বাংলাদেশে স্বশিক্ষিত সাধারণ মানুষের মতো রাজনীতি সচেতনতা ও সবসময় সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারার মতো নাগরিক সমাজ বিরল। ইতিহাসের বাঁকে বাঁকে এরা সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
যেহেতু স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বকে এরা সবচেয়ে গুরুত্ব দেয়; তাই এরা ধাপে ধাপে লক্ষ্যে পৌঁছেছে। দেশের জন্য প্রাণ দিতে কৃষক-শ্রমিক-মেহনতি মানুষ কখনও কুণ্ঠাবোধ করেনি। ধুলিধূসর জনপদের জননী সাহসিকা তার সন্তানকে জনযুদ্ধ ও জন-বিপ্লবে পাঠিয়েছেন তার নিশ্চিত মৃত্যু জেনেও।
১৯৪৭ সালে বৃটিশ কাঁটা তুলতে জনমানুষ পাকিস্তান কাঁটার সাহায্য নিয়েছে। ১৯৭১ সালে পাকিস্তান কাঁটা তুলতে জনমানুষ ভারত কাঁটার সাহায্য নিয়েছে। তারপর অর্ধশতকের প্রস্তুতি শেষে ২০২৪-এ জুলাই বিপ্লবের মাধ্যমে ভারত কাঁটা উপড়ে ফেলেছে নিজস্ব শক্তিতে।
গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় ১৯৭০, ১৯৯১, ১৯৯৬, ২০০১-এর সাধারণ নির্বাচনে এদেশের সাধারণ মানুষ সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছে। অন্যান্য নির্বাচনে তাদের ভোটাধিকার হরণ করায় তারা ১৯৯০ ও ২০২৪-এ দুটি অভ্যুত্থান সংঘটিত করেছে। নব্বই-এ নূর হোসেন, চব্বিশ-এ আবু সাঈদ সিদ্ধান্ত নিয়েছে দেশ ও গণতন্ত্রের জন্য জীবন উৎসর্গ করার।
যে দেশের সাধারণ মানুষ এত রাজনীতি সচেতন, যে দেশের প্রত্যন্তের ধুলোমলিন চায়ের দোকানগুলো এরিস্টোটলের পাঠশালার মতো রাজনীতি চিন্তার সূতিকাগার; সেইখানে আশির দশক থেকে এক দুই প্রজন্মের শিক্ষিত, একটু সংস্কৃতি করা কিছু লোকজন তৈরি হতে থাকে, যারা বিশ্বাস করে, বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের বোধ-বুদ্ধি নেই; সুতরাং কাকে ভোট দিতে হবে তা ঠিক করে দেবে নব্য শিক্ষিত সুশীল সমাজ।
নব্বইয়ের আগে সংবাদপত্রগুলো সাংবাদিকতার আচরণবিধি মেনে যা ঘটেছে ঠিক সে খবর প্রকাশের চেষ্টা করত; অনেক প্রতিকূলতার মাঝেও। কিন্তু নব্বই-এর পর পত্রিকাগুলো খবরের চেয়ে অভিমতকে বেশী গুরুত্ব দিতে শুরু করে। বৃটিশের পৃষ্ঠপোষকতায় কলকাতায় যে বেঙ্গল রেনেসাঁ ঘটেছিল; ঠিক ঐ সাংস্কৃতিক আদলকে অনুসরণ করে গড়ে ওঠে ঢাকার সংস্কৃতি-জগৎ। কলকাতার বেঙ্গল রেনেসাঁ যেমন একধর্মী, অন্য ধর্মের মানুষকে যেখানে নিম্নবর্গের তকমা দিয়ে খারিজ করা হয়েছিল; ঢাকার রেনেসাঁটি হুবহু একই ভঙ্গিতে ধর্মপ্রাণ মানুষকে নিম্নবর্গের তকমা দিয়ে কৃত্রিম ব্রাহ্মণ্য বা কাল্পনিক আর্যবাদ তৈরি করে। দাক্ষিণাত্যের বর্গীর মতো দর্শন ও অবয়বের মানুষ উন্নাসিক কল্পনায় ফ্রেডরিখ নিটশের উবারম্যান হয়ে ওঠে। নবাবী আমলে এই বর্গীরা আমাদের জনপদ লুণ্ঠন করতে এসে অনেকে এখানে স্থায়ী হয়েছিল। ফলে শত বছরের লুণ্ঠনে দক্ষ বর্গীদের দেখা পেয়েছি আমরা রুলিং এলিটদের মাঝে।
তখন থেকে শুরু হয়ে যায় লোকজনকে শেখানো, ভোট দিতে শেখানো, কোন রাজনৈতিক দলকে সমর্থন করতে হবে তা শেখানো, কীভাবে খেতে হবে, কী পোশাক পরতে হবে, কীভাবে কথা বলতে হবে, কী গান গাইতে হবে এসব শেখানো। এরই মাঝে যেহেতু এরা বিশিষ্ট ব্যক্তি হয়ে উঠেছে, তাই ১৫১ জন বিশিষ্ট নাগরিকের বিবৃতিতে এরা ফতোয়া দিতে শুরু করেন।
বিশিষ্ট নাগরিক মানেই পাকিস্তান আমলে সরকারের কাছ থেকে প্লট নিয়ে ধানমন্ডির ধানক্ষেত পরিষ্কার করে বাড়িঘর তৈরি, মুক্তিযুদ্ধের পর গুলশানের ভিলা দখল; এরপর মুক্তিযুদ্ধের সুফল কুড়িয়ে অভিজাত সেজে ওঠা। আর তাদের ছেলেমেয়ে কথায় কথায় লোকজনকে বস্তি, ফকিন্নি, ছোটোলোক ইত্যাদি বলা। এটা বলাবাহুল্য যে, বৃটিশ আমলে সাহেবের সেরেস্তাদার কিংবা পিয়ন তেলাঞ্জলি দিয়ে সম্পদশালী হলে, তাদের ছেলেমেয়ে সমাজকে বড়লোক ও ছোট লোক এই দুইভাগে ভাগ করে নিয়ে লোকজনকে ছোট লোক, ইতর ইত্যাদি বলত। খুব আশ্চর্যজনক হলেও সত্যি যে, আজকের ফেসবুকে বা মিডিয়ায় যারা এসব শব্দ বলে, তাদের প্রোপিক ও অবয়বের দিকে তাকিয়ে দেখুন; ফর্সা জামাকাপড় সরিয়ে খসখসে লুঙ্গি ধূতি কিংবা দাঁত পাড় শাড়ি পরিয়ে দিলে তাদেরকে দেখে মনে হবে তারা বস্তিতে থাকে। ওই ইনফেরিয়রিটি কমপ্লেক্স থেকে এরা বস্তি শব্দটি ব্যবহার করে।
এইসব জিনিসপত্র যখন বিশিষ্টব্যক্তি হয়ে রাজনৈতিক অভিমত রাখে, তখন তারা যে দলের সুনাম করে, ওই দলের জনপ্রিয়তা তলানিতে চলে যায়; আর যে দলের প্রতি ঘৃণা প্রকাশ করে, ঐ দল অপ্রত্যাশিতভাবে জনপ্রিয় হয়।
এই বিশিষ্ট নাগরিকেরা মূলত আওয়ামী লীগের লোক। বিএনপিকে এরা ২০২৪-এর ৫ অগাস্টের আগে পর্যন্ত অপছন্দ করত; তার কাসুন্দি গাইত। প্রত্যেকবার বিএনপি ক্ষমতায় আসার পর এক বছরের মধ্যে বিএনপি ব্যর্থ হয়েছে তা প্রমাণ করে দিত ১৫১ জনের বিবৃতি দিয়ে, নেচে-কুঁদে। জুলাই বিপ্লবে যেহেতু নেতৃত্ব দিয়েছে অচেনা তারুণ্য, নতুন প্রজন্ম থেকে তৈরি হয়েছে নতুন নেতৃত্ব, তাই বিশিষ্ট নাগরিকেরা এই নতুন প্রজন্মকে উগ্রপন্থী, হিজবুত তাহরির ইত্যাদি প্রমাণের চেষ্টা করেছে আনন্দবাজার পত্রিকার ভাষা ধার করে। অকস্মাত বিএনপি হয়ে গেছে পতিত ফ্যাসিস্ট শাসকের কালচারাল উইং-এর প্রিয় পাত্র। বিএনপিও কালচারাল উইং-এর ললিতাদি, আনারকলি আপা, শিবব্রত দাদার মাখো-মাখো বুলি শুনে গদগদ হয়ে যোগ দিতে চেষ্টা করেছে জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবারের অন্দর মহলের দাওয়াতে।
দেশের সাধারণ মানুষ বিএনপির সঙ্গে কালচারাল ফ্যাসিস্টদের দহরম মহরম দেখে ভয় পেয়েছে। ফলে আলো আসবেই গ্রুপ-এর আলো ঝলমলে জলসাঘরের ছবি দেখে তীব্র বিবমিষায় তিক্ত প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছে। তখন আবার ফর্সা কাপড় পরা বস্তি অবয়বের লোকেরা, সাধারণ মানুষকে বকা দিয়ে বলেছে, শত্রু বলেই মুখ দেখবো না, ওসব বস্তিতে চলে; ভদ্রলোকদের শত্রুর সঙ্গে গলাগলি করতে হয়। উল্লেখ্য যে, চব্বিশের জুলাই অভ্যুত্থানে দেশের জন্য লড়তে গিয়ে অসংখ্য বস্তিবাসী প্রাণ হারিয়েছেন।
অথচ আওয়ামী লীগের পনেরো বছরের শাসনে, বিএনপির সঙ্গে বসে সমঝোতার প্রস্তাব দিলে, লীগের লোকেরা ঠোঁট ফুলিয়ে বলত, তেলে আর জলে মিশ খায় না। লীগ আর বিএনপিকে এক পাল্লায় মাপবেন না। আওয়ামী লীগ তখন প্রণব মুখার্জির ব্যাপ্টিজম পেয়ে কল্পনায় নিজেদের উচ্চবর্ণ ভাবত। আসলে আওয়ামী লীগ হচ্ছে পচা ডিম। এর সঙ্গে এক ঝুড়িতে ভালো ডিম রাখলেও তা পচে যেতে বাধ্য। বিএনপির জনপ্রিয়তা সূচকে নিম্নগামিতার প্রধান কারণ, আওয়ামী লীগের অভিধান থেকে শব্দ ধার করে কথা বলা। আর জন-অপছন্দের কেন্দ্রে থাকা সুশীল সমাজের সমর্থন ও সুনামের পাত্র হয়ে ওঠা।
জনসমর্থনের ঈশ্বর ভদ্রপল্লীতে থাকেন না। তিনি থাকেন ছোটোখাটো মানুষের ঈশ্বর হয়ে দারিদ্র্যের অগমে দুর্গমে।
পাঠকের মন্তব্য