অসাম্যের শ্বাপদ সংকুল জঙ্গলে সাম্যের মৃ*ত্যু

৩৯৭ পঠিত ... ১৫:৪৩, মে ১৪, ২০২৫

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সাম্য নিহত হলো। সাম্যর পিতাকে মৃতদেহের পাশে কান্নায় ভেঙে পড়তে দেখে মনে হলো; পিতার বুক খালি হবার বিষাদসিন্ধু আমাদের এই জনপদ। সাম্য'র মা দাঁড়িয়েছিলেন সব হারানোর বিপন্ন বিস্ময় নিয়ে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি কনসার্টে সাম্যর হাস্যজ্জ্বল মুখ দেখলাম; একটি ভিডিওতে; সে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি হলের সাহিত্য সম্পাদক ছিল। শ্বাপদ সংকুল অরণ্যে একটু কোমল মানুষ মানেই অবধারিত মৃত্যু। সাম্যর বড় ভাই আমার অনুজপ্রতিমদের বন্ধুবৃত্তের আরেকজন কোমল মানুষ। তিনি মৃত্যু শোক প্রকাশ করেছেন ফেসবুকে। সেখানে প্রয়োজনীয় কথার বাইরে একটি অতিশয়োক্তি নেই।

সাম্য ছাত্রদলের সদস্য ছিল। বিএনপির অগ্রজ প্রতিম শোক প্রকাশ করেছেন মৃত্যুর খবরে বিষণ্ণ হয়ে। শোকপ্রকাশে তার শব্দচয়ন ছিল অত্যন্ত পরিমিত ও যৌক্তিক।

সাম্য ও তার দুই বন্ধু একটি বাইক নিয়ে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের রমনা কালী মন্দিরের গেট বের হতে গিয়ে একটি মোটর বাইকের সঙ্গে ধাক্কা লাগে। ঐ বাইকটির পেছনে আরও কয়েকটি বাইকে খুনির পার্টনার ইন ক্রাইমেরা ছিল। সামান্য কথা কাটাকাটির জেরে তারা সাম্যকে ছুরি মেরে হত্যা করে। পুলিশ এই অপরাধে অন্তত তিনজনকে গ্রেফতার করেছে। জিজ্ঞাসাবাদে এই হত্যাকাণ্ডের মোটিভ স্পষ্ট হবে।

কিন্তু ফেসবুকে যেহেতু সাম্য'র পিতা-মাতা-ভাইয়ের চেয়েও বেশি কাছের মানুষেরা থাকে; তারা অবিরত তাদের রায় দিতে থাকে। জুলাই বিপ্লবে সক্রিয় অধ্যাপিকা সামিনা লুতফা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে বিশ্বের অন্যান্য নগরের প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো উন্মুক্ত রাখার পরামর্শ রেখেছিলেন। ফলে সাম্যের একদল নতুন শুভাকাংখী বহিরাগত এসে সাম্যকে হত্যা করায় লুতফাকে দায়ী করে।

সাম্যের আরেকদল শুভাকাংক্ষী এই হত্যাকাণ্ডের জন্য ভিসিকে দায়ী করে। যেহেতু এই ভিসি টুঙ্গিপাড়ায় কিংবা জিয়া উদ্যানে রহমান এন্ড রহমান মাজারে ফুল দিয়ে ভিসির দায়িত্ব গ্রহণ করেননি; সুতরাং তাকে যেতে হবে।

সামিনা লুতফা একটু জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবারের মতো সেজে থাকেন বলে তার ওপর রাগ ইসলামপন্থীদের। আর ভিসি একটু জালালউদ্দিন রুমির মতো সেজে থাকেন বলে, তার ওপর রাগ হিন্দুত্ববাদীদের ও মোদি প্রগতিশীলদের। নিম্নবিত্ত ঘরের জগলুল কয়েকপাতা কুরান পড়ে লুতফাকে সহ্যই করতে পারে না। নিম্নবিত্ত ঘরের জগন্নাথ কয়েকপাতা গীতা পড়ে এই ভিসিকে সহ্যই করতে পারে না।

যে বিএনপি জামায়াতকে নিয়ে ২০০১-০৬ আমলে ভুলের পাহাড় গড়েছিল; সেই বিএনপিও আওয়ামীলীগের ২০০৯-২৪-এর ভুলের পর্বতের দিকে তাকিয়ে শিখেছে, বড্ড আধুনিক হতে গেলে নির্দলীয় লোককে জামায়াত বলে তকমা দিতে হয়। জামায়াত যেন দাড়ি-টুপি ও নামাজ পড়ার সোল এজেন্সি নিয়ে ফেলেছে। আসলে এই বিএনপির চাই এমন একজন ভিসি যে খালেদা জিয়াকে পা ছুঁয়ে সালাম করে আসবে; যে বিএনপির প্রবীণ শিক্ষকের বাজারের ব্যাগ টেনে শিক্ষক হয়েছে। চাকরস্য চাকর চাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি হিসেবে।

সাম্যর মৃত্যুর পর ভিসিকে ঘিরে ধরে কিছু তরুণ অছাত্রসুলভ আচরণ করলে, ভিসি বলেন, আমাকে মার! কোনো মৃত্যু ছাত্রকে লাইসেন্স দেয় না শিক্ষকের সঙ্গে অছাত্রসুলভ আচরণ করার। ফলে ভিসির প্রতিক্রিয়া নিউটনের তৃতীয় সূত্র মেনে হয়েছে।

এই ভিসি একজন আপাদমস্তক ভালো ছাত্র; সততার সঙ্গে শেখ হাসিনা ও খালেদার ফুটসোলজার গড়ার কারখানাটিতে একাডেমিক পরিবেশ ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করছেন। এটা তো সহ্য হবার কথা নয়। এইখানে ছাত্রলীগের অনুপস্থিতিতে ছাত্রদলের নরক গুলজার প্রয়োজন। প্রয়োজন বিএনপির চাকর ভিসি।

আর আছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে মাদ্রাসা বানাতে উন্মুখ ইসলামিস্টেরা যারা সামিনা লুতফার সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড চায় না। তারা চায়; এইখানে মেয়েরা হিজাব পরে মুখ ঢেকে ক্লাস করবে, এরপর হলে গিয়ে তসবিহ জপবে। আর টিনেজ ছাত্ররা একগাল দাড়ি আর সফেদ টুপি পরে ক্যাম্পাসব্যাপী নামাজ পড়ে বেড়াবে; যেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদে স্থান সংকুলান হচ্ছে না। নরেন্দ্র মোদীর যেমন একধর্মীয় ভারত চাই, ইসলামপন্থীদেরও চাই এক ধর্মীয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

আর আছে একদল সাধু সন্ন্যাসী; যাদের অন্তরে ভিন্নমতের রক্ততৃষ্ণা থাকে, তারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কোন সংকট এলেই গাঁজা পানের অভিযোগ আনে। পরিমিত গাঁজা ও মারিজুয়ানা ইউরোপ ও এমেরিকায় রিক্রিয়েশনাল ধুম্রপান বলে স্বীকৃত; যা স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর নয়। সৃজনশীলতার সঙ্গে এর সম্পর্ক সভ্যতার উজ্জ্বল মায়েস্ত্রোদের জীবনে পরীক্ষিত।

আসলে এরা চিন্তার মুক্তাঙ্গনের বিরোধী। এরা চায় ছেলে-মেয়েরা শুধু বিসিএস গাইড মুখস্থ করে ঠোঁট সাদা করে কেরানি হোক। এখানে শিল্প-সংস্কৃতির বিকাশের মাঝ দিয়ে সৃজনশীল মানুষ তৈরি হোক, তা এরা চায় না। নিজেরা একটি বৈচিত্র্যহীন ম্যাড়মেড়ে জীবন যাপন করে বলে; সবার জীবনকে এমন বিশুষ্ক দেখতে চায়।

বাংলাদেশের যে কোনো প্রান্তে যে কোনো হত্যাকাণ্ড বা অনাসৃষ্টিতে খুশি হবার জন্য রয়েছে আফসোস লীগ। সুতরাং সাম্য হত্যাকাণ্ডকে ঘিরে হালকা মনখারাপের দুর্বল অভিনয় করে খুশিতে বাকবাকুম হয়েছে নিষিদ্ধ টুঙ্গির ছেলে-মেয়েগুলো।

সাম্য জুলাই বিপ্লবের অগ্রণী সৈনিক। আওয়ামীলীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধ হওয়ায় ফেসবুকে সন্তোষ প্রকাশ করেছে। আওয়ামীলীগের সাইবার খুনি গ্যাং ঘোষণা দিয়েই রেখেছে জুলাই বিপ্লবীদের হত্যা করার। এরকম অসংখ্য ঘটনা ৫ আগস্টের পর থেকে ঘটে চলেছে। সাম্য হত্যাকাণ্ডের তদন্তে পুলিশ নিশ্চয়ই অপরাধের এই এঙ্গেলটিকেও বিবেচনা করবে।

খুনি যেই হোক পুলিশি তদন্তে তাকে খুঁজে দ্রুত বিচারিক প্রক্রিয়ায় তাদের শাস্তি দিতে হবে। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে কনসার্ট হলে সেখানে প্রতিটি গেটে পুলিশের উপস্থিতি নিশ্চিত করার কথা। পৃথিবীর যে কোনো দেশের কনসার্টে পুলিশের দায়িত্ব থাকে নিরাপত্তা নিশ্চিত করার। সেক্ষেত্রে কোনো গাফিলতি ছিল নিশ্চয়ই।

স্বার্থের বাজারে সাম্য হত্যাকাণ্ডকে কেন্দ্র করে নানারকম স্বার্থ বেচাকেনার ক্যানিবাল কোলাহলের মাঝে শান্ত ও স্থিতধী মস্তিষ্কে পুলিশ খুনিদের চিহিত করে আদালতের মাধ্যমে শাস্তি নিশ্চিত করবে; এই দাবি জানাই স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার কাছে।

৩৯৭ পঠিত ... ১৫:৪৩, মে ১৪, ২০২৫

আরও eআরকি

পাঠকের মন্তব্য

আইডিয়া

কৌতুক

রম্য

সঙবাদ

স্যাটায়ার


Top