জুবিন গার্গ, শিল্পী তুমি, মানুষ তুমি

১৩ পঠিত ... ১১ ঘন্টা ৪৮ মিনিট আগে

দিন তিনেক আগে, সোশ্যাল মিডিয়ায় আসামের সংগীত শিল্পী জুবিন গার্গের মারা যাওয়ার খবর পড়লাম। এই নামের কাউকে চিনি বলে আমার মনে পড়ল না। পরে খবরের বিস্তারিত পড়তে গিয়ে দেখি, উনি ২০০৬ সালে গ্যাংস্টার সিনেমার ‘ইয়া আলী’ গানের সেই বিখ্যাত শিল্পী। আমার খানিকটা মন খারাপ হলো। ব্যস এইটুকুই!

কিন্তু ফেসবুক এলগরিদম কঠিন জিনিস। এরপর স্ক্রল করলেই জুবিন গার্গ বিষয়ক নানা খবর নিউজফিডে আসতে শুরু করল। এর মধ্যে একটা ভিডিও দেখে আমি নড়েচড়ে বসলাম।

জিপ টাইপের একটা গাড়িতে করে জুবিনের মৃতদেহ এয়ারপোর্ট থেকে গুয়াহাটি শহরের দিকে নিয়ে আসা হচ্ছে। রাস্তার দুই ধারে হাজার হাজার মানুষ দাঁড়িয়ে আছে! আর গাড়ির পেছনে পাগলের মতো দৌড়াচ্ছে আরও কয়েক হাজার মানুষ!

এরপর গত তিন দিন ধরে আমি জুবিন গার্গকে নিয়ে পড়াশোনা করার চেষ্টা করলাম। তার দেওয়া নানা সাক্ষাৎকার পড়লাম, বিভিন্ন অনুষ্ঠানে তার পারফরম্যান্স দেখলাম! বোঝার চেষ্টা করলাম, একজন সংগীত শিল্পীর মৃ্ত্যুতে আসামের মানুষ এমন উন্মাদ হয়ে গেল কী কারণে?

বিশেষ করে এমন এক সময়ে, যখন কেউ মারা গেলেও তাকে নিয়ে ট্রল হয়, মৃত ব্যক্তি আমার পছন্দের না হলে তার মৃত্যুর খবরের নিচে হা হা রিয়েক্ট পড়ে, মতাদর্শের বিপরীতে পোশাক পরলে মোরাল পুলিশিং করতে একবিন্দু পিছপা হই না আমরা...

মধ্যবিত্ত পরিবারে বেড়ে ওঠা জুবিনের মা ও বোন সংগীত শিল্পী ছিলেন। মা ইলাবতি অসমীয়া ভাষার ঐতিহ্যবাহী লোকসংগীত শিল্পী ছিলেন, বোন জুনলিও অসমীয়া গান পরিবেশন করতেন। দুজনেই আঞ্চলিকভাবে পরিচিত ছিলেন। ওইটুকুই...

ছোটবেলায় মায়ের কাছে গান শিখেছেন জুবিন। স্কুল-কলেজে গান গাইতেন। ২০ বছর বয়সে, ১৯৯২ সালে আসে তার প্রথম অ্যালবাম। এরপর গানের সাথেই লেগে ছিলেন। ২০০২ সালে সড়ক দূর্ঘটনায় বোনের মৃত্যুর পর, জুবিনের জীবন পাল্টে যায়। বিরহ এসে চিরস্থায়ী ভর করে তার কণ্ঠে...

এরপর, দিনে দিনে তার গানের সংখ্যা বেড়েছে! প্রায় ৪০টা ভাষায় অন্তত ৩৮ হাজার গান রেকর্ড করেছেন তিনি। গেয়েছেন সব বয়সী মানুষের জন্য গান।

২০০৬ সালে প্রথমবারের মতো বলিউডে ব্রেকথ্রু পান। অনুরাগ বসুর গ্যাংস্টার সিনেমায় ‘ইয়া আলী’র মতো হিট গান ও পরে ফিল্ম ফেয়ারের জন্য মনোনীত হওয়ার পর, আর আসামে পড়ে থাকার কোনো কারণ ছিল না। কিন্তু গানের জন্য সারা দুনিয়া চষে বেড়ালেও, মূলত: আসাম ছেড়ে কোথাও যেতে চান নাই জুবিন। বিভিন্ন স্টেজ শো-তে নিজেকে ‘পাহাড়ের সন্তান’ বলে পরিচয় দিতেন।

১০/১৫ বছর আগে কোলকাতার বাংলা সিনেমা যখন পুরনো ধাঁচ থেকে আধুনিক বাণিজ্য ও আর্ট ফিল্মের ঘরানায় বদলে যেতে শুরু করল, তখন জিৎ ও দেবের বিভিন্ন সিনেমায় একের পর এক হিট গান উপহার দিয়েছেন জুবিন। বিশেষ করে বিরহ ও বেদনার গানে জুবিন হয়ে উঠেন বিকল্পহীন!

কোলকাতায় তার অধিকাংশ গানের সংগীত পরিচালক ছিল জিৎ গাঙ্গুলি। আসাম থেকে রাতের শেষ ফ্লাইটে কোলকাতায় এসে গান রেকর্ডিং করে ভোরে আবার আসাম ফেরত যেতেন। জিৎ গাঙ্গুলি বিরক্তি প্রকাশ করলে বলতেন, ‘এমন দরদ আর বেদনার গান রাত গভীর না হলে গাওয়া যায়, দাদা?’ মূলত ওসব গানের মধ্য দিয়েই জুবিন কোলকাতার বাংলাভাষী মধ্যবিত্তের জীবনে ঢুকে পড়েন। ঘটনাটা এমন দাঁড়ায় যে, ভাসান থেকে গায়ে হলুদ, ব্যাডমিন্টন টুর্নামেন্ট থেকে ট্রাকের পেছনে সাউন্ড বক্স ঝুলিয়ে পাড়া দাপানো, জুবিনের গান ছাড়া অসম্ভব!

কিন্তু প্রশ্ন হলো, গান তো আরও অনেকেই গায়। জুবিনের চেয়ে ঢের ভালো শিল্পীও আছে। কিন্তু জুবিনকে কেনো মানুষ এত ভালবাসতো? তাও আবার এমন এক শিল্পী, যে কিনা গত ৫/৬ বছরে একটা হিট গান দিতে পারে নাই, মদ ছিল যার জীবনের সঙ্গী, মঞ্চে উঠে এলোমেলো গিটার বাজাতেন, যেকোনো সামাজিক ইস্যুতে রাজনীতিবিদদের এক হাত ‍নিতে ছাড়তেন না। এমনও দিন গেছে, মঞ্চে উঠে মদের তোড়ে আর গানই গাইতে পারেন নাই। ঘুমিয়ে পড়েছেন।

ভাবেন তো আমাদের দেশে হলে কী হতো? ঘাড় ধরে মঞ্চ থেকে নামিয়ে দিত না? আয়োজকদের হাতে মার খাওয়ার কথা তো! এরকম খবর তো আমরা প্রায়ই পত্রিকায় পড়ি!

আসল ঘটনা হলো, শুরু থেকেই ‘মানুষ-জুবিন’ ‘শিল্পী-জুবিন’-কে ছাড়িয়ে গিয়েছিলেন।

জুবিন ছিলেন সমাজ সেবক। যখনই কোথাও কেউ বিপদে পড়ত, জুবিন সেখানে হাজির! কেউ তার সাথে হাত মিলাতে আসলে জুবিন তার দিকে হাসিমুখে বুক বাড়িয়ে দিতেন। রাজ্যের নানা জায়গায় ঘুরে ঘুরে গাছ লাগাতেন। বিজেপি সরকার যখন রাজ্যে নাগরিক সনদ বানানো শুরু করল, জুবিন কাউকে তোয়াক্কা না করে সেটার বিরুদ্ধে কথা বলেছেন। করোনার সময় নিজের বাড়ি ছেড়ে দিয়ে ওটাকে ‘কোয়ারেন্টাইন সেন্টার’ বানিয়েছিলেন।

পশু-পাখির প্রতি তার ছিল গভীর প্রেম। তাই তার মৃত্যুর পর তার স্ত্রী যখন পালিত কুকুর চারটাকে নিয়ে গেল জুবিনকে শেষবারের মতো দেখার জন্য, সেই কুকুরদের চোখে যে বিষাদ ঝরে পড়ল, সেই দৃশ্য দেখে বুকে মোচড় দিয়ে ওঠে।

১৫ বছরের বিবাহিত জীবনে নিজেদের কোনো সন্তান ছিল না, কিন্তু জুবিন ও তার স্ত্রী গরিমা ছিলেন ১৫ সন্তানের পিতা-মাতা। গণধর্ষণের শিকার মেয়েকে তুলে এনে আশ্রয় দিয়েছেন নিজের কাছে। বাড়িতে ঝিয়ের কাজ করা কাজলি নামের এক মেয়ে যখন প্রবল নির্যাতনের শিকার হয়ে মৃত্যুর সাথে লড়ছে, তখন জুবিন তাকে তুলে এনেছেন, আদালতে মামলা লড়েছেন, সেই মামলায় জিতেছেনও! সেই খবর বিদ্যুৎ বেগে ছড়িয়ে পড়েছে ঘরে ঘরে। ফলে সব জেনারেশনের মানুষের অন্দরমহলে জুবিন ঢুকে পড়েছেন। ‘ক্যারিয়ারে চারটা গান কম হোক, চারটা স্টেজ শো কম না হয় হলো, কিন্তু জীবন থেকে চারটা ভালবাসার মুহুর্তকে ছেটে ফেলা যাবে না’-এই ছিল তার জীবনদর্শন!

এতিমদের ভরণপোষণ দিতেন। মুসলমান এতিম শিশুদের জন্য খুলেছিলেন মাদ্রাসা ও এতিমখানা, একটা ভিডিওতে দেখলাম, জুবিনের মৃত্যুর পর সেই এতিমখানার ছাত্র-শিক্ষকরা দাঁড়িয়ে তার গান গাইছে! রাস্তায় রাস্তায় তার ছবি টানিয়ে শোক পালন করছে সব ধর্মের মানুষ। মুসলমান ইমামের মোনাজাতে প্রদীপ জ্বালিয়ে বসে আছে প্রবল ধর্মবিশ্বাসী হিন্দু নারী! এক মুসলিম ছেলে জুবিনের ঢাউস সাইজের ছবির সামনে বসে কোরআন খতম দিচ্ছে…

জুবিনের একটা ডায়লগ খুব জনপ্রিয় ছিল। জনপ্রিয় শব্দটা আমি ইচ্ছা করেই ব্যবহার করলাম। ‘আমার কোনো ধর্ম নাই, আমার কোনো জাত নাই। আমার কোনো ভগবান নাই। আমি মুক্ত। আমি কাঞ্চনজঙঘা।’ বলেছিলেন, ‘মৃত্যুর পর আমাকে পোড়াইয়ো না। ব্রহ্মপুত্রে ভাসিয়ে দিও...

তার মানে জুবিন নাস্তিক ছিলেন। মঞ্চে দাঁড়িয়ে এরকম একটা কথা বাংলাদেশের কেউ বললে তার কী অবস্থা হতো ভাবা যায়? আমার ২০১৩/১৪ সালের দিকে নাস্তিক ব্লগারদের মৃত্যুর কথা মনে পড়ে যাচ্ছে। এখনকার পরিস্থিতি নাইবা বললাম!

অথচ যেই মানুষটা ভরা মঞ্চে টির্শাট উপরে তুলে বলে,আমার কোনো পৈতে নাই’, মানুষ সেসবকে গায়েই মাখল না। আসাম কিন্তু ছোট একটা রাজ্য। মানুষজন তত শিক্ষিতও না। অথচ সেই রাজ্যের প্রায় গেঁয়ো, অশিক্ষিত লাখ-লাখ মানুষ একটা ধর্মহীন লোককে ভগবানের কাতারে বসিয়ে দিল।

আজ একটা ভিডিও দেখলাম, মহালয়ার প্রস্তুতি চলার কথা। দুর্গাপূজার উৎসব শুরু হয়ে যাওয়ার কথা এর মধ্যে। কিন্তু কোনো রাস্তায় একটা মানুষ নাই। স্কুল বন্ধ, অফিস আদালত অটো বন্ধ হয়ে গেছে। ব্যবসা-বাণিজ্য স্থবির। তিন দিনের রাষ্ট্রীয় শোক! সুইগি, জামোটায় সব অর্ডার বন্ধ! ওখানকার মুখ্যমন্ত্রী বাকি সবার সাথে রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে জুবিনের গান গাইতেছে, আর চোখ মুছতেছে...

এক ঘরোয়া আড্ডায় জুবিন মজার ছলে বলেছিলেন, কেউ মরলে বোম্বে বন্ধ হয় না, চেন্নাই বন্ধ হয় না। কিন্তু আমি মরলে আসাম সাত দিনের জন্য বন্ধ হয়ে যাবে। কারণ আমি লিজেন্ড! আসামবাসী যেন জুবিনের কথাকে বাস্তবে রূপ দিতে বদ্ধপরিকর। 

মানুষ তার এক জীবনে টাকা-পয়সা, সোনা-দানা, হীরে-জহরত কত কি জমায়! গত তিন দিনে আমার মনে হলো, জুবিন মানুষ জমাতে চেয়েছেন।

তাই তার যতগুলো ভিডিও আমি দেখলাম, দেখলাম যে, এই মানুষটার চোখে অসম্ভব প্রেম। যখনই কারও দিকে তাকান, সেই দৃষ্টি প্রেম আর আকুতিতে ভরা। একেবারে পিউর। ফলে ৫২ বছরের জীবনে আসামের মতো এক ছোটো শহরের শিল্পী একশ কোটি টাকার মালিক হয়েও, রাস্তার পাশের ঝুপড়িতে বাবু সেজে বসে ভাত খেতে পারতেন। পকেট থেকে টাকা বের করে সেখান থেকে গুণে গুণে কয়েকটা নোট পাশে বসে থাকা দরিদ্র মানুষটার হাতে গুঁজে দিয়ে বাকিটা আবার নিজের পকেটে রাখতেন। না, সেই দেওয়ায় কোনো স্টারডম নাই, কোনো লোক দেখানো ভেল্কি নাই।

ফলে আসামের মানুষ এক সামান্য জনদরদি গায়কের ভেল্কিতে আটকে গেছে!

রবিন শর্মার একটা বইয়ের নাম, ‘হু উইল ক্রাই, হোয়েন ইউ ডাই।’ এটা আমার খুব প্রিয় একটা বই। গত তিন দিন ধরে এই বইটার কথা বারবার মনে পড়ছে।

নাহ! মৃত্যুর পর সবার জন্যই অনেক মানুষকে দলবেঁধে কাঁদতেই হবে, এমন কোনো কথা নেই। এটা ব্যক্তিগত চয়েজ!

কিন্তু এক অসমিয়া শিল্পীর মৃত্যুর পর যখন তার অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় ১৭ লাখ মানুষ জড়ো হয়ে এক সাথে তার গান গায়, চিৎকার করে কাঁদে, তখন ছাই হয়ে বাতাসে লীন হতে থাকা শরীরের প্রতিটা ইঞ্চি কেমন বোধ করে, সেটা ভেবে শিহরিত না হয়ে উপায় কী?

১৩ পঠিত ... ১১ ঘন্টা ৪৮ মিনিট আগে

আরও eআরকি

পাঠকের মন্তব্য

আইডিয়া

কৌতুক

রম্য

সঙবাদ

স্যাটায়ার


Top