আমেরিকা ইরানের তিনটি পারমাণবিক স্থাপনায় বোমা হামলা করার পর; ইজরায়েলের শাসক নেতানিয়াহু তার দেশের অভ্যন্তরে জনপ্রিয়তা সুসংহত করেছেন। ইজরায়েলে গত একসপ্তাহ ধরে ইরানে ইজরায়েলি হামলার বিপক্ষে ছিল যারা; এখন তারা নেতানিয়াহুর পক্ষে এসে দাঁড়িয়েছেন। বিশেষত ইজরায়েলের ইহুদিরা একাট্টা হয়েছেন। ঠিক এভাবেই নব্য উপনিবেশবাদী আগ্রাসন ধর্মযুদ্ধের চেহারা পায়, সে চেহারা দেয়া হয়।
মধ্যপ্রাচ্য ও দক্ষিণ এশিয়ায় বৃটিশ উপনিবেশের শেষলগ্নে বৃটেন ও আমেরিকা মিলে ইজরায়েল রাষ্ট্রটি সৃষ্টি করে নব্য উপনিবেশবাদের একটি স্থায়ী ঘাঁটি গড়ে। আমাদের চোখের সামনে ক্ল্যাশ অফ সিভিলাইজেশনের গল্প বলে এই ইঙ্গ-মার্কিন নব্য উপনিবেশবাদ মধ্যপ্রাচ্য ও আরববিশ্বে তার লুন্ঠন ও শোষণ জারি রেখেছে।
আপাতদৃষ্টিতে আমেরিকার সমর শক্তিকে নব্য উপনিবেশবাদের প্রধান অস্ত্র বলে মনে করা হলেও; ইঙ্গ-মার্কিন উপনিবেশবাদী শক্তির কালচারাল উইং জায়নিস্টরা এর প্রধান বুদ্ধিবৃত্তিক শক্তির জায়গা।
ধর্মীয় পুরাণের প্রমিজড ল্যান্ডের ফিকশনের ওপর ভিত্তি করে ইজরায়েল রাষ্ট্রটি সৃষ্টি হলেও; জায়নিস্টরা গোটা বিশ্বের লিবেরেলিজমের ঠিকাদারি নিয়েছে। ভারতের হিন্দুত্ববাদীরা ধর্মীয় পুরানের প্রমিজড ল্যান্ডের ওপর ভিত্তি করে অখণ্ড ভারতের স্বপ্ন দেখলেও; কলকাতার হিন্দুত্ববাদীরা যেভাবে সেকুলারিজমের ঠিকাদারি নিয়েছে।
হলিউডের চলচ্চিত্রে রাশিয়া, চীন কিংবা মধ্যপ্রাচ্যের মানুষকে যেরকম নিষ্ঠুর, অশিক্ষিত, বর্বর হিসেবে চিত্রিত করে সুপিরিয়রিটির কল্পনা তৈরি করা হয়; বলিউডের চলচ্চিত্রে একইভাবে পাকিস্তান অধুনা বাংলাদেশের মানুষকে স্থূল মুসলমান ও মৌলবাদী হিসেবে চিত্রিত করা হয়।
হিন্দুত্ববাদীরা গরিবের জায়নবাদী হিসেবে দক্ষিণ এশিয়ায় বিরাজ করছে।
জায়নিস্টেরা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে নাতসিদের ইহুদি গণহত্যার বয়ান দিয়ে নিজের প্যালেস্টাইন গণহত্যার অপরাধ ঢেকে রেখেছে। এখন ইরানে গণহত্যা করছে। ভারত ১৯৭১ সালে পাকিস্তানের বাংলাদেশ গণহত্যার বয়ান দিয়ে নিজের গুজরাট ও কাশ্মীর গণহত্যা যেভাবে ঢেকে রেখেছে। জায়নিস্টেরা ‘ওয়ার অন টেররের’ নাটক মঞ্চস্থ করে একে একে আফঘানিস্তান, ইরাক, সিরিয়া বিনাশ করেছে; এবার তাদের লক্ষ্য ইরান। হিন্দুত্ববাদীরা ওয়ার অন টেররের গল্প বলে পাকিস্তানে যুদ্ধ চালিয়ে গরিবের আমেরিকা সাজতে চেষ্টা করে; কিংবা বাংলাদেশে রেজিম চেঞ্জের সক্ষমতা দেখাতে চায়; যে কাজ আমেরিকা ইরাক-লিবিয়ায় করে দেখিয়েছে।
ইউরোপের এনলাইটেনমেন্ট কিংবা আমেরিকার লিবেরেলিজমের মালিকানা দাবি করে জায়নিস্ট বুদ্ধিজীবীরা যাকে তাকে রাইট উইঙ্গার বলে দেবার কর্তৃত্ব গড়েছে। তাদের দেওয়া এন্টি সেমিটিক তকমার ভয়ে পশ্চিমা বিশ্বের মানুষ অনেক সময় মুখ বুঁজে সহ্য করে এসব তকমা। বাংলাদেশে হিন্দুত্ববাদী প্রভাবিত বুদ্ধিজীবীরা ঠিক যেরকম ডানপন্থী ও রাজাকার তকমা দিয়ে সবাইকে চুপ করিয়ে রাখতে চায়। হলোকস্টের কলংক দিয়ে জার্মানি ও ইতালিকে দমিয়ে রাখা আর সন্ত্রাসবাদীর তকমা দিয়ে আরব বিশ্বকে আত্মবিশ্বাসহীন করে রাখা জায়নিস্ট কালচারাল উইং-এর প্রধান কাজ। জায়নিস্ট কালচারাল উইং-এর উস্কানিতে মানবতাবিরোধী অপরাধে আরাম; আর এর প্রতিক্রিয়ায় রাশিয়া কিংবা আরব বিশ্বের প্রতিক্রিয়া হারাম।
জায়নিস্টদের এই ইহুদি ধর্ম নিয়ে রাজনীতিকে প্রগতিশীলতা বলে দাবির হিপোক্রেসির প্রতিক্রিয়ায় ইসলাম ধর্ম নিয়ে রাজনীতির প্রবণতা বেড়েছে; হিন্দুত্ববাদীদের হিন্দু ধর্ম নিয়ে রাজনীতিকে প্রগতিশীলতা বলে দাবির হিপোক্রেসিই বাংলাদেশে ইসলাম ধর্ম নিয়ে রাজনীতির প্রবণতা বাড়িয়েছে।
জায়নিস্টদের মামা বাড়ির আবদার হচ্ছে; ইহুদি প্রজাতন্ত্র ইজরায়েল থাকতে পারবে, কিন্তু ইসলামি প্রজাতন্ত্র বলে ইরানে রেজিম চেঞ্জ করতে হবে। হিন্দুত্ববাদীদের মামা বাড়ির আবদার যেমন, ভারতে রাষ্ট্রক্ষমতায় হিন্দুত্ববাদীরা থাকতে হবে; কিন্তু বাংলাদেশে ভোটের মাঠে সংখ্যালঘু ইসলামপন্থীদের নিয়ে সারাদিন কুঁচ কুঁচ করতে হবে, বাংলাদেশ মৌলবাদিদের খপ্পরে পড়ে গেল গো ঠাকুর পো।
জায়নিস্টেরা হলোকস্ট নিয়ে কপাল চাপড়ে কাঁদতে পারে; হলোকস্টের ট্র্যাজেডি নিয়ে বুক ভাসিয়ে দেয়, জার্মানি ও ইতালিতে ফেলে আসা ভিটের গপ্পো করে কেঁদে আকুল হয়; অথচ প্যালেস্টাইনের মানুষের ওপর গণহত্যা চালানো ও তাদের ভূমি থেকে উচ্ছেদ যেন কিছু নয়; কারণ ঐ পুরো এলাকা তার পৌরাণিক গপ্পে প্রমিজড ল্যান্ড।
হিন্দুত্ববাদীরা যেমন সাতচল্লিশ নিয়ে কপাল চাপড়ে কাঁদতে পারে; বাংলাদেশে ফেলে আসা ভিটের গপ্পো করে আকুল হয়; অথচ গুজরাটে গণহত্যা ও মুসলিম উচ্ছেদ যেন কিছু নয়; কাশ্মীরে জীবন্ত কারাগার বানিয়ে উলটো কাশ্মীর ফাইলস মুভি বানায়; ভারতের মুসলিম নাগরিকদের জোর করে বাংলাদেশে পুশ ইন করে। আবার সংসদে পৌরাণিক গল্পের অখণ্ড ভারতের মানচিত্র টাঙ্গায়।
তবে ১৯৪৭-৪৮ সাল থেকে প্রচারিত জায়নিস্ট ও হিন্দুত্ববাদী ন্যারেটিভ বহু ব্যবহারে জীর্ণ হয়ে গেছে। জেন জি প্রজন্ম পুরোপুরি প্রত্যাখ্যান করেছে এইসব হিপোক্রেসি। প্যালেস্টাইন ইস্যুতে ইজরায়েলি ইতিহাসবিদ ইউভাল নোয়াহ হারারির তবে- কিন্তু; বাংলাদেশ ইস্যুতে ভারতীয় বুদ্ধিজীবী অনুরাধা দত্তের মোদি প্রগতিশীল বয়ান; বেশ ফাঁপা শোনায়।
ভারতের দ্বিতীয় প্রজন্মের মানুষেরা বৃটিশ ও আমেরিকার নীতি নির্ধারণী মহলে জায়গা করে নিয়েছে। ফলে ইরান হামলায় জায়নিস্ট ও হিন্দুত্ববাদী লবি দুটি একসঙ্গে কাজ করছে। জায়নিস্ট লবি প্র্যাকটিসিং ইহুদি না হলেও হিন্দুত্ববাদী লবিটি খুবই ধর্মান্ধ। ফলে পরিস্থিতি আগের যে কোন সময়ের চেয়ে গুরুতর।
তবে ইহুদি ও হিন্দুদের মাঝে বড় একটি অংশ; যাদের ন্যায় ও অন্যায়ের বোধ সুস্পষ্ট; তারা আগ্রাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী। তাই ক্ষমতা-কাঠামো ও পলিসি লেভেলের জায়নিস্ট ও হিন্দুত্ববাদীদের কারণে ইহুদি ও হিন্দুদের প্রতি কোন বিদ্বেষ যেন তৈরি না হয়; সে ব্যাপারে অত্যন্ত সচেতন থাকতে হবে।
মধ্যপ্রাচ্য ও আরব বিশ্ব আসলে আপন যৌবনে বৈরি; এর জ্বালানী মজুদ, নানা রকম খনিজ দ্রব্য ও দামি পাথর সমৃদ্ধ ভূগোল; নব্য উপনিবেশবাদকে প্রলুব্ধ করে আগ্রাসন চালাতে। জায়নিস্ট ও হিন্দুত্ববাদীরা এদের রেলিজিও-কালচারাল উইং। তাদের কাজ ব্যাপারটাকে ধর্ম যুদ্ধের চেহারা দেয়া।
ধর্মহীন চীনের বানিজ্য যুদ্ধ ইঙ্গ-মার্কিন ও পশ্চিমা নব্য উপনিবেশবাদের অর্থনৈতিক শ্রেষ্ঠত্বে চিড় ধরিয়েছে। কারণ অতীতে প্রাকৃতিক সম্পদ আহরণে যে পশ্চিমা প্রযুক্তির মনোপলি ছিলো; তাকে ভেঙ্গে দিয়ে চীন হাজির হয়েছে তার প্রযুক্তি সক্ষমতা নিয়ে। রাশিয়ার সমর্থনও সবসময় চীনের পক্ষে। ফলে নব্য উপনিবেশবাদের পৃথিবী ছোট হয়ে আসছে।
আফঘানিস্তান, ইরাক, সিরিয়ার পরে ইরানে আগ্রাসন আসলে ইঙ্গ-মার্কিন নব্য উপনিবেশবাদী ও জায়নিস্ট রেলিজিও কালচারালের চূড়ান্ত মুখোশ উন্মোচনের কাল। এইসব ক্যানিবাল আচার আচরণের মাঝ দিয়ে প্রমাণিত হবে ধর্ম নিয়ে রাজনীতিটা আসলে ইজরায়েল ও ভারত করে। যারা লিবেরেলিজমের চুরুট ধরিয়ে, রেড ওয়াইনের গ্লাস সামনে রেখে বড্ড কালচারাল মামা ও খালা হয়ে পিয়ানোর সামনে বসে থাকে; তাদের পিয়ানোর রিডে চাপ দিলে বোমা পড়ে ইরানে; পারমানবিক তেজস্ক্রিয়তা ছড়িয়ে মানুষ হত্যার হনন সংগীতকেই তারা এতোদিন শিল্পের মুখোশ পরিয়ে রেখেছিলো। তাদের রেড ওয়াইনের গ্লাসে ফিলিস্তিনি ও ইরানিদের রক্ত।
পাঠকের মন্তব্য