পুরোনো রাজনৈতিক ব্যবস্থা নতুনকে ব্যর্থ দেখতে উন্মুখ

২০০ পঠিত ... ১৮:১৯, জুলাই ২৯, ২০২৫

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের একজন সদস্য চাঁদাবাজির দায়ে গ্রেফতার হবার পর পত্রিকার খবরে দেখলাম, তার কাঁচাবাড়ির জায়গায় দালান উঠছে। স্বাধীন বাংলাদেশে কাঁচাবাড়ি পাকাবাড়ি হবার আবহমান সংস্কৃতি হচ্ছে চাঁদাবাজি।

বিএনপির বর্ষীয়ান নেতা মির্জা ফখরুল বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পাঁচজন চাঁদাবাজ দেখে বেদনায় নীল হয়ে গেলেন। অথচ উনি মুক্তিযুদ্ধকে কাছ থেকে দেখেছেন। তিনি নিজেই দেখেছেন, মুক্তিযুদ্ধ থেকে ফিরে মুক্তিযোদ্ধারা কিভাবে পাকা দালান দখল করে এর মালিক হয়েছেন। ঢাকা শহরের কথিত অভিজাত এলাকা আলো করে যারা বসে আছেন; এদের বিরাট অংশের ঐ অভিজাত হয়ে ওঠার পেছনে রয়েছে দখলের নীল ইতিহাস।

স্বাধীনতার সুফল কুড়িয়ে আওয়ামী লীগের লোকেরা নতুন বুর্জোয়া হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে বাড়ি-ব্যবসা প্রতিষ্ঠান দখল করে।

এরপর বিএনপি ক্ষমতায় এলে শুরু হয় তাদের নতুন বুর্জোয়া হবার পালা। কাঁচাবাড়ি থেকে পাকাবাড়িতে ওঠার পালা। স্বাধীন বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি এই চাঁদাবাজির মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহের সংস্কৃতি চালু করে।

আর সরকারে চাকুরেদের নতুন বুর্জোয়া হবার শুরু পাকিস্তান আমলেই। রাজধানী উন্নয়ন কতৃপক্ষের নাম ছিলো ডিআইটি। সেই যে লটারির নামে নামমাত্র মূল্যে ঢাকা শহরে প্লট বিতরণ শুরু হয়; সেই থেকে কাঁচাবাড়ি থেকে পাকা বাড়িতে ওঠার কলাকৈবল্য হচ্ছে সরকারি চাকুরে ও কথিত বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবীদের ক্ষমতাসীন সরকারকে মনোরঞ্জন করা। ক্ষমতাসীন সরকারের অমুক ভাই ও তমুক ভাইকে তেলাঞ্জলি দিয়ে দশ কোটি টাকা মূল্যের প্লট বাগিয়ে এখন দেখবেন অনেকে বৈষম্যবিরোধী পাঁচটি চাঁদাবাজ ধরা পড়ার খবরে আঁতকে উঠছে।

আমরা তো সিম্পল লিভিল হাই থিংকিং-এর মন্ত্রে সমাজ গড়তে শিখিনি। বাড়ি-গাড়ি-ভুঁড়ি-ঘড়ি প্রদর্শনী যে সমাজে সাফল্যের সংজ্ঞা; সেখানে চাঁদাবাজিই তো মোক্ষলাভের প্রধান উপায় হয়ে দাঁড়াবে। পড়ালেখা দিয়ে আর কি হবে; টাকা হলেই হয়-এই হয়েছে বাংলাদেশ দর্শন।

বিটিভির নাটকের ড্রইং রুমের সাদাসিধে আসবাব যেদিন থেকে জবরজঙ্গ হয়ে উঠল; সেদিন থেকেই বোঝা গিয়েছিলো এ সমাজের স্থূল রুপান্তর।

ঠিক কত টাকা হলে চলে, তা ধারণা করতে পারার কোন ক্ষমতা নেই দুর্নীতি বসন্তে ফুলে ফেঁপে ওঠা লোকদের।

বেনজিরের ৬৫টি ব্লাউজ, হারুনের সানগ্লাস, খোকনের চুলের জেল, পিয়নের চারশ কোটি টাকা; এসবই হচ্ছে গরিবের ছেলেকে কোটালপুত্র হিসেবে ব্যবহার করার ফাঁদ।

বাংলাদেশের রাজনীতি হচ্ছে, গরিবের ছেলেকে হাজার কোটি টাকার মালিক হবার স্বপ্ন দেখিয়ে তাদের দিয়ে মানবতা বিরোধী অপরাধ করানো; ক্ষমতার জন্য চর দখলের লড়াই-এ গ্লাডিয়েটর-এ লেলিয়ে দেয়া। মির্জা ও শেখ সাহেবেরা তার দর্শক হয়েছেন, গরিবের ছেলে মরলে শহীদ বাঁচলে এমপি পদ্ধতিতে গণতন্ত্র ও রাজনীতি চর্চা করেছেন।

আর আছে দলীয় বুদ্ধিজীবী; তারা প্লট পদক পদবীর বিনিময়ে এই মাংসের কারবারটাকে রাজনীতির মর্যাদা দেবার বয়ান তৈরি করেন। বিশিষ্ট ব্যক্তি সেজে প্রথম আলোতে বিবৃতি দিয়ে নিজ নিজ দলের জন্য একচক্ষু কেরানি হিসেবে কাজ করেন।

পাকিস্তান আমলে যারা কেরানি হয়েছিল, তাদের ছেলে-মেয়েরা পড়ালেখাটা শিখে বেঙ্গল রেনেসাঁর ব্যাপ্টিজম নিয়ে রাজবুদ্ধিজীবী হয়েছে। দলীয় আশীর্বাদ আর পরিবারতন্ত্রের জাদুতে বিশ্ববিদ্যালয় ও জনপ্রশাসনে তাদের একচ্ছত্র আধিপত্য। এরা নিজ দলের অপরাধে চোখ বন্ধ করে আর প্রতিপক্ষের অপরাধে চোখ গোল গোল করে ন্যারেটিভ তৈরি করে টিকিয়ে রেখেছেন এই ক্যানিবাল রাজনৈতিক ব্যবস্থা। বেঙ্গল রেনেসাঁর ব্যাপ্টিজমের কারণে কাস্ট সিস্টেমের নেশা তাদের চোখে বায়েস্কোপের নেশার মতো। ফ্রিডেরিশে নিটশের যে আর্যকল্পনার অহংকার মস্তিষ্কে লালন করে নাৎসিরা পৃথিবীর ইতিহাসে ঘৃণিত; সেই ভ্রান্ত আর্যকল্পনা নিয়ে বুদ্ধিবৃত্তিক সমাজ আজ বিলয়ের মুখে। অথচ তাদেরই সমাজকে সততা, নৈতিকতা ও নৈর্ব্যক্তিকতার দিশা দেবার কথা ছিলো।

এখানে ডান আর বাম দলগুলো রয়েছে কথাবার্তার জমাখরচার কাজে। এই দলগুলো স্কুল থেকে ক্যাডার তৈরি করে পাঠচক্র করে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির জন্য মুখপাত্র সরবরাহ করে। ২০০১-০৬-এর সরকারে নৃশংসতার প্রেসক্রিপশন এসেছে ডান দল থেকে আর ২০০৯-২৪-এর সরকারে নৃশংসতার প্রেসক্রিপশন এসেছে বাম দল থেকে। মুখে অহিংসার গল্প, পবিত্র কুরানের বাণী, রবীন্দ্র সংগীত থাকলেও; ডান ও বামের মাথাভর্তি প্রতিশোধ প্রতিহিংসা আর ষড়যন্ত্র। ডানের কাজ স্বদেশের সংস্কৃতি সরিয়ে সৌদি সংস্কৃতি প্রতিস্থাপন। আর বামের কাজ স্বদেশী সংস্কৃতি নির্মিত হতে না দিয়ে কলকাতার সংস্কৃতি প্রতিস্থাপন। দিন-রাত এরা কালচারাল ওয়ার করে যাতে জরুরি জনগুরুত্বপূর্ণ ইস্যুগুলো সামনে আসতে না পারে।

এই যেখানে ৫৪ বছরের বাংলাদেশ রাজনীতির কম্পোজিশন; সেখানে জুলাই বিপ্লবে রাতারাতি দোজখ থেকে বেহেশতে রুপান্তরের যে দাবি; তা আসলে নতুন রাজনীতি প্রচলন করতে না দিয়ে পুরোনো রাজনৈতিক ব্যবস্থাটা টিকিয়ে রাখার কুমির কান্না। পুরোনো রাজনৈতিক ব্যবস্থা নতুনকে ব্যর্থ দেখতে উন্মুখ।

বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের তরুণ তরুণীকে বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতির চাঁদাবাজির বিনিময়ে জমিদার হবার যে অপসংস্কৃতি; তাকে আনলার্ন করতে হবে। বাংলাদেশের মেহনতি মানুষ, যারা অর্থনীতির চাকা ঘোরায়; তাদেরকে দলীয় পেশী দেখিয়ে চাঁদা নেবার যে ঘৃণ্য রাজনৈতিক অব্যবস্থা; সেটিকে ছুঁড়ে ফেলে দিতে হবে। পুরোনো রাজনৈতিক দলগুলোর মতো চাঁদাবাজি করা মানে; পুরোনো অব্যবস্থায় বিলীন হয়ে যাওয়া।

বৈষম্য বিরোধী ছাত্র-ছাত্রীদের মনে রাখতে হবে, তারা সৎ বলে, দেশের মানুষ তাদের ডাকে পথে নেমে এসে জুলাই বিপ্লব সংঘটিত করেছে। অসত কোন রাজনৈতিক দলের ডাকে সাধারণ মানুষ পথে নামে না। সততার শক্তি যে জাদুকরী; তার প্রমাণ জুলাই বিপ্লব। দুর্নীতি-চাঁদাবাজি যারা করে, তাদের জাদুকরি শক্তি নিঃশেষ হয়ে গিয়ে তারা গণশত্রুতে রুপান্তরিত হয়। পুরোনো রাজনৈতিক দলগুলোর চাঁদাবাজ ক্যাডার ও তাদের নেতাদের দেশবাসী যে ভীতিমিশ্রিত সমীহ দেখায়, এর চেয়ে বড় ঘৃণা আর হতে পারে না।

পৃথিবীতে ভীতির রাজনীতি পরাজিত হয়; জয়ী হয় ভালোবাসার রাজনীতি।

২০০ পঠিত ... ১৮:১৯, জুলাই ২৯, ২০২৫

আরও eআরকি

পাঠকের মন্তব্য

আইডিয়া

কৌতুক

রম্য

সঙবাদ

স্যাটায়ার


Top