ক্লিক দূরত্বে কমরেড ও সাউথ এশিয়ান ইউনিয়ন

২০২ পঠিত ... ১৭:০৯, আগস্ট ১৪, ২০২৪

17

র‌্যাডক্লিফের পেন্সিলের দাগ আর সেই বরাবর বার্ব-অয়্যার দিয়ে সীমান্ত দাগিয়ে রাখলেও দক্ষিণ এশিয়া আসলে একটি অখণ্ড সরোবরের মতো। সেখানে ঢাকায় একটি ঢিল পড়লে এর অভিঘাত কলকাতা, দিল্লি, মুম্বাই, করাচি, লাহোর, ইসলামাবাদে ছড়িয়ে পড়ে। বাংলাদেশের অকুতোভয় ছাত্রছাত্রীরা যারা জেনজি নামে পরিচিত; তারা পতিত স্বৈরাচার হাসিনাশাহির পতন ঘটালে গোটা দক্ষিণ এশিয়ার তরুণ প্রজন্ম জুলাই জেনজি বিপ্লবের সাফল্য উদযাপন করেছে একসঙ্গে।

বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান এই তিনটি দেশেই এই মুহূর্তে জনসংখ্যার সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ হচ্ছে তারুণ্য। একে ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড বলা হলেও; শাসক গোষ্ঠীর গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের অভাব, দুর্নীতি, দুঃশাসনের কারণে এই তারুণ্যের শক্তি অব্যবহৃত রয়েছে। তরুণদের সৃজনশীলতা বিকাশ কিংবা তাদের জন্য কর্মসংস্থান সৃষ্টির চেয়ে ক্ষমতার চেয়ার ধরে রাখার সাপ লুডু খেলাতেই বুঁদ দেশ তিনটির শাসকগোষ্ঠী।

বাংলাদেশে সদ্যবিদায়ী স্বৈরাচারী শাসক শেখ হাসিনা, ভারতের হিন্দুত্ববাদী শাসক নরেন্দ্র মোদি, পাকিস্তানের সেনা সমর্থিত শাসক শাহবাজ শরিফ; এদের রাষ্ট্রচিন্তা ও দেশ শাসন প্রক্রিয়া তামাদি বা ডেট এক্সপায়ার্ড অপকৌশলের অচলায়তনে বন্দি। স্বাধীনতার যথাক্রমে ৫৩ বছর ও ৭৭ বছর পরেও বৈষম্যধূসর দেশ তিনটি এস্টাবলিশমেন্ট বা রুলিং এলিটের নেহাত টাকা বানানোর মেশিন ও ভিআইপি প্রটোকল উপভোগের মধ্যযুগীয় জমিদারি ব্যবস্থা হয়ে রয়ে গেছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে গ্রাউন্ড জিরোতে দাঁড়িয়ে মাত্র পাঁচ-দশ বছরে ঘুরে দাঁড়িয়েছিল ইউরোপের জার্মানিসহ অন্য রাষ্ট্রগুলো। এরপর খুব অল্প সময়ের মধ্যেই কল্যাণরাষ্ট্রে রূপান্তরিত হয়। অথচ দক্ষিণ এশিয়ার অকল্যাণ রাষ্ট্রগুলো উগ্র জাতীয়তাবাদ আর কট্টর ধর্মীয় চেতনার বিষমিশেলে বিভাজন আর বিদ্বেষের নরক যন্ত্রণায় ছটফট করছে। ধনী ও দরিদ্রের কর্কশ ব্যবধানে প্রত্যেকটি দেশের মধ্যে ক্ষমতা-কাঠামোর বিলাসী উচ্চনগরী আর শাসিতের দারিদ্র্য বিশীর্ণ নিম্ননগরী তৈরি হয়েছে। ফলে স্বাধীনতা লাভের এত বছরেও স্বাধীনতার সুফল অনূদিত হয়নি সাধারণ মানুষের জীবনে। কল্যাণ রাষ্ট্র গড়া না গেলে তা যে রাষ্ট্রই হয়ে ওঠে না।

বাংলাদেশে ছাত্র-ছাত্রীদের বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনটি তাই দেশটির অধিকার বঞ্চিত মেহনতি মানুষের জীবনে দোলা দিয়েছিল। বৈষম্য ধূসর রিকশাওয়ালা, হকার, ক্ষুদে দোকানি, গার্মেন্টস শ্রমিক রাজপথে ছাত্রদের জীবন মিছিলে উদ্বেলিত হয়েছে। ফলে এই বিপ্লব ক্রমশ ছাত্রজনতার বৈষম্যবিরোধী লংমার্চ হয়ে উঠেছিল। নিষ্ক্রিয় মধ্যবিত্ত; স্বৈরাচারের ভয়ের শাসন উপেক্ষা করে এই ছাত্র-শ্রমিকের সঙ্গে মিছিলে হাঁটতে শুরু করলে তা হয়ে ওঠে ইতিহাসের এক অব্যয় গণ-অভ্যুত্থান।

জুলাই বিপ্লব ইন্টারনেট যুগের জেনজি প্রজন্মের প্রতিবাদের ভাষা। ফলে রংপুরের শহীদ আবু সাঈদের দুই বাহু প্রসারিত করে দাঁড়িয়ে থাকা বুকে ক্ষমতালোভী খুনিদের বুলেট গিয়ে আঘাত করলে; ভারত-পাকিস্তানের তরুণ প্রজন্ম এই আঘাতে ফুঁসে ওঠে। ভারতের কলকাতায় যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীরা বাংলাদেশে চলতে থাকা ছাত্রগণহত্যার প্রতিবাদে পথে নামে। ভারত ও পাকিস্তানের ছাত্রসমাজ টুইটার, ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম, ইউটিউব, টিকটকে এসে এই মানবতাবিরোধী অপরাধের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে থাকে।

ভারতের ইউটিউবার ধ্রুব রাঠি ও দেশভক্ত বাংলাদেশে ছাত্রজনতা হত্যার বিষয়টি সবার সামনে তুলে ধরলে; ভারতের ছাত্রজনতা অনুভব করে, এত আমাদের জীবনের ট্র্যাজেডির প্রতিবিম্ব, কোটি কোটি শিক্ষিত তরুণ-তরুণীর জন্য কর্মসংস্থানের কোনো উদ্যোগ নেই। উপরন্তু শাসক গোষ্ঠী ও তাদের বেনিফিশিয়ারিদের লুণ্ঠনে দেশে বৈষম্যের চূড়ান্ত এক বিভীষিকা চারপাশে।

পাকিস্তানের সিনিয়র সাংবাদিক জিও টিভিতে তার ক্যাপিটাল টক নামের অনুষ্ঠানে, বাংলাদেশের ছাত্রছাত্রীদের কাছ থেকে আমরা কী কী শিখতে পারি? এ বিষয়ে কনভারসেশন শুরু করলে; পাকিস্তানের সেনাসমর্থিত সরকারের বিরুদ্ধে ক্ষোভের খড়ের গাদায় দিয়াশলাইয়ের কাঠি জ্বলে ওঠে যেন। মিডিয়া ও ইন্টারনেট মিডিয়ার বৈশিষ্ট্য হচ্ছে তা বিপ্লব সঞ্চারিত করে মানুষের মস্তিষ্কে। ফলে শোষক ক্ষমতা কাঠামোর তৈরি কৃত্রিম রিয়ালিটি তাসের ঘরের মতো পড়ে যেতে থাকে; জনমানুষের হৃদয়ের মধ্যে চলতে থাকা জীবন মিছিলের সামনে।

শ্রীলঙ্কায় জনবিপ্লবে লুণ্ঠক শাসক রাজাপাকসের বাসভবনে ঢুকে সাধারণ মানুষ যেভাবে তার বেডরুমের বিছানায় বসে ছিল, তার সুইমিংপুলে সাঁতার কেটেছিল; ওই চিত্রকল্পের হুবহু রূপায়ণ আমরা দেখেছি হাসিনা পদত্যাগ করে ভারতে পালিয়ে যাওয়ার পর গণভবনে। একইভাবে বাংলাদেশে ছাত্র-ছাত্রীরা যেভাবে মৃত্যুভয় কাটিয়ে মহাপরাক্রমশালী স্বৈরাচারের পতন ঘটিয়েছে; যেভাবে ছাত্রজনতার ডাকে জনসমুদ্র তৈরি হয়েছে মধ্যজুলাই থেকে আগস্টের পাঁচ তারিখ পর্যন্ত; অত্যাচারী শাসকের বিরুদ্ধে ছাত্র-শ্রমিক-জনতার ঐক্যের ওই চিত্রকল্প এখন ভারত-পাকিস্তানের তরুণদের মনে। এটা নিঃসন্দেহে দেশদুটোর ক্ষমতা-কাঠামোর অচলায়তনের জন্য একটা অশনি সংকেত।

বাংলাদেশে জুলাই বিপ্লব সংঘটনের কালে পাকিস্তান ও ভারতের শাসক গোষ্ঠীর তৈরি করা ইতিহাসের ক্লিশে ন্যারেটিভ ধসে পড়েছে। পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধকে, ভারতের ষড়যন্ত্র বলে যে ন্যারেটিভ চালু করে রেখেছিল, সেখানকার তারুণ্য ইন্টারনেট থেকে তথ্য সংগ্রহ করে ও বাংলাদেশের তরুণদের সঙ্গে ভার্চুয়াল মেলামেশা থেকে তথ্য সংগ্রহ করে; ওই বস্তাপচা ন্যারেটিভকে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছে। তারা ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর গণহত্যা থেকে একালের পাকিস্তানে তারুণ্যের পছন্দের ইমরান খান সরকারকে সরিয়ে দিয়ে হত্যা-গুম-গ্রেপ্তার চালানোর দৃষ্টান্ত দেখে; সেনাবাহিনী বিরোধী বিক্ষোভে ফুঁসে উঠেছে সাধারণ মানুষ। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানের সেনাশাসক যেভাবে জনপ্রিয় নেতা শেখ মুজিবুর রহমানকে জনগণের দেওয়া দেশ শাসনের ম্যান্ডেট বঞ্চিত করে কারাগারে আটকে রেখেছিল; একালের জনপ্রিয় নেতা ইমরান খানের ক্ষেত্রে একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটেছে। বাংলাদেশে জুলাই বিপ্লব চলাকালে পাকিস্তানের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এ রকম আলোচনা; সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে তারুণ্যকে আরও বিক্ষুব্ধ করেছে। বাংলাদেশের ছাত্র-ছাত্রীকে অনুসরণ করে তারা কার্টুন-ক্যারিকেচার-মিম বানিয়ে সেনা প্রশাসন ও তাদের পুতুল সরকার শাহবাজ শরিফকে ব্যঙ্গ-বিদ্রুপে জর্জরিত করতে শুরু করেছে। পাকিস্তানে বাংলাদেশের তরুণদের বীরত্বগাথা এখন টক অফ দ্য টাউন। সুতরাং জুলাই বিপ্লবের রিক্রিয়েশন এখন কেবল সময়ের ব্যাপার বলে মনে হয়।

ভারতের শাসকগোষ্ঠী বাংলাদেশ সম্পর্কে দুটো ন্যারেটিভ চালু রেখেছিল। ১৯৭১ সালে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধে পাকিস্তানকে পরাজিত করে তারা বাংলাদেশের হাতে স্বাধীনতা তুলে দিয়েছিল। বলিউডের চলচ্চিত্রের মাধ্যমে এ রকম নেসেসারি ইলিউশন তৈরির অপচেষ্টা দৃশ্যমান হয়েছে। আরেকটি ন্যারেটিভ হলো শেখ হাসিনা ক্ষমতায় না থাকলে দেশটি মৌলবাদী দেশ হয়ে যাবে। ২০১৪ সাল থেকে ভারতে মৌলবাদী মোদি সরকার ক্ষমতায়। অথচ মোদি সমর্থিত গদি মিডিয়ায় মৌলবাদী আলোচকরা এসে ১৫ জুলাই থেকে প্রতিদিন ছাত্র-ছাত্রীদের  বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে মৌলবাদী ঢুকে পড়েছে বলে প্রাণপাত করেছেন। হাসিনার পতনের পর, গদি মিডিয়া বাংলাদেশে পতিত স্বৈরাচারের সমর্থক আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী ও পুলিশ-প্রশাসনে বেনিফিশিয়ারিদের ওপর বিক্ষুব্ধ জনতার কিছু হামলাকে, সংখ্যালঘুর ওপরে হামলা বলে পশ্চিমের সামনে বাংলাদেশকে মৌলবাদের খপ্পরে পড়ে যাওয়া দেশ হিসেবে চিত্রায়ণের চেষ্টায় নিরলস।

ভারতের তরুণরা ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে ইন্টারনেট থেকে তথ্য পেয়েছে; বাংলাদেশের তরুণদের সঙ্গে ভার্চুয়াল বন্ধুত্বে জেনেছে বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধাদের বীরগাথা সম্পর্কে। এমনকি ব্রিটিশবিরোধী ইনকিলাবে পূর্ববঙ্গের বিপ্লবীদের বীরগাথা সুবিদিত। আর এবার তারা নিজ চোখে দেখল বাংলাদেশের শিশু-কিশোর-তরুণদের নিজ হাতে লেখা বীরত্বের জুলাই বিপ্লব। হাসিনার পতনের পরে মাদ্রাসার ছাত্ররা মন্দির পাহারা দিতে শুরু করেছে; সাধারণ মানুষ হিন্দু জনগোষ্ঠীর নিরাপত্তা দিতে বদ্ধপরিকর। ভারতের ইউটিউবার দেশভক্ত ও অন্যরা, গদি মিডিয়া ও হোয়াটস অ্যাপ ইউনিভার্সিটির, বাংলাদেশে সংখ্যালঘু নির্যাতন নিয়ে ছড়ানো ফেইক নিউজগুলো একটা একটা করে তুলে ধরেছে। ফলে যে হিন্দু-মুসলমান বিভাজনের ছক কষে ব্রিটিশ আমল থেকে আজ অবধি অপশাসকরা বিদ্বেষের ব্যবসার আড়ালে দেশডাকাতি করে চলেছে; এই ক্রান্তিকালে তা একে একে উন্মোচিত হচ্ছে। ভারতের তারুণ্য বাংলাদেশের তরুণদের সফল বিপ্লব থেকে উদ্দীপিত হয়ে শাসক ও শোষকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে মিম, ক্যারিকেচার, ভøগ তৈরি করছে। এ সবই একবিংশের জনআন্দোলনের আঙ্গিক ও প্রকরণ। কাজেই বাংলাদেশের তারুণ্য সংঘটিত জুলাই নবজাগরণ ভারতের তারুণ্যকে শক্তি দিয়েছে কল্যাণরাষ্ট্রের স্বপ্ন বাস্তবায়নের কাজটি নিজ হাতে করার প্রত্যয়ে; এটা স্পষ্ট।

ব্রিটিশ কেরানি র‌্যাডক্লিফের পেন্সিলের দাগে বিভাজিত দক্ষিণ এশিয়া; বাংলাদেশের জুলাই বিপ্লবের অনুপ্রেরণায় মনোজগতে এক সাউথ এশিয়ান ইউনিয়ন ঘটিয়েছে যেন। ইন্টারনেট জগতে এ আসলে ইউরোপীয় ইউনিয়নের মতোই কল্যাণ জনপদের আকাক্সক্ষায় উজ্জীবিত ভূখণ্ড। একবিংশের তারুণ্যের ক্লিক দূরত্বে বিপ্লবী কমরেড; যারা এক সুরে বলছে, সব কিছু মনে রাখা হবে।

 

২০২ পঠিত ... ১৭:০৯, আগস্ট ১৪, ২০২৪

আরও eআরকি

পাঠকের মন্তব্য

আইডিয়া

কৌতুক

রম্য

সঙবাদ

স্যাটায়ার


Top