লেখা: আবু ইউসুপ মাসুদ (ইতালি)
ইদ নিয়ে আমাদের প্রবাসীদের মাঝে একটা কথা বেশি প্রচলিত ‘আরে আমাদের (প্রবাসীদের) আবার কীসের ইদ’। প্রবাসে আসার আগে এই কথাটার মর্ম কোনোদিন বুঝিনি কিন্তু এখন হাড়ে হাড়ে বুঝি।
আমি একজন ইতালি প্রবাসী, কিন্তু তার আগে আমি মধ্যপ্রাচ্যের দেশ কাতারে ছিলাম। তো সে হিসেবে বলতে পারি প্রবাসের ইদ আবার দুই ধরনের হয় যেমন মধ্যপ্রাচ্যের ইদ একরকম আর ইউরোপ আমেরিকার ইদ আরেকরকম। আমি এখন ইতালিতে আছি কিন্তু তার আগে কাতারে ছিলাম তাই দুই দেশের ইদ উদযাপন নিয়ে একটু স্মৃতিচারণ করি।
কাতারে যখন ছিলাম তখন ইদ ছিল ভিন্নরকম। সেখানে ইদের বন্ধ পাওয়া যায় বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ১-২ দিন আগ থেকে। আবার এই ইদের ছুটি ২-৩ দিন থেকে ৮-১০ দিন পর্যন্ত হয়। ইদের আগের রাত আমরা কেউ ঘুমাতাম না, এবং অবধারিত অন্যদেরও ঘুমাতে দিতামভনা।
ইদের আগের সারারাত আমরা দলবেঁধে আড্ডা দিতাম, কেউ ২৯ খেলতাম আবার কেউ কেউ পরেরদিনের বিশেষ রান্নার বন্দোবস্ত করার জন্য প্রয়োজনীয় বাজার করতে মার্কেটে যেত (ও এই বিশেষ রান্না আবার আহামরি কিছু না, সকালে মসজিদে যাওয়ার সময় সেমাই রান্না করা হবে আর দুপুরের স্পেশাল বিরায়নি, এইটুকুন)। এসবের মাঝে রাত ৩টা বাজার পর ধীরে ধীরে শুরু হতো আমাদের গোসল পর্ব। গোসল শেষে সবাই যার যার মতো নতুন পুরাতন পাঞ্জাবি পড়ে আতর বা সেন্ট মেখে মসজিদে ফজর নামাজ পড়তে চলে যাই। কারণ ফজর নামাজের পরপরই ইদের নামাজ শুরু হয় সেখানে। নিজেদের পছন্দের মসজিদে ইদের নামাজ শেষ করে প্রথম কাজ কোলাকুলি। এই কোলাকুলি চলে আবার ফ্রি স্টাইলে, পরিচিত অপরিচিত সবার সাথে। তারপরের পর্ব হয় সেলফি আর গ্রুপ পিকচার তোলা নিয়ে। সেই পর্ব শেষ করে এরপর বাসায় আসা আর একেকজন মোবাইল নিয়ে একেকভাবে বাড়িতে ইদের শুভেচ্ছা জানানোর পর্বের মাঝে শুরু হয় বাড়িতে রেখে আসা ইদ স্মৃতির দুয়ার খোলা পর্বের। এই পর্বে নতুন হলে কারও কথা বলতে বলতে চোখ ভিজে যায়, আবার কেউ হাউমাউ করে কান্না করে। আর যারা পুরাতন তারা কৃত্রিম হাসি দিয়ে বাড়িতে জানায় আমরা ইদে খুব মজা করছি।
কথার ফাঁকে ফাঁকে চলে আবার বিরিয়ানি রান্না। এরমধ্যে সারারাত নির্ঘুম থাকা কেউ কেউ একটু ঘুমানোর ট্রাই করে। কিছুক্ষণ ঘুমানো চলে এবং কিছুক্ষণ পর রুমের মুরুব্বি কেউ একজন হাঁকডাক মেরে সবাইকে ডাকে এই বিরিয়ানি রেডি সবাই উঠে পড়। হাসি মজায় বিরিয়ানি খেয়ে সবাই আরেকদফা ঘুম দিয়ে বিকেলে উঠে মাঞ্জা মেরে কয়েক গ্রুপ হয়ে বের হয়ে যাওয়া। এই কয়েক গ্রুপের এক গ্রুপ যাবে সিটি সেন্টার মলে (না কেনাকাটা করতে নয়, স্রেফ ঘোরাঘুরি করতে যাওয়া) এক গ্রুপ যাবে কোনো পার্কে আরেক গ্রুপ যাবে কার্ণিশ (সমুদ্র পাড়ে)। তারপর রাত হলে ধীরে ধীরে সবাই যারা যার মতো রুমে ফিরে আসে এবং এভাবেই আমাদের ইদ শেষ।
একটা জিনিস এখনও বিশ্বাস করি কাতারের এই ইদে ইদের অন্যতম উপাদান পরিবার মিসিং হলেও কীভাবে যেন ভিন্ন ভিন্ন জেলার ভিন্ন ভিন্ন মতের মানুষেরাই একেকটা পরিবার হয়ে যায়।
এবার আসি ইতালিতে আমার প্রথম ইদের অভিজ্ঞতায়। সেই ইদের দিন ভোরবেলা আমার ডিউটি ছিল ভোর ৫ বাজে ঘুম থেকে ওঠে ডিউটি পোশাক পড়ে বের হলাম। মন খারাপ নিয়ে পথে যেতে যেতে ভাবছি আজকে ইদ কিন্তু সারা রাস্তায় ইদের ই-টুকু কেন দেখতে পাচ্ছি না। ১ ঘণ্টার বেশি সময় বাসে ঘুরে ডিউটিতে গেলাম কিন্তু কোথাও এমন কিছু দেখলাম না যাতে মনে হয় আজকে ইদ। আমি যেখানে ডিউটি করি সেখানে অনেকে মুসলিম কিন্তু কারও মাঝে ইদের বিন্দুমাত্র আমেজ নাই দেখে আমি অবাক হয়ে গেলাম। সবাই ডিউটি নিয়ে ব্যস্ত দেখে আমিও সবার মতো ব্যস্ত হয়ে গেলাম। যাই হোক ডিউটি শেষ করে বাসায় আসতে আসতে বিকেল ৫টা বেজে গেছে, বাসায় এসে দুইটা খেয়ে মোবাইলটা হাতে নিতে নিতে আমার খেয়াল হলো পুরো একটা ইদের দিন শেষ হয়ে গেছে কিন্তু একজন মানুষের সাথেও ইদ মোবারক বলে কোলাকুলি হলো না।
সেদিন এতটুকু বুঝলাম মধ্যপ্রাচ্যের ইদে পরিবার না থাকলেও একটা ইদের আমেজসহ একটা ঈদ ইদ ভাব তো ছিল কিন্তু ইতালিতে এসে বুঝলাম এখানে অনেক কিছু থাকলেও খোদ ইদ জিনিসটাই মিসিং।
সকল প্রবাসীকে ইদের শুভেচ্ছা, ইদ মোবারক।
পাঠকের মন্তব্য