স্যরি, শুধু ফেসবুকে ছবি দেখে বন্যার কষ্ট আপনি বুঝবেন না

১২০ পঠিত ... ১৭:৩১, আগস্ট ২৪, ২০২৪

WhatsApp Image 2024-08-24 at 16.57.30_fdfec06a

লেখা: মহিউদ্দিন মোহাম্মদ

ফেসবুক প্রজন্মের পক্ষে বন্যার কষ্ট অনুধাবন করা সম্ভব নয়। ছবিতে যা দেখা যায়, তা বন্যার সৌন্দর্য, দুঃখ নয়। বন্যার দুঃখ বুঝতে হলে আপনাকে বন্যার ভেতর কিছুকাল কাটাতে হবে।

আমার যে বছর জন্ম, সে বছর খুব বন্যা হয়েছিল। ওই বন্যা আমার স্মৃতিতে নেই। আমার স্মৃতিতে আছে পরের দুটি বন্যার কষ্ট।

শুরুতে মানুষের মনে খুব উত্তেজনা থাকে। খালে জাল ফেলে। মাছ ওঠে। মাছ দেখে তারা আনন্দিত হয়। প্রতি সন্ধ্যায় একটি বাঁশের জিংলা পুতে দেয়। জিংলার মাথাটি থাকে পানির উপরিভাগের সমান। এটিকে বলা হয় ঠার। পানি কতটুকু বাড়ল, তা জানার উপায়। ঠার যত আঙুল ডুবে যাবে, পানি তত আঙুল বৃদ্ধি পাবে।

এক আঙুল, দুই আঙুল করে পানি বাড়তে থাকে। রাস্তাঘাট তলিয়ে যেতে থাকে। পানি মাড়িয়ে হাঁটতে হাঁটতে পায়ের আঙুলে ঘা হয়ে যায়। খালে জাল ফেলার 'তাবা' ডুবে যায়। ধীরে ধীরে মানুষের উচ্ছ্বাস ও হুল্লোড় মিইয়ে আসতে থাকে।

একদিন ঘুম থেকে উঠে সবাই দেখতে পায়— তাদের প্রিয় ভিটেখানি ভেজা। পুকুরের পাড় আর দেখা যাচ্ছে না। খুদ-কুড়োয় বড় করা মাছগুলো পালিয়ে গেছে। দুটি ছাগল মরে গেছে, আরেকটি কাশছে। ভেড়াগুলো ঝিমোচ্ছে, আগামীকালই মারা যাবে। গরুগুলো ঘাসের আশায় কোথায় যেন তাকিয়ে আছে। মোরগগুলো চুপ মেরে আছে এক কোণায়। নতুন পানি আসার সমস্ত উত্তেজনা মানুষের মুখ থেকে উবে যায়।

এ পর্যায়ে শুরু হয় বিক্রির ধুম। কত সাধের জিনিস যে এ সময় নাম মাত্র মূল্যে বিক্রি করা হয়, তার ইয়ত্তা নেই। আমরা একটি গরু বিক্রি করেছিলাম পাঁচশো টাকায়, যদিও বাজারে এর মূল্য ছিল সাড়ে তিন হাজার টাকা।

বিক্রির ধুমের পর শুরু হয় খাদ্য সংকট। অনেকেই এ সময় চাল ভাজা, মুড়ি ভাজা খেয়ে কাটান। ধানের ডোল ঘেঁটে একটি ঝুনা নারিকেল পাওয়া গেলে আনন্দের সীমা থাকে না। কিন্তু এ আনন্দ মিনিট কয়েকের বেশি স্থায়ী হয় না। ঘরের মেঝে তলিয়ে যাওয়ার পর সবকিছু নিয়ে চড়ে বসতে হয় চৌকি বা পালঙে।

এ সময়টা খুব কষ্টের। ল্যাট্রিন ডুবে গেছে, চুলা ডুবে গেছে, পা ফেলার সমস্ত জায়গা নাই হয়ে গেছে। পুরুষরা নৌকা বা কলার ভেলায় চেপে দূরে গিয়ে পায়খানা করে আসে। কিন্তু নারী ও বিবাহযোগ্য মেয়েরা পড়ে দোযখী বিপদে। প্রস্রাব ধরে রাখতে রাখতে তাদের তলপেট ফুলে ওঠে, এবং একসময় নেমে পড়ে পানিতে। পানির নিচে গোপনে গোপনে প্রস্রাব করে। কিন্তু পায়খানা?  

যাদের ঘরে দুটি চৌকি, তারা একটি চৌকিকে শাড়ি দিয়ে আড়াল করে দেয়। এ চৌকিটিকে মেয়েরা ব্যবহার করে ল্যাট্রিন হিসেবে। তবে যাদের ঘরে একটি চৌকি, তারা শাড়ির বেড়া দিয়ে সেটি দুই ভাগ করে ফেলে। এক ভাগে খাওয়া-দাওয়া, মাটির একমুখী চুলা, কাঁথা-বালিশ, ও আরেক ভাগে প্রস্রাব-পায়খানা।

কয়েকদিন পর শুরু হয় ডায়রিয়া ও কলেরা। এ সময় পল্লী চিকিৎসকরা খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। নৌকায় করে গ্রামে গ্রামে তারা ওষুধ ও স্যালাইন সরবরাহ করেন। এই চিকিৎসকরা যে এ সময় কত প্রাণ বাঁচায়, তা বলে শেষ করা যাবে না। ঘরে টাকা নেই, চাল নেই, ডাল নেই, তারপরও পল্লী চিকিৎসকরা কারও চিকিৎসা ফেলে রাখেন না।

এ সুযোগে হঠাৎ দেখা দেয় ইঞ্জিনের নৌকা। এ নৌকায় ঘুরতে আসেন ভোট শিকারিরা। তারা মানুষকে এক পোটলা দুই পোটলা ত্রাণ দেন, ও আগামী ইলেকশনে প্রার্থী হওয়ার বিষয়টি কৌশলে জানিয়ে দেন। কেউ কেউ ত্রাণগ্রহীতার কাছ থেকে ভোটপ্রাপ্তির ওয়াদাও আদায় করেন। 

এই কষ্ট কি ছবিতে ফুটিয়ে তোলা সম্ভব? সম্ভব নয়। ধনী মানুষদের সময় হয়ত বদলেছে, কিন্তু যারা গরিব মানুষ, তাদের বন্যার কষ্ট এখনও এরকমই আছে।

 

 

 

১২০ পঠিত ... ১৭:৩১, আগস্ট ২৪, ২০২৪

আরও eআরকি

পাঠকের মন্তব্য

 

ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে

আপনার পরিচয় গোপন রাখতে
আমি নীতিমালা মেনে মন্তব্য করছি।

আইডিয়া

কৌতুক

রম্য

সঙবাদ

স্যাটায়ার


Top