লেখা: হাসনাহেনা বৃষ্টি
একজন নারী হাঁটু পর্যন্ত লম্বা একটা জামা পরে রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে বলে পাশ দিয়ে হাঁটতে থাকা তিনজন বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া মেয়ে তাকে কটূক্তি করে বলল, প্যান্ট পরে আয়, যা। এর উত্তরে যখন উক্ত নারী তাদেরকে জিজ্ঞাসাবাদ করল, তারা 'ফাকঅফবিচ' বলে হাঁটা দিলো। সেই নারী এটা নিয়ে ফেসবুকে প্রতিবাদ করল, তখন ওই মেয়েগুলোর একজন 'আমি বিবাহিত, আমার সংসার টিকবে না' নামক অবলা নারী কার্ড প্লে করে ওনাকে দিয়ে ভিডিওটি ডিলিট করাল। কিন্তু এরপর যা হলো, হাজার হাজার মানুষ দিয়ে তার আইডি রিপোর্ট করানো হলো। ম্যাসেঞ্জারে জঘন্য সব ভাষায় হাজার হাজার রেইপথ্রেট দেওয়া হলো। শেষমেশ তার ক্লোন আইডি বানিয়ে সেটিকে ভেরিফাই করে, সেই আইডি দিয়ে জামায়াত ইসলামের নানান ভিডিও পোস্ট করা হলো। এভাবে চলছে এখনও, সবাই এই তামাশা দেখলও। আমার আশেপাশের অনেক মানুষ যারা ওই নারীর খুব কাছের মানুষের ভান করে থাকে, তারা এটা নিয়ে কোনো বাক্যব্যয় করল না। কারণ সম্ভবত এই নারী ওনাদের আসলে ভেতরে ভেতরে খুব একটা পছন্দের না। অপছন্দের হওয়ারই কথা, এই নারী নানা সময়ে নানা কথায় ও কাজে ওনাদের পুরুষতান্ত্রিক আঁতে ঘা দিয়েছেন। যাই হোক, এটা হচ্ছে একজন জীবিত নারীর জীবনের গত কয়েকদিনের ঘটনা।
এবার একজন মৃত নারীর কথা বলি। রিকশার চাকাতে ওড়না পেঁচিয়ে তিনি মারা গেছেন। খুব বেশিদিন হয়নি বিয়ে হয়েছিল মেয়েটার। শান্ত, ভদ্র একটা মেয়ে, আপাতদৃষ্টিতে যেরকম মেয়ে আপনাদের মিসোজিনিকে স্যাটিসফাই করে, ওরকমই। সেই মেয়েটার এই মৃত্যু সংবাদের নিচে শত শত মানুষ কমেন্ট করেছে, ওড়না জায়গামতো না দিয়ে গলায় দিয়ে রাখে, আল্লাহ উচিত বিচার করেছে। এই একই কমেন্ট, মূলভাব একই, ভাষা আলাদা আলাদা। যেন আল্লাহপাক নামের যে ব্যক্তিটি বসে আছেন ওপরে, ওনার কাজ নারীর ওড়নার খবর নিয়ে নিয়ে তাদের উচিত শিক্ষা দেওয়া। এর চাইতে বড় কোনো দায় দায়িত্ব ওনার দপ্তরে আপাতত নেই।
এদিকে একদল লোক রাস্তায় নেমে নির্বিঘ্নে বাকস্বাধীনতার জোরে বলে যাচ্ছে নারীর কেন পর্দা করা উচিত, কেন ঘরে থাকা উচিত; রাস্তায় নামলেই নারীর সম্মান হানি হয়, যারা রাস্তায় নামতে চায় এরা ইচ্ছে করে সম্মানহানি করতে চায় বলেই নামে ইত্যাদি ইত্যাদি। অথচ এর বিরুদ্ধে কেউ যখন কিছু বলছে, তাদের আর বাকস্বাধীনতা থাকছে না, কারণ নারীর আবার 'বাক' কী? ভদ্র ঘরের নারীদের কথা বলার নিয়ম নেই। কেউ ভুল করে কিছু বলে ফেললেও তার বাড়ি ঘেরাও করে তাকে জনসমক্ষে ডেকে এনে অপমান অপদস্ত করে ক্ষমা চাওয়ানো হচ্ছে।
এই নিয়ে আলাপ করতে গিয়ে একটা ঘটনা মনে পড়ে গেল, একবার ট্রেন স্টেশনে দাঁড়িয়ে, এক মেয়ে জিন্সের প্যান্ট পরে থাকার মতন অপরাধ করায় একজন মাথা ঢাকা পর্দাশীল নারী, মেয়েটির কাপড় টেনে খুলে নিলো। আমি আমার বান্ধবীকে বললাম, আমার এই ঘটনা মনে আছে, আমি ভেবেছিলাম উনি হয়তো অশিক্ষিত, পড়ালেখা করেনি। পড়ালেখা করা মেয়েরা আরেকটু ভালোকিছু করবে আশা করেছিলাম। আমার বান্ধবী হেসে বলল, তুই কি বুঝতেছিস না যে ফ্যাক্টর এখানে ময়মনসিংহ সরকারি কলেজ আর নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটি না?
হ্যাঁ, আমি আসলে বুঝেছি। অনেক আগেই বুঝেছি, সমস্যা মূলত আমরা, আমাদেরকে নিয়েই সব ঝামেলা। যদিও শুধুমাত্র এক শ্রেণির নারীদেরকে নিয়ে কোনো সমস্যা নেই, যারা অলরেডি ভালোভাবে ব্রেইন ওয়াশড। খেয়াল করে দেখলে জানবেন, মিসোজিনিস্ট পুরুষ আর নারী, এদের রসুনের কোয়ার মতন সব এসে পেছন এক জায়গায় থিতু হয়েছে। সেখানে বসে এরা নারী হয়ে হোক বা পুরুষ হয়ে হোক, সমানভাবে অন্য নারীদেরকে হেনস্তা করে যাচ্ছে।
আসলে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এগুলো এত নিত্য নৈমিত্তিক ঘটনা, যে একটা সময় পরে কেউ কেউ বলে ফেলে, ইগনোর করো। আমরা সবাই তো আর ইগনোর করতে পারি না। আমি আসলে জানিও না কীভাবে ইগনোর করতে হয়। মাসল মেমোরির মতো এইসব রিয়্যাকশন আমার ভেতরে গেঁথে গেছে। আমার এসবের অভ্যাস হয় না। জীবনে বহু পুরুষ কুৎসিত হাত দিয়ে আমাকে স্পর্শ করেছে, এতে আমার অভ্যস্ততা হয়নি। জীবনে বহু পুরুষ আমার দিকে কুৎসিত দৃষ্টিতে তাকিয়েছে, কিন্তু এই দৃষ্টিকে হজম করে ফেলার ব্যাপারটা আমি আয়ত্ত করতে পারিনি।
কোথা থেকে বলতে শুরু করেছিলাম, কোথায় বলে শেষ করছি, বুঝে উঠতে পারছি না, খেই হারিয়ে যাচ্ছে। মানসিকভাবে বিধ্বস্ত হয়ে আছি। নারীর ওপরে একটা সমস্ত জাতির এই প্রচণ্ড ক্ষোভের কারণ কী? আমার এইসব লোকের কাছে জানতে ইচ্ছে করে, এরা কী জীবনে কোনোদিন কোনো নারীর গর্ভে থাকে নাই, নারীর স্তনের কাছে এদের ঋণের কথা এরা ভুলে গেছে, জীবনে কোনো নারীর আঁচলের তলে এদের স্থান হয় নাই, কোনো নারীর মায়া, মমতা, ভালোবাসার কাছে এরা ঋণী হয় নাই? আমার এমন ঘেন্না লাগে, আমার এমন ক্ষোভ হয়! আমার মনে হয় এমন কিছু একটা করি যেন এই মানবসভ্যতা এইখানে থেমে যায়। এই রিপ্রোডাকশানের আর কোনো দরকার নেই। দুনিয়ার বুকে শুধু ছড়িয়ে ছিটিয়ে অপমান আর লজ্জা ফেলে যাওয়া ছাড়া আমরা তো আর কিছুই করতে পারছি না। আমি এও বুঝি না, এই অপমান কেন আমাদের একার কেবল। এই অপমান পুরুষ কিংবা ওইসকল মিসোজিনিস্ট নারীর গায়ে কেন লাগে না!
প্রতিবার যখন এরকম একেকটা ঘটনা দেখি, একটা কথা মনে পড়ে, কেউ শুকর খায় না, কেউ গরু খায় না, নারীর মাংসটাই কেবল সার্বজনীন। এরকমই তো আসলে। সেই নারীতেও কোনো বাছবিচার নেই, হাঁটু অব্দি কাপড় পরা নারী হোক, সালোয়ার কামিজ কিংবা বোরকা পরা নারী হোক, জীবিত কিংবা মৃত নারী হোক, নারী কিংবা কিশোরী কিংবা কন্যাশিশু হোক, নানান ধরনের নারীর মাংসের স্বাদ এদের কাছে নানানভাবে উপাদেয়। একসময় মনে হত আইয়ামে জাহেলিয়ার সময় যে জ্যন্ত কন্যাশিশু পুতে ফেলত, তবু বরং ভালো ছিল, এই কঠিন দুনিয়ায় থেকেও বা কী লাভ? এই মেয়েটা রিকশায় ওড়না পেচিয়ে মারা গিয়ে আমাদের দেখিয়ে দিয়ে গেল যে আসলে নারী মরে গেলেও খুব একটা লাভ নেই। তাকে কাফনের কাপড়ে পুরোটা পেঁচিয়ে মাটির নিচে দাফন করে দেওয়ার পরেও একদল মানুষ তার পোশাক নিয়ে টান দেবে। আমার এমন হাসি পায়, যখন রাষ্ট্রে নারীর, ধর্মে নারীর অধিকার হ্যানত্যান নিয়ে কপচানো হয় সভা সেমিনারে।
নারীর কোনো রাষ্ট্র নেই, জীবন নেই, ঈশ্বর নেই, খোদা নেই। নারীর আছে কেবল একটা শরীর।
পাঠকের মন্তব্য