ছায়ানটের শুরুর দিনগুলো ছিল একদমই সাদামাটা। প্রথমদিকে সেখানে শ্রোতার আসর হতো, যেখানে ফিরোজা বেগম, ফাহমিদা খাতুন, বারীণ মজুমদার, ইলা মজুমদারসহ অনেক গুণী শিল্পী গান গেয়েছেন, কেউবা বাজিয়েছেন সেতার। তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে উপলব্ধি হলো, শুধুমাত্র বিশিষ্ট শিল্পীদের দিয়ে অনুষ্ঠান চালিয়ে নেওয়া সম্ভব নয়। সে সময়েই ওয়াহিদুল হক প্রস্তাব দিলেন, একটি সংগীত স্কুল করার। আর্থিক সংকট থাকলেও সবাই মিলে চাঁদা তুলে উদ্যোগটি বাস্তবায়ন করলেন। এভাবেই প্রতিষ্ঠিত হলো ছায়ানট সংগীতবিদ্যায়তন, যেখানে শুধু রবীন্দ্রসংগীত নয়, নজরুলগীতি, রাগসংগীতসহ বাঙালির নিজস্ব সংস্কৃতির চর্চা শুরু হলো।
পাকিস্তান সরকার বাঙালি সংস্কৃতিকে দমন করে একটি নির্দিষ্ট ধর্মীয় পরিচয়ে পরিচিত করাতে চাচ্ছিল। কিন্তু ছায়ানটের সংগীতচর্চার মাধ্যমে প্রমাণ করা হলো, সংস্কৃতি জাতিসত্তার অবিচ্ছেদ্য অংশ। স্বাধীনতার আগ পর্যন্ত এখানে গণসংগীতের চর্চাও হয়েছিল, যা মুক্তিকামী মানুষের মধ্যে বিপ্লবের আগুন জ্বালিয়ে দেয়। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের পর যখন দেশজুড়ে দমন-পীড়ন শুরু হয়, তখন ছায়ানটের অনেক সদস্য ভারতে পালিয়ে যান। সেখানে গিয়েও তারা সংগ্রামী সংগীতচর্চা চালিয়ে যান, শেখ লুৎফর রহমানের শেখানো ‘জনতার সংগ্রাম’, ‘বিপ্লবের রক্তরাঙা’ সহ অনেক গণসংগীত গাওয়া হতো, যা মুক্তিযোদ্ধাদের অনুপ্রাণিত করত।
কলকাতায় অবস্থানকালে তারা ‘রূপান্তরের গান’ নামে একটি গীতি-আলেখ্য তৈরি করেন, যার রচয়িতা ছিলেন শাহরিয়ার কবীর। এ সময় জহির রায়হান ব্যস্ত ছিলেন ‘স্টপ জেনোসাইড’ তৈরিতে। রবীন্দ্রসদনে আয়োজিত অনুষ্ঠানে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, দেবব্রত বিশ্বাস, কণিকা বন্দোপাধ্যায় ও সুচিত্রা মিত্রের মতো কিংবদন্তি শিল্পীরা অংশ নেন। এই অনুষ্ঠানের মাধ্যমে কিছু তহবিল সংগ্রহ করা হয়, যা স্বাধীনতার লড়াইয়ের জন্য কাজে লেগেছিল। ব্যক্তিগতভাবে যে যেখানেই গান গাইতেন, সেই অর্থ কেন্দ্রীয়ভাবে জমা দিতেন। এভাবেই সংস্কৃতি ও রাজনীতি একসূত্রে গাঁথা হয়ে এক নতুন আন্দোলনের জন্ম দেয়।
তথ্যসূত্র: প্রথম আলোকে দেওয়া সনজীদা খাতুনের সাক্ষাৎকার
পাঠকের মন্তব্য