ফেসবুকে সতত দৃশ্যমান অস্থিরতা, ক্রোধ, বিদ্বেষ, টক্সিসিটি কমাতে আমাদের কিছু বিষয়ের দিকে মনোযোগ দেয়া উচিত।
পৃথিবীর কোন দেশের মানুষ এত বিখ্যাত হতে চায় না। তারা সমাজে অন্যতম একজন হয়ে আনন্দে জীবন কাটায়। কাজেই সারাক্ষণ বিখ্যাত হবার জন্য এতো ডানা ঝাপটানোর দরকার নাই।
নিজের চেহারা ও গায়ের রঙ নিয়ে এতো চিন্তা করার দরকার নাই। আসল হচ্ছে আচার আচরণ। মানুষের ব্যবহার ভালো হলে তাকে দেখতে ভালো লাগে। ফুটবলার এডসন অরাতেস দো নাসিমেন্তো পেলেকে দেখতে ভালো লাগে তার নির্মল হাসি আর কার্টেসির কারণে। অথচ ইলন মাস্ককে দেখতে অতো ভালো লাগে না তার উদ্ধত আচরণের কারণে।
বাংলা ভাষা প্রমিত করে উচ্চারণ করলেই যে লোকটা বড্ড কালচার্ড এমন নয়। বরং মোশাররফ করিম তার বরিশালের আঞ্চলিক ভাষা বলে অনেক কালচার্ড লোক। প্রমিত উচ্চারণের অভিনেতা আসাদুজ্জামান নূরের চেয়ে অভিনেতা মোশাররফ করিম অনেক উজ্জ্বল সাংস্কৃতিক উদাহরণ রেখে যাচ্ছেন সমাজে। অধ্যাপক রাজ্জাক আঞ্চলিক উচ্চারণে যে জ্ঞান গর্ভ কথা বলেছেন; প্রমিত উচ্চারণে হাজার খানেক বুদ্ধিজীবী সেকথা বলতে পারেননি।
আর্থিকভাবে দরিদ্র পরিবারে জন্মে কবি কাজী নজরুল ইসলাম, বিজ্ঞানি এপিজে আবুল কালাম যে আভিজাত্যের চিহ্ন পৃথিবীতে রেখে গেছেন; ধনী পরিবারে জন্মে সালমান এফ রহমান তার চেয়ে অনেক অনভিজাত ছাপ রেখে গেলেন পৃথিবীতে।
অসতপথে টাকা কামানো বিরাট পুলিশ কর্মকর্তা বেনজির কিংবা বিশাল সেনা কর্মকর্তা আজিজের চেয়ে অল্প বেতনে চাকরি করা পুলিশ কর্মকর্তা যে লাঠি মাটিতে মেরে কারো গায়ে স্পর্শ না করে জনতার বিক্ষোভ প্রশমন করে কিংবা বন্যাদুর্গতদের সাহায্য করতে গিয়ে যে সৈনিক একটি শিশুকে পরম মমতায় আগলে ধরেছিলো; তারা অনেক মহৎ ও সুন্দর হৃদয়ের মানুষ।
গাড়িতে স্বামী ও স্ত্রী যার যার জানালার দিকে তাকিয়ে পরম বিরক্তিতে বাড়ি ফেরার চেয়ে মোটর বাইকে হাস্যজ্জ্বল দম্পতি কাজ শেষে বাড়ি ফেরার দৃশ্য অনেক রোমান্টিক।
ইংরেজি জানলে ভালো; কিন্তু না জানাটা বিরাট কোন অপরাধ নয়। জার্মানি ও ফ্রান্সের লোক ইংরেজি জানে না। কিন্তু পৃথিবীর অগ্রসর দুটি সমাজ। কাজেই বাংলাদেশে শুধু বাংলা জেনেও অগ্রসর সমাজ তৈরি সম্ভব।
নারী ও পুরুষ দুজনেই সুন্দর। নারীকে অধিক সুন্দর ভেবে তার দিকে হা করে তাকিয়ে থাকার দরকার নেই। যেহেতু প্রতিটি শিশু মাতৃ স্তন্য পান করে বড় হয়েছে; তাই রাস্তা ঘাটে বা কর্মক্ষেত্রে দেখা হওয়া নারীর স্তনাভাসের দিকে তাকিয়ে থাকা অনুচিত। পৃথিবীর যেসব দেশ শিক্ষা-সংস্কৃতি-অর্থনীতি-বিজ্ঞানে এগিয়ে গিয়েছে; তাদের সাফল্যের মূলে রয়েছে নারীকে নিয়ে অধিক চিন্তা না করা। আমাদের সমাজে নারী কি পরলো, কিভাবে হাঁটলো, কিভাবে কথা বললো; তা দেখতে বেশিরভাগ পুরুষ ব্যস্ত থাকায় স্বাধীনতার ৫৪ বছর পরেও আমরা পৃথিবীর লেজের দিকে পড়ে আছি। কিন্তু জার্মানি ও ফ্রান্সের পুরুষেরা নারী নিয়ে ব্যস্ত না থাকায়, মন দিয়ে নিজ নিজ কাজ করায় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পোড়োবাড়ি থেকে মাত্র দশবছরে সব দিক দিয়ে ঘুরে দাঁড়িয়েছিলো।
জার্মানি বা ফ্রান্সের স্কার্ট পরা মেয়েদের দেখে আমাদের সমাজের অনেক পুরুষই মনে করে, এরা তো গোল্লায় যাওয়া মেয়ে। কিন্তু তারা অত্যন্ত শিক্ষিত, কর্মব্যস্ত আর রক্ষণশীল। এশিয়াতেই বরং নারীকে ঘোমটা দিতে বাধ্য করায়, ‘ঘোমটার নিচে খেমটা নাচ’ বলে একটি উপকথা প্রচলিত আছে। আসলে আমরা খুব ক্ষুদ্র পরিসরে বাস করি। আমাদের অভিজ্ঞতার জগত সীমাবদ্ধ; ফলে নিজের জানা গ্রামটিকেই পৃথিবী বলে মনে করি। নিজের জানার বাইরের যে কোন কিছু নিয়ে তাই আমরা বোকার মতো হাহা ইমো দিই। আমরা বুঝতে চাই না, এই যে দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশ নানা সামাজিক ও অর্থনৈতিক সূচকে এগিয়ে; এর প্রধান কারণ নারীর অংশগ্রহণ। জনশক্তির পুরোটাকে ব্যবহার করা গেলে আমরা খুব দ্রুত উন্নত দেশে পরিণত হতে পারবো। যে সমাজে নারী ও শিশু নির্ভয়ে পথে চলতে পারে; সেটাই সভ্য সমাজ।
আমরা এতদঞ্চলের পুরুষেরা গৃহকর্ম ও রান্না বান্না পুরোটা মা-বোন-বান্ধবি-স্ত্রীর ওপর ছেড়ে দিয়ে নিজেদের অকর্মণ্য করে তুলি। এতে করে চল্লিশ পেরোলেই আমাদের চালশে এসে পড়ে, শার্টের বোতাম উলটা পালটা লাগাই, ট্রাউজারের জিপার লাগাতে ভুলে যাই, পাজামার ফিতায় গিট্টু পাকিয়ে ফেলি, রাস্তা পার হতে ভয় পাই, রেলস্টেশন ও বিমান বন্দরে দিশেহারা হয়ে দাঁড়িয়ে থাকি। অফিসের কাজ ছাড়া আর কোন কাজ না করায় আমরা কেবলা হয়ে যাই। ফলে চল্লিশের আগে পৌরুষ দেখিয়ে নারীদের ধমক দিই; আর সারাজীবন বিশেষত চল্লিশের পর জীবন কাটে নারীর ধমক খেয়ে।
আমাদের দেশে হিন্দুত্ববাদী সংস্কৃতি মামা ও ইসলামপন্থী ধর্ম মামারা বিশেষ কিছু জানে না। একদল রবীন্দ্রনাথকে কমপ্লিট কোড অফ লাইফ বলে ব্রাহ্মণ সাজতে চায়; আরেকদল ইসলামকে কমপ্লিট কোড অফ লাইফ বলে আশরাফ সাজতে চেষ্টা করে। এদের জীবনে সত্যিকারের দক্ষতার কোন জায়গা না থাকায়; এরা সেই অদক্ষতাকে ঢাকতে কিছু গালগল্প ছাড়ে। এই লোকগুলোকে ইগনোর না করলে সুখি জীবন যাপন করা প্রায় অসম্ভব। এসব লোক ইতিহাসের নানা বাঁকে মানবতাবিরোধী অপরাধ করেছে আর ক্রমাগত তা অস্বীকার করে। এদের চেয়ে ঝুঁকি পূর্ণ লোকই হতে পারে না।
যে কোন বিষয়ে একটা কতৃত্ব দাবি করতে দীর্ঘ ঐতিহ্য লাগে। কাজেই বাংলাদেশ তথা দক্ষিণ এশিয়ার শিল্প-সাহিত্য কপচানো লোকেরা যতই মাতবরি করুক; ইউরোপের এনলাইটেনমেন্টের ধারে কাছে যেতে পারবে না। বাংলাদেশের ইসলামপন্থীরা যত পঞ্চায়েতিই করুক; তারা কখনো সৌদি আরব বা তুরস্ক-মিশরের ইসলামপন্থীদের ধারে কাছে যেতে পারবে না। বাংলাদেশের হিন্দু যতই চেষ্টা করুক অযোধ্যা কিংবা দক্ষিণ ভারতের হিন্দুর ধারে কাছে যেতে পারবে না। বাংলাদেশের বাম যতই মার্ক্স আউড়াক; বামপন্থায় সে কখনো ইউরোপ কিংবা লাতিন এমেরিকার ধারে কাছে যেতে পারবে না। রাজনীতিক ও আমলারা তো পৃথিবীর কোন দেশের রাজনীতিক ও আমলার ধারে কাছে যেতে পারবে না। এক একটি রাজনৈতিক পরিবর্তনে জনগণকে স্বপ্ন দেখিয়ে তারপর তাদের সম্পদ লুট করে ফইন্নি থেকে এলিট হওয়াই বাংলাদেশের রাজনীতি। তারমানে আমাদের সমাজের মাতবর শ্রেণীটি বিশ্বমানে সবচেয়ে পিছিয়ে আছে। এই একচুয়ালাইজেশন দরকার।
আর মানুষ হিসেবে আমি কিংবা আপনি তো একটা চড়ুইয়ের চেয়েও কম গুরুত্বপূর্ণ। একটা গাড়ি-বাড়ি-ব্যাংক ব্যালেন্স আর বড়লোক হবার ছোটলোকি স্বপ্নের পিছে যে দুরন্ত ইঁদুরের মতো দৌড়াই আমরা; তাতে আমরা বিবর্তনে অনেক পিছিয়ে থাকা মানুষ। প্রায় জেলি ফিশ হয়ে আছি সবাই।
আমাদের দেশের শিক্ষা-ব্যবস্থার যে অবস্থা; তাতে বিশ্বে মুখ দেখানোর অবস্থা নেই। নেহাত স্বশিক্ষিত মেহনতী মানুষের শ্রমে ও ঘামে অর্থনীতির চাকা ঘোরে; যা কিছু মানবতাবোধ তা বেঁচে আছে বাংলাদেশের গ্রামগুলোতে। এরা শিল্পী এস এম সুলতানের পেশীবহুল মানুষ। বাকি সবাই মধ্যস্বত্বভোগী বা মিডল ম্যান। মেহনতী মানুষের সম্পদ লুট করে থাগস অফ বেঙ্গলের জীবন আমাদের।
এই যেখানে হাল আমাদের; সেখানে কোন দিক থেকে শ্রেষ্ঠত্বের বড়াইয়ের কোন সুযোগ নেই। তাই হীনম্যতাজনিত শ্রেষ্ঠত্ব জাহিরের বিগ মাউথ হওয়ার চেয়ে নিজ নিজ কাজ নিষ্ঠার সঙ্গে করে একটু আত্মার সুখ খোঁজ করার চেষ্টাটুকুই করা উচিত আমাদের। অতো দেশ কিংবা পৃথিবী বদলানোর সামর্থ্য আমাদের নাই; নিজেকে একটু একটু বদলাতে পারলেই আপাতত হবে।
পাঠকের মন্তব্য