তুমি আমাকে আর কি দেবে রাজা আমার আছে ছাত্ররাজ্য

২১ পঠিত ... ৫ ঘন্টা ২ মিনিট আগে

সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম হঠাৎ করে চলে যাননি; ট্রেনের টিকেট কেটে রেলস্টেশনের ওয়েটিং রুমে একটু গুছিয়ে বসলে; আমরা বুঝতে পারি এই বিষণ্ণতার শহর ছেড়ে যাবার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তিনি। 

সেই নব্বই দশকের মাঝামাঝিতেই তিনি থাকা না থাকার গল্প বলেছিলেন। থাকা এবং না থাকার মাঝে পার্থক্য সুনিশ্চিত করতে পারেননি; কিন্তু যতক্ষণ থেকেছেন; থাকার মতো থেকেছেন; ছোট ছোট আনন্দ নিয়ে বেঁচেছেন। যতক্ষণ এ শহরে খোলা আকাশ ছিল; প্রশস্ত জানালা ছিল; জানালার ওপাশে কড়ই গাছে পাখিরা কিচিরমিচির করত; ততক্ষণ তিনি প্রেম ও প্রার্থনার গল্প লিখেছেন।

ব্রিটিশ কাউন্সিলের পাশে হলুদ রঙের দালান থেকে নেমে শতবর্ষের বৃক্ষের ছায়ায় হাঁটতে হাঁটতে তিনি পৌঁছে যেতেন কলাভবনে। সে কালে জাদুকর মঞ্চে এলে দর্শক যেমন উল্লসিত হতো; তিনি সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় ইংলিশ ডিপার্টমেন্টে প্রবেশের সঙ্গে সঙ্গে ছাত্র-ছাত্রীর মনে আনন্দ ঝিলিক দিত। তিনি  যোগাযোগের গভীর সমস্যা নিয়ে কয়েকজন একা একা লোকের একজন ছিলেন; অথবা যোগাযোগের গভীর সমস্যা নিয়ে কয়েকজন একা একা লোকের মধ্যে যোগাযোগের সেতুবন্ধ গড়তেন।

সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম শিক্ষক ও ছাত্রের সম্পর্কের শত বছরের ব্যকরণ গ্রন্থ ওপাশে রেখে প্রতিটি ছাত্রের সঙ্গে এমন গভীর সম্পর্ক রচনা করেছিলেন যা অবিশ্বাস্য। অভিব্যক্তিতে একটু লাজুক অথচ সহজাত মৌলিক মানুষ ছিলেন।

তিনি মনে করতেন, শিক্ষক ভালো পড়ালে ছাত্র ক্লাসে আসতে বাধ্য হবে; কিন্তু শিক্ষক বোরিং হলে ছাত্র ক্লাসে আসবে না। আমার শিক্ষাজীবনের প্রায় পুরোটা সময় উনি ইংলিশ ডিপার্টমেন্টের চেয়ারম্যান ছিলেন। ফলে ক্লাসে অ্যাটেনডেন্সের লালফিতার ফাঁসমুক্ত ছাত্রজীবন উপহার দেওয়ায় ওনার প্রতি কৃতজ্ঞতার অন্ত ছিল না।

প্রথম ক্লাসে উনি চক দিয়ে বোর্ডে অ্যাসথেটিকস শব্দটি লিখেছিলেন। এই অ্যাসথেটিকস চিন্তায়, আচরণে, বাক-সক্রিয়তায়, সৎ জীবন-যাপনে, এমনকি তার পোশাকে ছিল। উনি অন্ধকার ও আলো দেখার গল্প লিখলেও এ ছিল মসৃণ আলো দেখার আকাঙক্ষা। কারণ জীবনকে কখনও জটিলভাবে নেননি তিনি। যে মানুষ ছাত্র পড়ানোর মাঝে জগতের সবচেয়ে বড় সুখ খুঁজে পান; এ শহরে তাকে অসাড় সুখের আলেয়া দেখাবে; তা কার সাধ্য। 

আমি আর্মির আইএসএসবিতে চান্স পাওয়ায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে চাইনি। তাই আমার আম্মা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘ঘ’ ইউনিটে ভর্তির ভাইভায় উপস্থিত হয়ে জানান, তিনি চান আমি ইংরেজিতে ভর্তি হই। সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম সঙ্গে সঙ্গে বলেন, লিখিত পরীক্ষায় ভালো করেছে; আগের রেজাল্টও ভালো; সুতরাং এ নিয়ে ভাববেন না; ওকে ইউনিভার্সিটিতে ফেরান।

এই ঘটনার কারণে স্যার আমাকে চোখে চোখে রাখতেন; ডিপার্টমেন্টের করিডোরে আড্ডা দেওয়ার সময় হঠাৎ স্যার পেছন থেকে ফোড়ন কাটতেন, করিডোরের ক্লাসে এলাম; নিশ্চয়ই এটা ক্লাসরুমের চেয়ে মজার।

চার বছরের কোর্সে প্রতি বছরই স্যার কীভাবে যেন আমার টিউটর হতেন। স্যার একজন পণ্ডিত মানুষ। অথচ আমাকে অনেকটা বুঝতে না দিয়ে বিশ্বসাহিত্যের জগতের নতুন নতুন গল্প-উপন্যাসের খোঁজ দিতেন। পরিচয় করিয়ে দিতেন নতুন লেখকদের সঙ্গে।

আমি তখন গ্রিক মিথ পড়ে অবসর সময় কাটাতাম। প্রত্যেক নবীন বরণে খোলা চিঠি লিখতাম নবীনদের প্রতি। গ্রিক মিথের অ্যালেগরি ব্যবহার করে লেখার কারণে অনেকের পক্ষেই এর পুরো অর্থ উদ্ধার করা কঠিন। কিন্তু স্যার আমাকে ডেকে নিয়ে যেতেন তার রুমে। চা-বিস্কিট আনিয়ে  খোলা চিঠি পাঠ করতেন। উনি বললেন, ‘মর্ফিউস ঘুম পাড়াবে, থ্যানাটস পান করাবে লীথি নদীর জল, আবার শেষে এসে লিখেছ, এঁকে দিলাম লক্ষ্মণরেখা’; এরপর হাসতে হাসতে বললেন, ক্যাম্পাস লাইফকে ভালোই বর্ণনা করেছ দেখছি। এরপর একদিন সঙ্গে করে বাসায় নিয়ে গিয়ে খানিকটা খুশিজল পরিবেশন করলেন। আমি তখন বিষণ্ণতার শহর লিখছি। সেটা শুনতেই এই আয়োজন।

স্যার আমার শেভ না করা, শার্ট ওপরে দিয়ে পরা আর আড়ং-এর স্যান্ডেল পরে ঘোরাঘুরিকে ঠাট্টা করে বলতেন, কেয়ারফুলি কেয়ারলেস। আর কোনোদিন ক্লিন শেভ করে শার্টটা ইন করে স্নিকার্স পরে গেলে; হুট করে এসে জিজ্ঞেস করতেন, কি ব্যাপার ডেট আছে নাকি আজ! সৈয়দ মুজতবা আলী যে স্যারের মায়ের মামা; এটা আলাদা করে বলার দরকার নাই; ওনার ডার্ক হিউমারের মধ্যে সৈয়দ নানা বসবাস করতেন। 

পরীক্ষার আগে ডেকে বললেন একবার, তোমার ফর্ম থেকে ছবি চুরি হয়ে গেছে; বুঝতেই পারছ এটা তোমার নারী বন্ধুদের কারও কাজ। এখন থেকে কয়েক কপি করে ছবি রেখে যেও আমার অফিসে।

ডিপার্টমেন্ট থিয়েটারে ড. ফস্টাসের পরনে হোসাইন মোহম্মদ এরশাদের প্রিন্স কোর্ট আর জেল দিয়ে চুল ব্যাক ব্রাশ করানোর পরে; নাটক চলার সময়েই আমাকে গুঁতো দিয়ে বলেন, ডিরেক্টর যতই চালাকি করো তুমি; সবাই বুঝতে পারছে এটা ড. ফস্টাস নাকি এরশাদ।

সৈয়দ মনজুরুল ইসলামের প্রায় প্রতিটি ছাত্রের সঙ্গেই এরকম আনন্দময় স্মৃতির গল্প আছে। এমনকি তরুণ লেখক হিসেবে যারাই তার সান্নিধ্যে এসেছে; এমন অসংখ্য স্মৃতি জমা হয়েছে তাদের সঙ্গে। কথাসাহিত্যিক হিসেবে স্যারের নিজের লেখালেখি নিয়ে আলোচনাটা উনিই কম হতে দিয়েছেন। বরং তরুণ লেখকদের লেখা পাঠ আর তা নিয়ে আলাদা করে ফিডব্যাক দেওয়ার বিষয়টা প্রাধান্য পেয়েছে তার জীবনে।

তিনি ঢাকার সাহিত্য রেনেসাঁর শিক্ষক হিসেবে পুরো একটা জীবন কাটিয়েছেন। মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতির রেনেসাঁ সামষ্টিক স্মৃতি থেকে মুছে যাওয়ায়; তিনি সেই রেনেসাঁর প্রত্ন খনন করে বর্তমানের মঞ্চে দেখতে চেয়েছেন। এ ছিল তার জীবনের একটা মিশন। যে কারণে ঠিকই উনি বাংলাদেশের বিতর্ক আন্দোলনের প্রাণপুরুষ ছিলেন। স্যার মুখে বলতেন, একটা অনুবাদের খ্যাপ পেয়েছি বুঝলে; অথচ ক্লাসরুমে ক্লাস নেবার বাইরে তরুণ সাহিত্যিক ও বিতার্কিকদের যে সময় দিয়েছেন; তাতে বোঝা যায় জীবনের পুরোটা সময় কাজে লাগাতে চেয়েছেন অন্ধকারের গল্পগুলোকে আলোর গল্পে রুপান্তর ঘটাতে। কানাগলির মানুষেরা যেন রাজপথের জীবন মিছিলে একাট্টা হয়; সে জন্য দ্রোহ সঞ্চার করেছেন অসংখ্য তরুণের জীবনে।

রাজনীতি সচেতন অথচ নির্দলীয়, স্পষ্ট কথার মানুষ অথচ ঝগড়া বিমুখ, গল্পের জাদুকর অথচ স্পটলাইট অপছন্দ করা অ্যাথেটিকসের মানুষ তিনি।  তুমি আমাকে আর কি দেবে রাজা আমার আছে ছাত্ররাজ্য; ঠিক এইরকম সোনালি অহমের সহজ মানুষ সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম। অলস দিনের হাওয়ায় চেপে রাজত্ব করেছেন তিনি আনন্দময় জগতে। ধুলোপথে হেঁটে ক্লাস নিতে এলেও স্যারকে যেমন পরিপাটি দেখাত; তার জীবনের ভ্রমণটিও হয়েছে ঠিক তেমনি। উনি যখন রেলস্টেশনের ধুলিময় প্লাটফর্মে হেঁটে রেলগাড়ির সিটে বসলেন; এতোটুকু ধুলো নেই তার শ্বেতবসনে। রেলগাড়ির জানালায় অশ্রুসিক্ত ছাত্রেরা যখন বল, এত তাড়াতাড়ি না গেলেই কি হতো না! মায়াময় হাসিতে তিনি বললেন, চললাম।

২১ পঠিত ... ৫ ঘন্টা ২ মিনিট আগে

আরও eআরকি

পাঠকের মন্তব্য

আইডিয়া

কৌতুক

রম্য

সঙবাদ

স্যাটায়ার


Top