এলেবেলে : মানুষ কেন হাসে?

১০৪১ পঠিত ... ০৮:১৩, জুলাই ১৯, ২০১৯

আমাদের পাড়ায় মজিদ সাহেব নামে একজন রিটায়ার্ড পুলিশের এসপি থাকেন। তাঁর স্বভাব হচ্ছে দেখা হওয়া মাত্র অত্যন্ত চিন্তিত মুখে ‘হাই ফিলসফি’ গোছের একটা প্রশ্ন করা। মহা বিরক্তিকর ব্যাপার। সেদিন মোড়ের দোকানে সিগারেট কিনছি হঠাৎ লক্ষ্য করলাম মজিদ সাহেব হন হন করে আসছেন। আমি চট করে একটু আড়ালে চলে গেলাম। লাভ হল না। ভদ্রলোক ঠিক আমার সামনে এসে ব্রেক করলেন এবং অত্যন্ত গম্ভীর গলায় বললেন, প্রফেসর সাহেব, মানুষ হাসে কেন বলেন তো।

আমি বিরক্তি চেপে বললাম, হাসি পায় সেই জন্য হাসে। 
: হাসি কেন পায় সেটাই বলুন।

এ তো মহা যন্ত্রণা। ভদ্রলোক যেভাবে দাঁড়িয়ে আছেন তাতে মনে হচ্ছে জবাব না শুনে তিনি যাবেন না। তাঁর না হয় কাজকর্ম নেই, রিটায়ার্ড মানুষ কিন্তু আমার তো কাজকর্ম আছে আছে। আমি বললাম, মজিদ সাহেব আমি আপনাকে একটা গল্প বলি। গল্প শুনে আপনি হাসবেন। তারপর আপনি নিজেই চিন্তা করে বের করবার চেষ্টা করুন কেন হাসলেন।

: এটা মন্দ নয়। বলুন আপনার গল্প।

আমি গল্প শুরু করলাম--এক লোক একটি সিনেমা একত্রিশ বার দেখেছেন শুনে তার বন্ধু বলল, একত্রিশ বার দেখার মতো কী আছে এই সিনেমায়? লোকটি বললো, সিনেমার এক জায়গায় একটি মেয়ে নদীতে গোসল করতে যায়। সে যখন কাপড় খুলতে শুরু করে ঠিক তখন একটা ট্রেন চলে আসে। আমি একত্রিশ বার ছবিটা দেখেছি কারণ আমার ধারণা কোন না কোনবার ট্রেনটা লেট করবে।

মজিদ সাহেব আমার দিকে হা করে তাকিয়ে রইলেন। অবাক হওয়া গলায় বললেন--ট্রেন লেট হবে কেন? প্রতিবার তো একই ব্যাপার হবে।

আমি বললাম হাসিটা তো এইখানেই।

: একই ব্যাপার প্রতিবার ঘটেছে এরমধ্যে হাসির কী?

মজিদ সাহেব গম্ভীর মুখে বাড়ির দিকে রওনা হলেন। মনে হল আমার উপর খুব বিরক্ত। আমি যে অভিজ্ঞতার কথা বললাম এ জাতীয় অভিজ্ঞতা আপনাদের সবার নিশ্চয়ই আছে! অনেক আশা নিয়ে একটা রসিকতা করলেই সেই রসিকতাটা ব্যাঙের মতো চ্যাপ্টা হয়ে পড়ে গেল।

আমেরিকান একটি বইতে একশটি রসিকতা দেওয়া আছে এবং বলা হয়েছে এই রসিকতাগুলোর সাফল্যের সম্ভাবনা শতকরা নিরানব্বই দশমিক তিন দুই ভাগ। আমি এর একটা এক বিয়ে বাড়ির আসরে চেষ্টা করে পুরাপুরি বেইজ্জত হয়েছি। একজন শুধু আমার প্রতি করুণার বশবর্তী হয়ে একটু ঠোঁট বাঁকা করেছিলেন কিন্তু অন্যদের গম্ভীর মুখ দেখে সেই বাঁকা ঠোঁট সোজা করে জানালা দিয়ে বাইরের দৃশ্য দেখতে লাগলেন। জনৈকা তরুণী চশমার ফাঁক দিয়ে এমনভাবে আমাকে দেখতে লাগল যেন আমার মাথায় দোষ আছে।

গল্পটা এরকম।

এক বন্ধু আরেক বন্ধুকে জিজ্ঞাস করছে--ফ্রান্স শহরটা কেমন? 
বন্ধু বলল, ভালো। সেখানে এয়ারপোর্টে নেমে তুই যদি একটা মোটর গাড়ি ভাড়া করিস তাহলে দেখবি সেই ড্রাইভার তোর সঙ্গে কি ভদ্র ব্যবহার করছে। এমনও হতে পারে সে তোকে তোর বাসায় নিয়ে যাবে। রাখবে তার বাড়িতে। নাচ-গান করবে। এবং এই যে তুই তাঁর বাড়িতে থেকে এত আনন্দ ফূর্তি করলি, তার জন্য উল্টা তোকে একগাদা টাকা দিবে।

: বলিস কী? তুই গিয়েছিলি নাকি ফ্রান্স?

আমি যাইনি, আমার বৌ গিয়েছিল। তার প্র্যাকটিকাল এক্সপেরিয়েন্স। সে তো আর বানিয়ে বানিয়ে বলবে না। এরকম মেয়েই সে না।

এই গল্পে কেউ হাসলো না কেন? আমি ভেবে টেবে বের করলাম এরকম একটা ভেন্দা যুবকের এমন বউ থাকতেই পারে না যে একা একা ফ্রান্স যাবে। এই কারণেই গল্পটি কেউ বিশ্বাস করতে পারছে না। কি যন্ত্রণা, হাসির গল্পের আবার বিশ্বাসযোগ্যতা কী? আমাদের মুশকিল হচ্ছে সিরিয়াস গল্পের বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে আমরা মাথা ঘামাই না। হাসির গল্প হলেই গম্ভীর হয়ে ভাবতে বসি গল্পটি কি বিশ্বাসযোগ্য? ভেন্দা ধরনের ছেলেটির বউ ফ্রান্সে কেন গেল?

রসিকতা যারা করেন তারা বেইজ্জত হবার আশংকা মাথায় নিয়েই করেন। নো রিস্ক নো গেইন ব্যাপার এবং দু’একটা যখন লেগে যায় তখন তাদের উৎসাহের সীমা থাকে না। রসিকতা করাটাকে তখন তারা পবিত্র দায়িত্ব মনে করেন। আগাড়ে বাগাড়ে রসিকতা করে আশেপাশের মানুষদের বিরক্তির চরম সীমায় পৌঁছে দেন। আমি একবার শ্যামলী থেকে গুলিস্তান যাবার পথে এরকম একজনের দেখা পেয়েছিলাম। বাসে অসম্ভব ভিড়। প্রচন্ড গরম। ঘামের কটু গন্ধ। এর মধ্যে একজন তার পরিচিত একজনকে পেয়ে গেলেন এবং সঙ্গে সঙ্গে বললেন, এই মোজাম্মেল একটা চুটকি শোন। একবার এক বিইয়ে বাড়িতে বরযাত্রী আসতে দেরি করছে তখন বরের ফুপাতো বোন...

মোজাম্মেল যার নাম সে একবার অগ্নিদৃষ্টি নিক্ষেপ করল। তাতে লাভ হল না। ভদ্রলোক দীর্ঘ গল্প শেষ করে দ্বিতীয় গল্প শুরু করলেন। টাক মাথার এক লোক বিরক্ত হয়ে বললেন, চুপ করেন তো ভাই।
: কেন চুপ করব? আপনার কি অসুবিধা করলাম? 
: কানের কাছে ভ্যান ভ্যান করছেন এটা অসুবিধা না?

ভদ্রলোক চুপ করে গেলেন। সায়েন্স ল্যাব পর্যন্ত এসেই আবার তার গলা খুস খুস করতে লাগল। তিনি মোজাম্মেলকে তিন নম্বর রসিকতাটি বললেন। অত্যন্ত আশ্চর্যের ব্যাপার এই রসিকতাটি হিট করল। বাসশুদ্ধ লোক হু হু করে হেসে উঠল। এমন কি সেই টাক মাথার ভদ্রলোক ঠা ঠা জাতীয় বিচিত্র শব্দ করে হাসতে লাগলেন।

অবশ্যই এ সংসারে কিছু ভাগ্যবান লোক আছেন, তাঁদের সব রসিকতা ‘পাবলিক খায়’। এটা বিরাট একটা যোগ্যতা। কিন্তু মুশকিল হচ্ছে যারা এই যোগ্যতা অর্জন করেন অল্পদিনের মধ্যেই তাঁদেরকে কেমন যেন বিমর্ষ হয়ে যেতে দেখা যায়। জীবনের প্রতি সব রকম আকর্ষণ হারিয়ে ফেলতে থাকেন। চল্লিশ না হতেই তাঁদের দেখা যায় পঞ্চাশের মত। কারণ খুব সহজ, এই জাতীয় জন্ম-রসিকদের সব কথাই আমরা সবাই রসিকতা হিসেবে নেই। যা একসময় জন্ম-রসিকদের উপর মানসিক চাপ ফেলতে শুরু করে। উদাহরণ দেই, আমার এক বন্ধু আব্দুস সোবাহান জন্ম-রসিক। স্কুল জীবন থেকে সে আমাদের হাসাচ্ছে। কলেজ জীবনেও একই অবস্থা। সংসারে ঢুকে সে নানান সমস্যায় পড়ল। অল্প বেতন। অনেকগুলি ছেলে-পুলে। অভাব-অনটন। একেকবার সে দুঃখের গল্প করে, আমরা হেসে গড়িয়ে পড়ি। একবার বিকেল বেলা মুখ শুকনো করে বলল, ঘরে আজ রান্না হয় নাই ভাই। একটা পয়সা নেই।

শেষ করবার আগে এই প্রসঙ্গে একটা দামী উপদেশ দিতে চাচ্ছি। অল্প বয়সী মেয়েদের সাথে কখনো কোন রসিকতা করবেন না। যদি এদের কোন একটা রসিকতা পছন্দ হয়ে যায় তাহলে আপনার অবস্থা কাহিল। ‘ঐ গল্পটা আরেকবার বলেন না। ঐ গল্পটা আরেকবার বলেন না।’

শিরীন নামের এক মেয়েকে কোন এক কুক্ষণে নাসিরুদ্দিন হোজ্জার একটা গল্প বলেছিলাম। তারপর থেকে যেখানেই তার সঙ্গে দেখা হয় সে হাসতে হাসতে গড়িয়ে পরে এবং বলে--ঐ গল্পটা আরেকবার বলেন। প্লিজ।

আমাকে বলতে হয়। তিন বছরের মধ্যে আমি হাজার খানিকবার এই গল্প বললাম। জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠল। নাসিরুদ্দিন হোজ্জাকে কাছে পেলে কাঁচা খেয়ে ফেলি এমন অবস্থা। সেই সময়কার কথা, নিতান্ত উপায়ান্তর না দেখেই রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে ব্লাডারের প্রেশার কমাচ্ছি, মনে মনে প্রার্থনা করছি যেন পরিচিত কারোর সঙ্গে দেখা না হয়। ঠিক তখন আমার পেছনে একটা রিক্সা থামল। আমার বুক ধক্‌ করে উঠল। শিরীনের আদুরে গলা, হুমায়ূন ভাই এখানে কী করছেন?

আমি মনে মনে বললাম, হারামজাদী দেখছিস না কি করছি? দ্রুত জিপার লাগাতে গিয়ে আরেকটা অ্যাকসিডেন্ট হল। জিপার দেয়া প্যান্ট যারা পরেন তাঁদের জীবনে এ জীতয় দুর্ঘটনা একাধিকবার ঘটে। তবু ফ্যাকাসে হাসি হেসে বললাম, তারপর কী খবর? ভালো তো?

শিরীন বলল, এ হচ্ছে আমার বান্ধবী লোপা, আপনি এঁকে ঐ গল্পটা বলেনতো। প্লিজ। না না বলতেই হবে। আমি কোন কথা শুনব না।

সেই থেকেই আমি কারো কঙ্গে রসিকতা করতে পারি না। কারো রসিকতা শুনে হাসতেও পারি না। রিটায়ার্ড এসপি, মজিদ সাহেবের মত নিজেকে প্রশ্ন করি--মানুষ হাসে কেন?

পুনশ্চ: পাঠক পাঠিকাদের জন্য একটি রসিকতা। এই রসিকতা অনেকটা আইকিউ টেস্টের মত। এটা শুনে কেউ যদি হাসে তাহলে বুঝতে হবে তার বুদ্ধি কম। যে যত শব্দ করে হাসবে সে তত বোকা। যদি না হাসে তাহলে সে বুদ্ধিমান। যদি বিরক্ত হয় তাহলে সে আঁতেল।

এক লোক কানে কম শোনে।
সে তার বেগুন ক্ষেতের পাশে দাঁড়িয়ে আছে। পথচারী এক ভদ্রলোক জিজ্ঞাস করলেন, আপনার ছেলেপুলে কি? 
লোকটা বলল, বৎসরে দুই একটা হয়। আগুন দিয়ে পুড়িয়ে খাই।

১০৪১ পঠিত ... ০৮:১৩, জুলাই ১৯, ২০১৯

আরও

পাঠকের মন্তব্য

 

ইহাতে মন্তব্য প্রদান বন্ধ রয়েছে

আপনার পরিচয় গোপন রাখতে
আমি নীতিমালা মেনে মন্তব্য করছি।

আইডিয়া

গল্প

সঙবাদ

সাক্ষাৎকারকি

স্যাটায়ার


Top