বাংলাদেশের সামগ্রিক রাজনৈতিক নেতৃত্বের পররাষ্ট্র কৌশল সামলানোর সক্ষমতা কতটা ভয়াবহ, তার কিছু উদাহরণ দেওয়া যাক।
প্রথম শুরুটা মাহফুজ আলমকে দিয়ে। তিনি ইতিমধ্যেই চাপে ছিলেন, যদিও এর আংশিক কারণ ছিল তার বিরুদ্ধে ফলস অভিযোগ যে তিনি হিযবুত তাহরীরের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন অতীতে। কিন্তু এত বিতর্কের মধ্যেও তিনি মোঘল বা সুলতানী আমলের বৃহত্তর বাঙলার মানচিত্র সহকারে পোস্ট দিলেন, যেখানকার একটা বড় অংশ এখন ভারতের মধ্যে পড়েছে। টাইমিংটা দেখেন।
তিনি তা-ও পরে সেটা মুছে ফেলেছেন।
অতিসম্প্রতি সরাসরি ভারতের উত্তরপূর্ব রাজ্য দখল করে নেওয়ার ডাক দিয়েছেন একজন সাবেক জেনারেল। যাকে কিনা কয়েকদিন আগেই সরকার একটি সংবেদনশীল কমিশনের প্রধান হিসেবে নিয়োগ দিয়েছিল। বিষয়টা এতটাই বিব্রতকর ছিল যে সরকারের পক্ষ থেকে আলাদা বিবৃতি দিয়ে তার থেকে ডিস্ট্যান্স করতে হয়েছিল। তিনি তো পোস্ট মুছেনইনি, আবার ঘাওড়ার মতো সরকারকে বকে দিয়েছেন।
এর মধ্যে আসিফ নজরুল শেয়ার দিলেন একটা কনস্পিরেসি থিওরি যে কাশ্মীর হামলা ভারতের আসন্ন নির্বাচনের সঙ্গে সম্পর্কিত। এর একদিন আগে-পরে তার সঙ্গে ছবি দেখা গেল হারুন ইজহারের মতো লোকের, অফ অল পিপল! এরপর সেটাও বিবৃতি দিয়ে পরিষ্কার করতে হলো।
কিন্তু কোনো কিছুই সাম্প্রতিক এই করিডোর বিতর্ককে ছাপিয়ে যেতে পারেনি।
যেই সরকার ভারতকে ঠান্ডা রাখতেই উঠে-পড়ে লেগেছে, সারাদিন যাকে আগুন নিভানোতে ব্যস্ত থাকতে হচ্ছে, সেই সরকার যাবে মিয়ানমারের যুদ্ধে, তাও আবার আর্মির সাপোর্ট না নিয়ে, যেখানে ট্র্যাডিশনালি আর্মিই এসব ক্ষেত্রে বেশি যুদ্ধংদেহী, সেটা ভাবাও আমাদের পক্ষে সম্ভব! কিন্তু এসব ধারণার এমনি এমনি ডালপালা গজায়নি।
সীমান্তবর্তী এলাকায় আরাকান আর্মির উপস্থিতি একেবারে ভিডিও আকারে প্রকাশিত হয়েছে বাংলাদেশি সংবাদ মাধ্যমে। আমি যেহেতু এক সময় এ নিয়ে ঘাঁটাঘাটি করতাম, বড়ও হয়েছি ওই অঞ্চলে, সেহেতু জানতাম যে আরাকান আর্মির লোকজন ঢাকায় পর্যন্ত অনায়াসে যাতায়াত করত, সেই হাসিনার আমলে। তারা হাসিনা সরকারের অনেক উঁচু পর্যায়ে যোগাযোগ করেছে। তারা হাসিনার কাছে চিঠি পর্যন্ত দিয়েছে।
সীমান্তে অনেক আগ থেকেই আরাকান আর্মির প্রেজেন্স ছিল। বাংলাদেশের সীমান্ত সবসময়ই অরক্ষিত ছিল, নিশ্ছিদ্র ছিল না। সেটা করা সম্ভবও না।
তার বাইরেও, হাসিনার মন্ত্রী, বীর বাহাদুর সহ বান্দরবান জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান, ইত্যাদি অনেক মারমা নেতা ও ব্যক্তিবর্গের পারিবারিক যোগাযোগ বার্মায়, বিশেষ করে রাখাইনে খুবই ডিপ। কক্সবাজারে রাখাইন গোষ্ঠী থেকে আওয়ামীলীগের সংরক্ষিত আসনের একজন এমপি ছিলেন, যার পরিবার ছিল অং সান সু চি পরিবারের খুবই, খুবই ক্লোজ।
রাখাইনে হওয়া সংঘর্ষের অনেক অ্যাক্টর বাংলাদেশে ছিল। এটার কারণ রাজনৈতিক বা ভূ রাজনৈতিক না। ভৌগোলিক ও ঐতিহাসিক। আজকে আপনার কাছে রাখাইন বা আরাকান দূরের বিদেশ মনে হতে পারে। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে দুই দেশের বা অঞ্চলের মানুষের বা ‘পিপল টু পিপল’ সম্পর্ক অনেক গভীরের, বহু প্রজন্মের।
আবার অন্য কথাও সত্যি। রোহিঙ্গাদের আরএসও’র সঙ্গে জামায়াতের সম্পর্ক ছিল। এগুলো নিয়ে বিস্তারিত আলাপ আছে।
কিন্তু বাংলাদেশের মানুষ তো এগুলো জানে না। হাসিনার আমলে এই বিষয়গুলো নিয়ে ফ্র্যাঙ্ক আলোচনা করা যায় নাই। এখন মিডিয়ায় যখন আরাকান আর্মি দেখানো হলো, দেশের মধ্যে প্রতিক্রিয়া হলো ভয়াবহ। মানুষ হতভম্ব হয়ে পড়ল।
কিন্তু ইউনূসের পররাষ্ট্র উপদেষ্টা ভদ্রলোক এই পালস ধরতে পারেননি। তিনি ঠুস করে সংবাদ মাধ্যমকে বলে দিলেন করিডোর নিয়ে আলোচনার কথা। সাংবাদিক হিসেবে সরকারি তথ্য মানুষের জানার ঘটনায় আমি খুশিই হই। কিন্তু উপদেষ্টা ভদ্রলোক বুঝিয়ে বলতে পারেননি ঘটনাটা আসলে কী, উল্টো এমন এক রহস্যের ভান করে জবাব দিয়েছেন যে মনে হয় ভেতরে কী না কী হচ্ছে।
বাস্তবে বিষয়টা ছিল এমন যে, জাতিসংঘের পক্ষ থেকে প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে মানবিক করিডোরের। কিন্তু করিডোর শব্দটা বলতে বাংলাদেশের মানুষ দেশের পেটের ভেতর দিয়ে জায়গা করে দেওয়াকেই বোঝায়। ঘরের করিডোর যেমন। কিন্তু এখানে তেমন করিডোরের প্রয়োজনই নেই। সীমান্ত দিয়ে ত্রাণ কর্মীরা ঢুকবে, আর ফেরত আসবে, এবং তাদের নিরাপত্তা উভয় পক্ষ নিশ্চিত করবে। সেখানে কোনো পক্ষ হামলা করবে না। এটাই এই প্রেক্ষাপটে করিডোর।
কিন্তু তার চেয়েও বড় কথা হলো, জাতিসংঘ প্রথমেই বলেছে যে এই করিডোর অবশ্যই হতে হবে বার্মিজ আর্মি বা সরকারের সম্মতিতে। তাদের সম্মতি ছাড়া এটা হবে না। আমাদের দেশে অনেকেই ধারণা করছেন, করিডোর দিয়ে আমরা মিয়ানমার আর্মির বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে কনফ্লিক্ট-এর অংশ হচ্ছি। তাদের এই ধারণা হওয়ার যথেষ্ট কারণ আছে। কিন্তু যেই করিডোর চীনের ব্লেসিংস আর বার্মিজ আর্মির সঙ্গে এগ্রিমেন্টের মাধ্যমে হতে হবে, সেখানে এই ঝুঁকি নেই। এই কথাগুলো অনেক পরে এসেছে, কিন্তু কেউ এখন আর কনভিন্সড না।
মানুষ পররাষ্ট্র উপদেষ্টার প্রিম্যাচিউর বক্তব্যের জেরেই জলে উঠল। বিএনপির পক্ষ থেকে গাজার সঙ্গে তুলনা করা হলো। তারেক রহমান নির্বাচিত সংসদের কথা বললেন। এমনকি এনসিপি পর্যন্ত আলোচনা করার কথা বললো। সরকার এমনকি বিষয়টি নিয়ে মিয়ানমারের সঙ্গে যোগাযোগেরই সুযোগ পায় নাই। তার আগেই এখন তাকে ড্যামেজ কন্ট্রোল করতে হচ্ছে।
এরপর আওয়ামীলীগ আর বামদের কথা কী বলব। এত কনস্পিরেসি এরা গিলতে পারে, মাই গড! ডোনাল্ড ট্রাম্পকে হাতে পায়ে ধরেও আপনি এখন বার্মার আশেপাশেও আনতে পারবেন না। পুরো আমেরিকার সরকার কেটে কিছু রাখতেছে না ভদ্রলোক। রোহিঙ্গাদের জন্য ন্যূনতম খাদ্য সহায়তা ছাড়া সব অফ। সে পারলে ওইটাও বন্ধ করে দেয়। ইউক্রেনকে একেবারে গালিগালাজ করে সে চুক্তিতে রাজি করাচ্ছে। ইউএনকে তার প্রশাসন দুই আনার দাম দেয় না। আর সেই ইউএনকে ব্যবহার করে আমেরিকা এইখানে ঢুকবে, এগুলো ভাবতে অনেক উর্বর মস্তিষ্ক লাগে।
ইউএন এখানে যা করবে সেটা চীনের সমর্থন নিয়ে করবে বা করতে হবে। কিন্তু কারে আপনি কী বোঝাবেন। গল্প আর রহস্য করে বললে পাবলিক খায়।
কিন্তু আরেকটা পার্টির সমর্থকরা এখানে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে: জামায়াত-শিবির। তারা উদ্বেগ প্রকাশ করতেই পারে। কিন্তু মজার কথা হলো, তারা করেছে আর চেয়েও আরও সর্বনাশা কাজ। তারা চীনা কূটনীতিকদের গিয়ে বলে এসেছে আরাকানকে রোহিঙ্গাদের জন্য স্বাধীন করে দেওয়া হোক!
এইটা শুনে চীনের লোকজন থ হয়ে বসে ছিল! বলে কী এরা!
যেই চীনের সঙ্গে বার্মার সম্পর্ক দশকের পর দশকের, যেই চীন দীর্ঘদিন ধরে বার্মিজ সরকার আর আরাকান আর্মি উভয়কেই টিকিয়ে রেখেছে, যেই চীন জঙ্গি সন্দেহে উইঘুরদের সাফ করে ফেলেছে, ওয়্যার অন টেররের ভয়াবহ সংস্করণ নিজের দেশে বাস্তবায়ন করেছে, সেই চীনকে গিয়ে আরএসও’র মতো জঙ্গি তকমা পাওয়া গোষ্ঠীর সঙ্গে সম্পর্ক থাকা একটা ইসলামিস্ট দল বলে এসেছে, আরাকান দখল করে ফেলতে হবে!
জাস্ট চিন্তাটা একবার করেন।
এরা হলো, বাংলাদেশের নেতৃত্ব। হাউ উড ইউ টেইক দেম সিরিয়াসলি?



পাঠকের মন্তব্য