কোটা সংস্কার আন্দোলন নিয়ে যতদিন ধরে কথা হচ্ছে, ততবারই উঠে আসছে ছাত্রলীগের কথা। আন্দোলনকারীদের ব্যাপারে ছাত্রলীগের অবস্থান কী? ছাত্রলীগ কি তবে সত্যিই ক্যাম্পাসে আন্দোলনকারীদের মারধোর করেছে? সামাজিক গণমাধ্যমে এমন নানান প্রচারণা। কে দেবে আশা, কে দেবে ভরসা। এসব ভাবতেই তথ্যগুলো সম্পর্কে নিশ্চিত হতে যার নামটি আগে মনে আসার কথা, তা নামটিই মনে আসলো!
ছাত্রলীগের সভাপতি সাইফুর রহমান সোহাগ নিশ্চয়ই একজন ব্যস্ত মানুষ। উদ্বোধনী অনুষ্ঠান, সভা-সমাবেশ, টিভি শো আর পত্রিকায় ছাত্রলীগের বিশুদ্ধতা বর্ণনা করতে তিনি ব্যস্ত থাকেন নানান মাধ্যমে। তবে ফোন করতেই অবশ্য জানালেন সময় দিতে পারবেন, যদিও বেশিক্ষণের জন্যে নয়। তাই আর কালক্ষেপণ না করে আমরা দ্রুত চলে গেলাম তার বাসায়। সময়টা তখন বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যে, আমরা পৌঁছেছি ছাত্রলীগের সভাপতি সাইফুর রহমান সোহাগের বাড়ির চত্বরে। খানিকক্ষণ কলিংবেল টেপার পরেও দরজা খোলা হচ্ছিলো না দেখে যখন আমরা কনফিউজড যে অন্য কোনো বাড়িতে চলে এলাম নাকি... তখনই ভুল ভাঙলো! এলাকায় বিদ্যুৎ নেই, ব্ল্যাকআউট চলছে। আর বিদ্যুৎ না থাকলে কলিংবেল যে বাজবে না তা তো জানা কথা। তবে দরজায় বার দুয়েক নক করতেই দরজা খুলে দিলেন সাইফুর রহমান সোহাগের গৃহপরিচারিকা।
ঘরে ঢুকতেই আর কিছু বোঝা যাক না যাক, কেমন যেন একটা শান্তি শান্তি ভাব টের পাওয়া গেলো। শান্তির উৎস খুঁজতে এক ফাঁকে মোবাইলের টর্চ মেরে দেয়ালে টাঙানো মহাত্মা গান্ধী, মাদার তেরেসা আর স্বামী বিবেকানন্দের ছবি দেখেই যেন অহিংস এক আবেগে ভরে গেলো মন। সোহাগ ভাই বসে আছেন আরামকেদারায়। পাশে একটা টেবিল, টেবিলে একটা পাতা রাখা। সেদিকে তাকাতেই 'অন্য কিছু' ভেবে ফেলতে পারি তা ভেবেই কিনা তিনি ইতস্তত কন্ঠে বললেন, 'ইয়ে, এটা তুলসি পাতা। মাত্রই ধুয়ে এনে রাখা হয়েছে।'
বসতেই সম্ভবত তিনি আপ্যায়নের উদ্যোগ নিলেন। গৃহপরিচারিকাকে বললেন, 'এই, চাপাতি নিয়ে আয় তো!' আমি নড়েচড়ে বসলাম। তা বুঝেই বোধহয় তিনি কিউট করে হেসে বললেন, 'বাসায় চা-পাতিটা শেষ হয়ে গেছে। আনতে পাঠাচ্ছি।'
চাপাতির কথাতেই মনে পড়ে গেলো চলমান আন্দোলনের কথা। সোজা চলে গেলাম আলাপচারিতায়-
প্রশ্নঃ ভাই চারদিকে এমন অন্ধকার কেনো? বাসায় জেনারেটর নাই?
উত্তরঃ থাকবে না কেন। কিন্ত আমি সামান্য আরামের জন্য জেনারেটর চালাতে চাই না। কারণ, এক অন্যায় থুক্কু জনগণ এবং ন্যায়নীতি বাদে আমি কোনকিছুর সাথেই আপোষ করতে রাজি না। তাতে করে যদি আমার সম্মান পাপোশে মিশে যায়, আই ডোন্ট বদার।
প্রশ্নঃ চারদিকে তো খুব ছাত্রলীগের সমালোচনা হচ্ছে তাদের সাম্প্রতিক কার্যক্রমের জন্যে।
উত্তরঃ দেখেন, যারা ভালো কাজ করবে তাদের যেমন প্রশংসা করা হয়, তেমনি জেলাসির জন্যে অনেকে তাদের সমালোচনাও করে। আইন্সটাইনের ফার্স্ট ল পড়েন নাই? প্রত্যেকটি ক্রিয়ারই একটি সমান ও বিপরীত প্রতিক্রিয়া আছে?
প্রশ্নঃ জ্বি বস, কিন্ত ওইটা তো নিউটনের তৃতীয় সূত্র।
উত্তরঃ তো আমি কী বললাম?
প্রশ্নঃ আইন্সটাইনের ফার্স্ট ল...
উত্তরঃ কখনোই না! হতেই পারে না। আমি কখনোই এইটাকে নিউটনের ফার্স্ট ল বলি নাই। এইটা অবশ্যই নিউটনের থার্ড ল!
প্রশ্ন: বস, আরেকটু ভুল হইলো, আপনি প্রথমে আইন্সটাইনের...
উত্তর: শোনেন, বাংলাদেশ ছাত্রলীগ কখনো মিথ্যা বা ভুল কিছু বলতে পারে না, করতে পারে না। আমাদের নিষ্ঠা... আমাদের আদর্শ... আমাদের সংকল্প... আমাদের স্বপ্ন... ডিজিটাল বাংলাদেশ...
পনের বিশ মিনিট ছাত্রলীগের নানান রকম ইতিবাচক মানবতামূলক এজেন্ডা শোনার পর চলমান কোটা আন্দোলন সম্পর্কে প্রশ্ন করতেই সোহাগ ভাই থামলেন। ভ্রু কুঁচকে বললেন, 'আচ্ছা, যা বলার বলেন... সময় নাই হাতে বেশি।'
প্রশ্ন: আপনারা কি এই কোটা আন্দোলনের বিরুদ্ধে?
উত্তর: দেখুন, ছাত্রলীগ যে কোনো ধরণের সহিংস আন্দোলনের বিপক্ষে। ছাত্রছাত্রীরা প্রচন্ড সহিংস আন্দোলন করছে। পুলিশদের সঙ্গে কি গ্যাঞ্জামটা করলো... (এতটুকু বলে তিনি তুলসি পাতাটা একবার হাতে ছুয়ে নিলেন।)
প্রশ্ন: কিন্তু মিডিয়ায় তো দেখলাম পুলিশই ছাত্রছাত্রীদের দিকে টিয়ার শেল রাবারবুলেট ও সব ছুড়লো...
উত্তর: যে-ই সহিংস হোক, সহিংসতা হয়েছে তো, নাকি? ছাত্রলীগ কোনো প্রকার সহিংসতার সঙ্গে নেই। এই আন্দোলন যদি ছাত্রলীগের হতো, অবশ্যই সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে আমাদের কর্মীরা ধ্যানে বসে অহিংস উপায়ে আন্দোলন করতো।
প্রশ্ন: ছাত্রলীগ কি তবে আন্দোলনকারীদের প্রতিও কোনো রকম চড়াও হয়নি বা আন্দোলনে অসহযোগিতা করেনি? কিন্তু হলের ছেলেমেয়েরা তো অন্য কথা বলছে...
উত্তর: নাউজু... এটা কী বললেন? ছাত্রলীগ কোনো ধরণের অপকর্মের সঙ্গে জড়িত কখনোই ছিল না, এখনো নেই, ভবিষ্যতেও থাকবে না। কোথাও কোনো ছবি ভিডিও যদি দেখে থাকেন, সবই ফটোশপ। বলুন, যাদের এত কেজি কেজি আদর্শ, তারা কি এসবে জড়িত থাকতে পারে?
প্রশ্ন: কিন্তু সামাজিক গণমাধ্যমে যা তথ্য পাওয়া গেছে, তাতে মনে হয় এই আন্দোলনে যে সব সাধারণ শিক্ষার্থী হয়রানির স্বীকার হচ্ছেন তার দায়ভার ছাত্রলীগের ওপরেও কিছুটা বর্তায়...
উত্তর: শোনেন, মিডিয়ায় যাদের কথা এসেছে, তারা ছাত্রলীগ না। ছাত্রলীগের সঙ্গে থাকলেই সহীহ ছাত্রলীগ হওয়া যায় না, এজন্য মাত্রাজ্ঞান লাগে। ছাত্রলীগ একটা শান্তির সাধনা, একটা অহিংসতার তপস্যা। যাদের দেখেছেন, ওরা আসলে ছাএলীগ। ওদের মাত্রাও নেই, ওরা মাত্রা জানেও না!
প্রশ্নঃ শেষ প্রশ্ন... আপনারা কি সংস্কার আন্দোলনের বিপক্ষে? যদি আরেকটু পরিষ্কার করে বলতেন?
উত্তরঃ দেখেন ভাই সামনেই বর্ষাকাল, এই সময়ে সবচেয়ে বেশি দরকার রাস্তা সংস্কারের। তা না হলে জনগণ দুর্ভোগে পড়বে। আমার ধারণা ষড়যন্ত্রকারীরা পাবলিকের ফোকাস সরানোর জন্যেই এই কোটা সংস্কার আন্দোলন শুরু করেছে। যাতে সরকার এই নিয়ে ব্যস্ত থেকে রাস্তা সংস্কারের কাজ শুরু না করতে পারে... এটা আসলে সংস্কারের নয়, কুসংস্কারের আন্দোলন...
অতঃপর মাত্রাহীন এক বিস্ময় নিয়েই শেষ হলো ছাত্রলীগ সভাপতির কাল্পনিক এই সাক্ষাৎকার!
(এটি একটি স্যাটায়ার ইন্টারভিউ। নিজ দায়িত্বহীনতায় বিশ্বাস করবেন।)
পাঠকের মন্তব্য
ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে
লগইন