন্দ্রসংগীত, নানা রকম যন্ত্র, রাগসংগীত শুরু হল। হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, দেবব্রত বিশ্বাস, কণিকা বন্দোপাধ্যায়, সুচিত্রা মিত্র সবাই গেয়েছেন সেখানে।

৭১ এর ২৫ মার্চ পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী আক্রমণ চালালে শিল্পীরা কলকাতায় আশ্রয় নেন। ওখানেই একটা গানের দল করলেন সনজিদা খাতুনেরা। ‘রূপান্তরের গান’ নামে একটা গীতি আলেখ্য হয়েছিল। লিখেছিলেন শাহরিয়ার কবীর। জহির রায়হান তখন ‘স্টপ জেনোসাইড’ নিয়ে ব্যস্ত। রবীন্দ্রসদনে শো হল, নানা জায়গায় অনুষ্ঠান করে তোলা চাঁদা মুক্তিযুদ্ধের জন্য গঠিত হওয়া তহবিলে জমা হতো।

তারও আগে, বাংলাদেশের মানুষের আবহমান সংস্কৃতিকে তুলে ধরতে পয়লা বৈশাখ উদযাপন শুরু হয়। ১৯৬৭ সালে রমনার বটমূলে সনজিদা খাতুনেরাই সেটা শুরু করেছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের বছর ছাড়া আর কখনও সেটা থামেনি।

২০০১ সালে রমনার বটমূলে বোমা হামলা হয়। বহু হতাহত হয়। আমার মনে আছে, তার পরের বছর আরও বড় পরিসরে বৈশাখ উদযাপন হয়েছিল। মানুষের ঢল নেমেছিল সেখানে।

সনজিদা খাতুন খুব কষ্ট পেয়েছিলেন তখন। বুঝলেন, এই দেশের মানুষ এই দেশের চেতনার সাথে বিচ্যুত হয়ে গেছে। ওদেরকে ফেরাতে হবে। ‘নালন্দা বিদ্যালয়’ নামে স্কুল খুললেন।

কাল সেই স্কুল ভেঙ্গে তছনছ করে ফেলল। মধ্যরাতে একটা ছবি দেখে বুকের ভেতরটা ধ্বক করে ‍উঠল। একটা পোট্রেট ছবির ভাঙ্গা কাঁচ ভেদ করে সনজিদা খাতুন বড় বড় চোখে তাকিয়ে আছেন।

এই দীর্ঘ যাত্রায় এমন কোনো দল নেই যারা ছায়ানটকে তাদের সাথে ভেড়াতে চায়নি। কিন্তু সনজিদা খাতুন কখনো কোনো দলের সাথে ভিড়তে চাননি। এমনকি বঙ্গবন্ধু পর্যন্ত বলেছিলেন, ‘আরে কী সুফিয়া কামাল আর সন্‌জিদা খাতুন ছায়ানট করবে? ওটা আমার হাতে দিক, দেখিয়ে দেব।’

সনজিদা খাতুন যাননি। তিনি মনে করতেন, ‘সরকারের সঙ্গে ঘেঁষা মানেই একটা ছাপ পড়ে যাওয়া।’

সেই ছায়ানটকে পুড়তে হলো। মেঝেতে পড়ে থাকা ভাঙা কাচের টুকরা ভেদ করে সনজিদা খাতুন বাঙালির বেঈমানি আর অধঃপতন দেখে মুচকি মুচকি হাসছেন।

ছায়ানটকে কেন পুড়তে হলো, সে কথা কি আর খুলে বলার দরকার আছে?

 

১২৬৫ পঠিত ... ১২:৪৯, ডিসেম্বর ২০, ২০২৫

আরও eআরকি

পাঠকের মন্তব্য

আইডিয়া

কৌতুক

রম্য

সঙবাদ

স্যাটায়ার


Top