লুঙ্গি কি আদৌ একটি অশ্লীল পোশাক?   

২৬২৫ পঠিত ... ১৬:২০, জানুয়ারি ৩০, ২০২২

lungi-oshlil

বাঙালির বিভিন্ন ঐতিহ্যের মতো এক বিশাল ঐতিহ্যের নাম লুঙ্গি। এমন আরামদায়ক পোশাক সারা বিশ্বে আর দ্বিতীয়টি খুঁজে পাওয়া যাবে কিনা তা নিয়ে রয়েছে বেশ সন্দেহ। বাংলাদেশে বাস করেন কিন্তু কখনও লুঙ্গি পড়েননি, এমন মানুষও খুঁজে পাওয়া ভার। তবে সম্প্রতি সাহিত্যিক তসলিমা নাসরিনের লুঙ্গি সংক্রান্ত একটি পোস্টের পর ফেসবুক এখন গরম লুঙ্গিতে। তার চোখে বাঙালি পুরুষের এক অশ্লীল পোশাকের নাম লুঙ্গি! এই উপলক্ষ্যেই আজ আমাদের আয়োজন। চলুন জেনে আসি লুঙ্গির আদ্যোপান্ত...

লুঙ্গির উৎপত্তি নিয়ে কথা বলতে গেলে প্রথমেই মনে আসে লুঙ্গি নিয়ে এক মজার গল্পের কথা। এক রাজা গেছেন প্রজাদের সভায়। পরনে ছিল পাজামা। সভার মাঝখানে পেট মোচড় দিয়ে উঠলে গেলেন টয়লেটে। কিন্তু, পাজামার কোমরের বন্ধনী তাড়াতাড়ি খুলতে না পারায় ঘটে গেলো বিপত্তি। পাজামার পেছনটা ভিজে হয়ে গেলো হলুদ। এতে রাজা ক্ষেপে আগুন। তাৎক্ষণিক রাজ্যের প্রধান উজিরকে ডেকে পাজামার বন্ধনী সমস্যার সমাধান খুঁজে বের করার কঠোর নির্দেশ দিলেন। যেহেতু পাজামার গিট্ এতো বড়ো দুর্ঘটনা ঘটিয়েছে, রাজার ইচ্ছে, বাকি জীবনে তিনি আর পাজামা পরবেন না।

রাজার নির্দেশ বলে কথা! যেই কথা সেই কাজ। প্রধান উজির তাৎক্ষণিক রাজ্যের সব বিশেষজ্ঞ এক করে পাজামার এক বিকল্প খুঁজে বের করলেন। সেই বিকল্পের আধুনিক নাম ‘লুঙ্গি’, যাতে কোনো বন্ধনী বা রশি নেই।

দক্ষিণে এর প্রচলন সবচেয়ে বেশি দেখা যায়, তাই  ধারণা করা হয় লুঙ্গির সূচনা দক্ষিণ ভারতে। দক্ষিণভারতের তামিলনাড়ুকেই এর জন্মস্থান বলা হয়। দক্ষিণ ভারতের সংস্কৃতিতে লুঙ্গি এখনও এক বড় জায়গা দখল করে আছে। তবে এখন এই লুঙ্গি আমাদের উপমহাদেশের বহু সম্প্রদায়ই ব্যবহার করে থাকেন।  

লুঙ্গির পূর্বসূরি:    

 লুঙ্গির পূর্বসূরি হিসেবে ধরা হয় 'ভেস্তি' নামের এক ধরনের পোশাককে। ইতিহাস বলে, এককালে মসলিন কাপড়ের তৈরি এই ভেস্তি তামিল থেকে ব্যবিলনে নিয়মিতভাবে রপ্তানী হতো। যদিও এখনও অনেক বিদেশীদের কাছেই এই লুঙ্গি এক আশ্চর্যের বিষয়। বোতাম, দড়ি তো দূরে থাক; বেল্ট, ফিতা, চেইন, সেফটিপিন কোন কিছুই নেই এই লুঙ্গিতে। ব্যবহারকারীরা সাধারণত এক বা, দুই গেঁড়ো বাঁধনের মাধ্যমে কোমরে জড়িয়ে পায়ের দিকে ঝুলিয়ে এটি পড়ে থাকেন।

লুঙ্গি প্রসঙ্গে গবেষক গোলাম মুরশিদ তাঁর ‘হাজার বছরের বাঙালি সংস্কৃতি’ বইতে লিখেছেন, ‘উনিশ শতক শেষ হওয়ার আগেই ইংরেজি-শিক্ষিতদের মধ্যে পশ্চিমা পোশাক অথবা সে পোশাকের কিছু উপকরণ অনুপ্রবেশ করেছিল। তবে বৃহত্তর বাঙালি সমাজে বহাল থাকে সনাতনী পোশাক।’

 তিনি আরও লিখেছেন, ‘বিশ শতকের গোড়ার দিকে মুসলিম-পরিচালিত পত্রপত্রিকায় শিক্ষিত মুসলমানদের ধুতি পরার সমালোচনা করা হয়েছে। তখন ওই সব পত্রপত্রিকার নিবন্ধে ধুতির বদলে পাজামা পরার অনুরোধ জানানো হয়। গ্রামের মুসলমানরা অবশ্য আগে থেকেই ধুতির বদলে লুঙ্গি পরতে শুরু করে। দেশ ভাগের পর দ্রুত পূর্ববাংলায় পুরুষদের পরনে ধুতির জায়গা দখল করে নেয় লুঙ্গি।’

লুঙ্গি এবং বাংলাদেশ:

বাংলাদেশ লুঙ্গি ‘ম্যানুফ্যাকচারাস, এক্সপোর্টার্স অ্যান্ড ট্রেডার্স অ্যাসোসিয়েশন' এর তথ্য ও ব্যবসায়ীদের তথ্যনুযায়ী, দেশের প্রায় চার কোটি লোক লুঙ্গি পরে। প্রতিজন দু’টি করে লুঙ্গি পরলেও তাহলে বার্ষিক চাহিদা প্রায় আট কোটি পিস, যার বাজার মূল্য প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকা। লুঙ্গি বাংলাদেশে একটি অনানুষ্ঠানিক পোশাক হিসেবে প্রচলিত।

স্বাধীনতার পর একসময় নরসিংদী, কেরানীগঞ্জের রুহিতপুর, দোহার, নবাবগঞ্জ ও শ্রীনগরের হস্তচালিত তাঁতের তৈরি লুঙ্গি প্রসিদ্ধ ছিল। কিন্তু চাহিদা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ১৯৯৮ সালের দিকে যন্ত্রচালিত তাঁতের লুঙ্গি তৈরি শুরু হয়। বর্তমানে যন্ত্রচালিত তাঁতেই চাহিদার ৯৫ শতাংশ লুঙ্গি তৈরি হচ্ছে।

প্রথম লুঙ্গি ব্র্যান্ডিং:

আমাদের দেশে প্রথম লুঙ্গির ব্র্যান্ডিং শুরু করে হেলাল অ্যান্ড ব্রাদার্স। ট্রেডমার্ক লাইসেন্স নিয়ে ১৯৯৩ সালে স্ট্যান্ডার্ড এবং আমানত শাহ লুঙ্গি ব্র্যান্ডিং শুরু করে। এরই ধারাবাহিকতায় পরে এটিএম, অনুসন্ধান, পাকিজা, বোখারি, অমরসহ আরো বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান শুরু করে লুঙ্গির ব্র্যান্ডিং।

লুঙ্গির সবচেয়ে বড় পাইকারি বাজার বসে নরসিংদীর বাবুরহাট, সিরাগঞ্জের শাহজাদপুর ও টাঙ্গাইলের করটিয়ায়। এসব বাজার থেকেই সারা দেশের পাইকারি ব্যবসায়ীরা লুঙ্গি কিনে স্থানীয় বাজারে বিক্রি করেন।

বিভিন্ন অঞ্চলে লুঙ্গি:

ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে লুঙ্গির বেশ প্রচলন আছে। কেরালায় নারী পুরুষ উভয়েই লুঙ্গি পড়ে থাকেন। এখানে লুঙ্গিকে কিছুটা দরিদ্র পোশাক হিসেব বিবেচনা করা হয়। তামিলনাড়ুতে শুধু পুরুষরাই লুঙ্গি পড়ে থাকেন।

মায়ানমারে লুঙ্গিকে ডাকা হয় 'লোঙ্গাই' নামে। এটি মায়ানমারের জাতীয় পোশাক। পুরুষেরা এটি ঘরে বাইরে সর্বত্রই পড়ে থাকেন। মহিলাদের লুঙ্গি এখানে পরিচিত 'তামাইন' নামে।  

এদিকে আবার ইয়েমেনে লুঙ্গিকে ডাকা হয় মা’আউস নামে। ইয়েমেনে সকল বয়সের পুরুষরাই স্বাচ্ছন্দে এই মা’আউস পরিধান করে থাকেন। সোমালিয়াতেও লুঙ্গির মতো পোশাক পুরুষদের মাঝে বেশ জনপ্রিয়। সোমালিয়ায় অফিসের সময় বাদে অন্য সময়ে প্রেসিডেন্ট থেকে শুরু করে সাধারণ জনগণ সবাই লুঙ্গি পড়ে থাকেন। সোমালিয়ায় লুঙ্গির সাথে আবার অতিরিক্ত হিসেবে বেল্টও পরিধান করা হয়ে থাকে।  

শুধু তাই নয়, পার্শ্ববর্তী জাপানেও লুঙ্গির প্রচলন আছে। সেখানে একটি উৎসবের পোশাকের নাম লুঙ্গি। ইন্দোনেশিয়া এবং মালয়েশিয়ায় লুঙ্গিকে 'সারং' বলে অভিহিত করা হয়। এ দুই দেশের মানুষেরা লুঙ্গির ভেতর জামা ইন করে পড়েন। এই লুঙ্গির উপরে সোমালিয়ার মানুষের মতো তারা বেল্টও পড়ে থাকেন!

লুঙ্গি বাঙালীর জন্য শুধুই একটা পোশাক না, এটি একটি আবেগের নাম। বাংলাদেশের কোটি কোটি পুরুষের আস্থার নাম লুঙ্গি, এর তো অশ্লীল হবার প্রশ্নই আসে না!

 

References: 

http://bonikbarta.com/

http://www.kalerkantho.com/

http://www.somewhereinblog.net/

http://www.roar.media

http://archive.prothom-alo.com/

২৬২৫ পঠিত ... ১৬:২০, জানুয়ারি ৩০, ২০২২

আরও eআরকি

পাঠকের মন্তব্য

আইডিয়া

কৌতুক

রম্য

সঙবাদ

স্যাটায়ার


Top