চৈত্র মাসের দগদগে রোদে যখন মাটি ফেটে চৌচির, গাছের পাতায় ধুলা জমে আর মানুষ ও পশুপাখির প্রাণ ওষ্ঠাগত, তখন বৃষ্টির আশায় গ্রামের মানুষ আশ্রয় নেয় নানা লোকজ আচার-অনুষ্ঠানে। এরই একটি পুরোনো ও পরিচিত রীতি—ব্যাঙের বিয়ে। প্রচলিত বিশ্বাস, ব্যাঙের বিয়ে দিলে প্রকৃতি সাড়া দেয়, আকাশ গর্জে ওঠে, আর বর্ষার বার্তা নিয়ে নামে বৃষ্টি।
এই কল্পনাপ্রবণ ও লৌকিক বিশ্বাসকে ধরে রেখেই চৈত্রের শেষ দিন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা বিভাগ ও নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগ মিলে আয়োজন করে অভিনব এক অনুষ্ঠান—ব্যাঙের বিয়ে। তবে এখানকার আয়োজন কেবল বৃষ্টির জন্য প্রার্থনার মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়; এটি হয়ে উঠেছে একটি সাংস্কৃতিক উৎসব, যা পুরোনো বছরকে বিদায় এবং নতুন বছরকে বরণ করার এক সৃজনশীল উপায়ও।
চারুকলার শিক্ষার্থীরা চৈত্রসংক্রান্তির কয়েক সপ্তাহ আগে থেকেই প্রস্তুতিতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। চৈত্রসংক্রান্তিতে ব্যাঙের বিয়ের জন্য দুটি ব্যাঙের মোটিফ বানানো হয়েছে। এর সঙ্গে পহেলা বৈশাখ উপলক্ষে হাতে তৈরি হয়েছে রঙিন মোটিফ—সাদা পায়রা, গাজির পট, ঘোড়া, রঙিন মুখোশ, মাটির সরা, প্যালেস্টাইনের সঙ্গে সংহতির প্রতীক মুষ্টিবদ্ধ হাতসহ আরও বিভিন্ন রকম লোকজ মোটিফ। প্রতিটি শিল্পকর্মে উঠে আসে বর্তমান সময়ের বাস্তবতা ও সাংস্কৃতিক চেতনার সম্মিলন।
বিশ্ববিদ্যালয়ের দুটি কলা ভবন—পুরোনো কলা ও নতুন কলা—এবার রূপ নিয়েছিল পাত্র ও পাত্রী পক্ষের বাড়িতে। নতুন কলা ভবন থেকে ঢাকঢোল, উপহারসামগ্রী আর পাত্রপক্ষের উল্লাসী মিছিল নিয়ে পাত্র রওনা হয় পুরোনো কলা ভবনের দিকে। বরপক্ষের লোকজন তখন অধীর আগ্রহে অপেক্ষায়।
বর পৌঁছানোর পর শুরু হয় প্রতীকী বিবাহের পানচিনির আয়োজন। এ সময় কনের বাড়িতে চলছিল বরপক্ষকে আপ্যায়নের কাজ। বরপক্ষ-কনেপক্ষের বাড়িতে আসার পরপরই শুরু গ্রামীণ ভাষায় তর্ক-বিতর্ক বা বাহাস। অনেকক্ষণ ধরে চলে দুই পক্ষের কথা কাটাকাটি। তারপর সম্পন্ন হয় আংটিবদলের পর্ব। বর ব্যাঙকে আংটি পরিয়ে দেন কনের বাবা, নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগের সিনিয়র শিক্ষক অধ্যাপক রশীদ হারুন। কনে ব্যাঙকে আংটি পরিয়ে দেন বরপক্ষের অভিভাবক, কলা ও মানবিক অনুষদের ডিন অধ্যাপক মোজাম্মেল হক।
হিন্দু রীতিতে ধুমধামের মধ্য দিয়ে বিবাহবন্ধনের পূর্বে পানচিনির আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন হয়। পুরুষ ব্যাঙের মাথায় মুকুট, আর নারী ব্যাঙের মাথায় ঘোমটা পরিয়ে তাদের বিয়ের পূর্বের আনুষ্ঠানিকতা শেষ হয়। পানচিনির পরে অতিথিদের আপ্যায়নে ছিল মিষ্টান্ন ও নানা রকম শুকনা খাবার। আয়োজকদের ভাষ্য, আসছে আষাঢ়ে তাদের বিয়ে দেওয়া হবে। অনুষ্ঠানের শেষ অংশে ছিল সবার অংশগ্রহণে নাচ-গান আর হাসি-আনন্দে ভরপুর উদযাপন।
এই ব্যতিক্রমধর্মী আয়োজন কেবল হাস্যরস আর বিনোদনের উৎস নয়; এটি দুই কলা ভবনের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের মধ্যে সংযোগ স্থাপনের উদ্দেশ্যে অনুষ্ঠিত হয়েছে। একই সঙ্গে পরিবেশ-সচেতনতা এবং সমকালীন বিশ্বের নানা ইস্যুতে শিক্ষার্থীদের অবস্থান জানান দেওয়ার একটি অনন্য মাধ্যম। জাহাঙ্গীরনগরের সাংস্কৃতিক ধারায় এটি যুক্ত করেছে এক অভিনব মাত্রা।
পাঠকের মন্তব্য