বিটিভিতে যারা মুখ খিঁচিয়ে বলতেন, সর্বস্তরে মাতৃভাষা চালু করতে হবে; তারা ঠিকই নিজের ছেলে-মেয়েকে ইংলিশ মিডিয়ামে ভর্তি করে দিতেন। তারা সেই বৃটিশ আমলের চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের জমিদার স্টাইলে নিজের ছেলে-মেয়েকে ইংলিশ মিডিয়ামে পড়িয়ে লোকের ছেলেকে বাংলা শুধুই বাংলা মিডিয়ামে ঠেলে দিয়েছিলেন। ফলে স্বাধীন বাংলাদেশে তাদের ছেলে মেয়ে প্রতিষ্ঠায় ৫০ বছর এগিয়ে গেছে। আর বাংলা মিডিয়ামের ছেলে মেয়েরা বৃটিশ ও এমেরিকান একসেন্টের ইংরেজি শুনে ইংলিশ দেবতাকে পুজো দিয়ে ধন্য হয়।
এই ইংরেজিতে দুর্বলতার কারণে দেশের বায়িং হাউজে, সওদাগরি অফিসে, এনজিও-তে অন্যদেশের ইংলিশ দেবতা এনে চাকরি দিতে হয়। তখন আবার দোষ হয়, দেশের ছেলেমেয়েদের বঞ্চিত করে কেন অন্যদেশের লোক নিলো।
বিটিভিতে হাজার বছরের বাঙালি সংস্কৃতি নিয়ে কেন্দে জারে জার হয়ে যারা বলতেন, চীনের মানুষ তো ইংরেজি শেখেনি; তাতে কি তাদের উন্নয়ন হয়নি। আপনি আজকের ইংলিশ দক্ষতার পরিসংখ্যান দেখুন। ভারতের চেয়ে এগিয়ে গেছে চীন।
ভারত-শ্রীলংকা, পাকিস্তানের ছেলেমেয়েরা ইংরেজি শিক্ষার ক্ষেত্রে বৃটিশ ও এমেরিকান একসেন্টকে গুরুত্ব না দিয়ে ভাষা হিসেবে প্রায় নিজস্ব একসেন্টে ইংরেজি শিখেছে। ফলে তাদের বায়িং হাউজ, সওদাগরি অফিস, এনজিওতে অন্য দেশ থেকে ইংলিশ দেবতা আনা হয় না। ভাষা হিসেবে শেখার কারণে ঐসব দেশে ইংরেজি ভাষার লেখক তৈরি হয়েছে।
বাংলাদেশে যারা ইংরেজি জানেন; ঐ জ্ঞানটুকু আগলে রাখতে চেষ্টা করেন। আর শেখাতে গিয়ে একে এতো কঠিন করে ফেলেন যে ছাত্রছাত্রীরা ভয় পেয়ে যায়। ডেইলি স্টারের ইংরেজি ভাষাটা দেখেন; দুর্বোধ্য ইংরেজি তাদের। পাশাপাশি ভারতের দ্য হিন্দু ও পাকিস্তানের ডন পত্রিকার ইংরেজি দেখুন; সহজ করে লেখা যাতে সবাই বুঝতে পারে।
বাংলাদেশে যারা ইংরেজি শেখে তারা প্রত্ন কাস্ট সিস্টেমে ব্রাহ্মণ হয়ে পড়েন। অর্ধেক বাংলা অর্ধেক ইংরেজি বা বেঙ্গলিশ বলে প্রমাণ করতে চেষ্টা করে, আমি কছু কছু বেঙ্গলি কইতে পারি। নাতি-নাতনির এমন ইংলিশ ভিংলিশ হয়ে ওঠা দেখে নানা-নানী গর্ব করে বলে, আমগো সিন্থিয়া বাংলা কইতে পারে না। স্বাধীন বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও ইসলামি চেতনার দোকান খুলে যারা দেশের সম্পদ লুণ্ঠন; অন্যের ফেলে যাওয়া বাড়ি দখল করে রাতারাতি পাতলাখান লেন থেকে গুলশানে উঠে এসেছে; তারা ছেলে-মেয়েকে ইংলিশ মিডিয়ামে পড়ালে; তখন বাড়িময় ইংলিশ-ভিংলিশ রব উঠলে; এতোদিনে বাড়ির আসল মালিক হয়ে ওঠে তারা।
ইংরেজি শিক্ষাটাকে কেবল সুবিধাপ্রাপ্ত শ্রেণীর কুক্ষিগত করতে সাধারণ শিক্ষা ব্যবস্থায় ইংরেজি সিলেবাসকে দুর্বল থেকে দুর্বলতর করে ফেলা হয়। আর শিক্ষকতা পেশাকে এতো অপমানজনক করে তোলা হয়; যাতে ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্যে পাশ করা ছেলেমেয়েরা শিক্ষক না হয়ে পুলিশ, শুল্ক, কর ও প্রশাসনিক কর্মকর্তা হবার জন্য বিসিএস গাইড মুখস্থ করে।
বিশ্ববিদ্যালয়ে অন্য বিষয়ে পড়া ছেলে-মেয়েরা বিদেশে একটা মাস্টার্স বা পিএইচডি করতে যাওয়ার পর; ফেসবুকে নিজেদের মধ্যে ইংরেজিতে আলাপ-আলোচনা শুরু করে। দুজন উচ্চশিক্ষিত ফ্রেঞ্চ-ডাচ কিংবা জার্মানকে কখনো নিজেদের মধ্যে ইংরেজিতে আলাপ করতে দেখিনি। কারণ ওদেরকে তো ইংরেজি প্রদর্শন করতে হয় না। কাস্ট সিস্টেমে নিজের উচ্চবর্ণতা তুলে ধরতে হয় না। এর ওর ইংরেজি উচ্চারণের ভুল ধরে নিজের ইনফেরিয়র অতীত লুকিয়ে সুপিরিয়রিটির টরে টক্কা করতে হয় না।
বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় ইংরেজি শিক্ষার সুযোগ নেই। এরফলে বাংলা জানা যে ছেলেটির কনটেন্ট ভালো; সে কনটেন্টহীন ইংলিশ বোলচাল জানা ছেলেটির চেয়ে পিছিয়ে পড়ে। এখন একটাই আশা ইন্টারনেট প্রযুক্তির সুযোগ নিয়ে নতুন প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা ইংরেজিটা শিখে ফেলবে। পাস্ট-প্রেজেন্ট আর ফিউচার টেন্সটা রপ্ত হয়ে গেলে; আর ইংরেজি সংবাদ মাধ্যমের (বিটিভি বাদে) খবর শুনলে ও ইংরেজি মুভি দেখলে; অন্য ভাষার মুভির সাবটাইটেল খেয়াল করলে; ইংরেজি শেখাটা কোন রকেট সায়েন্স নয়। আগ্রহ করে ইংরেজি সাহিত্য ও বিশ্বসাহিত্যের ইংরেজি অনুবাদ পড়লে; ইংরেজি লেখার দক্ষতা এসে যেতে বাধ্য। প্রতিদিন ছোট ছোট প্যারাগ্রাফ লেখা প্র্যাকটিস করলে ছয় মাসের মধ্যে ইংরেজি লেখা সহজাত হয়ে দাঁড়ায়।
মনে রাখতে হবে, কেবল ঢাকার গ্রামীণ সমাজ ছাড়া আর কোথাও কেউ ইংরেজি উচ্চারণ নিয়ে চিন্তিত নয়। বাংলাদেশের একটা ছেলের কাছে কেউ বৃটিশ বা এমেরিকান একসেন্ট প্রত্যাশা করে না। ইংরেজি উচ্চারণে বাংলা গন্ধী অথেন্টিসিটি দোষের কিছু নয়। চিন্তক ও ইতিহাসবিদ ইউভাল নোয়াহ হারারির উচ্চারণে মধ্যপ্রাচ্য গন্ধী যে টান তা নিয়ে কক্ষণো কেউ চিন্তিত নয়। অডিয়েন্স আসলে ভালো কনটেন্ট খোঁজে। কনটেন্ট ইজ দ্য কিং। ল্যাঙ্গুয়েজ এটায়ার মাত্র। সেই এটায়ার ওবামার মতো স্যুট টাই নাকি ইউনুসের মতো ফতুয়া; তাতে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের কিছু এসে যায় না।
পাঠকের মন্তব্য