গায়ক ও অভিনেতা হিসেবে তাহসানকে সবসময় ভালো লাগে। তার যে সৌম্য, স্নিগ্ধ, স্থিতধী, মোলায়েম বাক সক্রিয়তা সেটা বাংলাদেশের আভিজাত্যের প্রতিনিধিত্বশীল। একজন শিল্পীর জীবনে যা ঘটে; নানারকম বাঁকবদল, ব্যক্তিজীবনের প্রেম, ভালোবাসা, বিচ্ছেদ, বিরহ সবকিছুকে তাহসান তার সহজাত ব্যক্তিত্বের সৌন্দর্য্য দিয়ে জয় করেছেন। শিল্পীজীবনে ছেদ ঘটতে দেননি কখনও। প্রায় আড়াই দশকের শিল্পীজীবনে দর্শক-শ্রোতার ভালোবাসা পেয়েছেন। তার গান শুনলে, তার কথা শুনে তাকে ভালো না বেসে উপায় নেই।
তাহসান তার সাবেক জীবনসঙ্গী আরেক গুণী শিল্পীর সঙ্গে সম্পর্কচ্যুতিতে যেরকম শিষ্ট ও পরিশীলিত আচরণ করেছেন; তা ক্রমাগত কর্কশ ও আনসফিস্টিকেটেড হয়ে ওঠা সমাজের জন্য উদাহরণীয় হতে পারে। এরপর তিনি তার সন্তান আর সংগীত নিয়ে দীর্ঘসময় পাড়ি দিয়েছেন। তার সাবেক সঙ্গী এ ব্যাপারে অবশ্যই কৃতিত্বের দাবীদার। দুজন মেধাবী ও রুচিশীল মানুষ কীভাবে সন্তানের প্রশ্নে একজন আরেকজনকে সহযোগিতা করতে পারেন; সেটা শেখার জন্য এটা একটা নান্দনিক কেস স্টাডি হতে পারে।
সন্তান বড় হয়েছে; তার এখন নিজের জীবন বিকাশের সময়। তাহসান আরেকটি সম্পর্কে জড়িয়েছেন কম্প্যানিয়নশিপের প্রয়োজনে। এর মাঝে এই গায়কের জীবনে অনেক বড় ট্র্যাজেডি ঘটেছে। কণ্ঠনালীর প্রদাহে তার এক নাগাড়ে গান গাওয়ার ক্ষমতা কমে গেছে। প্রদাহ কম থাকলে তখনই কেবল গান গাইতে পারেন। গতবছর তিনি তার ভক্তদের এই দুঃসংবাদ দিয়েছেন। ধীরে ধীরে সংগীত জগৎ থেকে অবসর নিতে হবে; এই ইঙ্গিত তিনি অস্পষ্ট রাখেননি। একজন শিল্পীর স্ট্রিম অফ কনশাসনেস নানাভাবে কাজ করে; তাকে ভাবায়। তাহসান যখন বুঝতে পেরেছেন তার কণ্ঠনালীর প্রদাহ আগের মতো গাইতে দিচ্ছে না; তিনি সান্ত্বনা খুঁজেছেন, মেয়ে বড় হয়েছে; এখন আগের মতো প্রেমের গান গাইলে মঞ্চে নাচানাচি করলে তাকে মানাবে কি! কারণ নতুন দর্শক ও শ্রোতারা তো তার মেয়ের বয়েসী হয়ে পড়ছে।
তাহসান সবসময়ই পারফেকশনিস্ট। সংগীতের মানের সঙ্গে আপোষ করেননি কখনও। তাই তিনি যখন অনুভব করেছেন, কণ্ঠ তাকে সেই পারফেকশন ধরে রাখতে দিচ্ছে না; তিনি শোবিজের রুপালি পর্দা নামিয়ে অবসরে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন।
কলকাতার বাংলা চলচ্চিত্রের প্রবাদ প্রতিম অভিনেত্রী সুচিত্রা সেন যেমন বয়স বেড়ে গেছে এই চিন্তা থেকে নিজেকে অবগুণ্ঠনে ঢেকেছিলেন।
বলিউডের যুগ সেরা সংগীত পরিচালক এ আর রহমান আবার স্পিরিচুয়ালিটিকে বয়ে নিয়ে গেছেন সংগীত জীবনের পাশাপাশি।
একজন গায়ক, নায়িকা বা সংগীত পরিচালক তার জীবন নিয়ে কি সিদ্ধান্ত নেবেন, সেটা তার একান্ত ব্যক্তিগত বিষয়। তার জীবনট-চর্যা কেমন হবে, তা বাছাই তার ইচ্ছার স্বাধীনতা।
কিন্তু আমাদের সমাজটা তো আগের মতো স্বাভাবিক নেই। এখানে দুই জাতীয় অস্বাভাবিক মানুষের আমদানি ঘটেছে। এক জাতীয় অস্বাভাবিক মানুষ হচ্ছে ইসলামোফোবিক; আরেক জাতীয় মানুষ হচ্ছে ইসলামি চেতনার মালিক।
তাহসানের সংগীত জীবন গুটিয়ে নেওয়ার খবর পাবার পর; ইসলামোফোবিক লোকগুলো নেমে এলো হেইট স্পিচ নিয়ে; তাহসান মোল্লা হয়ে গেল এমন অনুসিদ্ধান্ত টেনে ললিতাদি, শিবব্রতদাদা, আলো আসবেই কালচারাল ফ্যাসিস্ট গ্রুপ তাহসানকে সামনে রেখে ইসলাম কোপাতে শুরু করল।
আর ইসলামি চেতনার মালিক গোষ্ঠী, শরিয়ত ভাই, আলহামদুলিল্লাহ উনি দীনের পথে এলেন। সারাজীবন গুনাহ করে ভুল পথে থেকে এখন উনি সঠিক পথে এলেন বলে, তৌহিদি জনতার বিজয় মিছিল শুরু করলেন।
আমি নিশ্চিত তাহসানকে তার গান, অভিনয় ও স্মিতভাষী বৈশিষ্ট্যের কারণে ভালোবাসেন; এমন মানুষের সংখ্যাই বেশি।
কিন্তু ইসলামোফোবিক ও ইসলামের মালিক উপমানব গোষ্ঠী দুটি ৭২ ঘণ্টা ধরে তাহসানকে উপলক্ষ করে ইসলাম কোপানো ও ইসলামের বিজয় মিছিল করে অস্থির করে তুলল সোশ্যাল মিডিয়া।
কিন্তু তাহসান তো এসব আনসফিস্টিকেডেট সাবহিউম্যানের জগৎ থেকে ছুটি চেয়েছেন। সারাজীবন এই কাউডাং ফেস্টিভ্যাল থেকে সন্তর্পণে দূরে থেকেছেন। কথাকলির আসর থেকে দূরে নিজস্ব জীবন-যাপন করতে সোশ্যাল মিডিয়া থেকে নিষ্ক্রিয় হয়ে গেছেন।
এই যে ইসলামোফোবিক ও ইসলামের মালিক দুটি বিপ্রতীপ জনগোষ্ঠী; এরা সংগীত কিংবা স্পিরিচুয়ালিটি কোনোটারই অর্থ বোঝে না। নেহাত রবাহুত হয়ে মিউজিক কাস্ট ও স্পিরিচুয়ালিটি কাস্টে উত্তীর্ণ হয়ে কাক ময়ূরপুচ্ছ লাগিয়েছে। ফলে সংগীতের প্রতি ভালোবাসা প্রকাশ কাকা রবে; আবার স্পিরিচুয়ালিটির প্রতি ভালোবাসা প্রকাশও কাকা রবে। এরা আসলে প্রস্তর যুগের তৃষ্ণার্ত কাক।
তাহসানের জন্য অনেক শুভ প্রত্যাশা রইল। আমরা ইউটিউবে তার গেয়ে যাওয়া গানগুলো শুনব। অভিনীত নাটকগুলো দেখব। অবসর নেওয়ার আভিজাত্য যে সমাজে নেই; চুলে কলপ করে, বোটক্স করে; ফুরিয়ে যাওয়া নট-নটীর ধস্ত কৌতুক অভিনয়ের জগতে এক টুকরো হিরণ্ময় নীরবতা খুঁজে নেওয়ার আহসান কেবল তাহসানই দেখাতে পারেন। সেখানেই তো তাহসান আভিজাত্যের আর নান্দনিকতার প্রতীক হয়ে থাকেন।
পাঠকের মন্তব্য