মুরাদ টাকলার ইতিবৃত্ত

১৪৭১ পঠিত ... ১৯:০৮, ডিসেম্বর ০৯, ২০২১

murad-takla

সীমিত ভাষাজ্ঞান দিয়ে কীবোর্ডে বিপর্যয় সৃষ্টিকারী ব্যক্তিকে সাধারণত আমরা ‘মুরাদ টাকলা’ বলে থাকি। তবে এর ইতিহাস জানতে গেলে আমাদেরকে যেতে হবে আরেকটু নয়, বেশ পেছনে।

বাংলাদেশে ইন্টারনেট ধীরে ধীরে জনপ্রিয় হতে থাকে এই শতাব্দীতেই। অনেকের বাড়িতেই পার্সোনাল কম্পিউটার যুক্ত হতে শুরু করে ইন্টারনেট দুনিয়ার সঙ্গে। বাড়তে থাকে কম্পিউটারে লেখালেখির পরিধি। ইংরেজির পাশাপাশি বাংলাতেও লেখার প্রয়োজন শুরু হয়। কিন্তু সাধারণ মানুষের জন্য বাংলা কিবোর্ডের লেআউট শিখে টাইপ করার ব্যাপারটা মোটেই সহজ বিষয় ছিল না। তার চাইতে সহজ হচ্ছে, রোমান হরফে বাংলা লেখা।  

ওই সময়টাতেই ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজের এক তরুণ শিক্ষার্থী মেহেদী হাসান খান ‘ভাষা হোক উন্মুক্ত’ স্লোগানে এক অভাবনীয় উদ্যোগ নেন। কয়েকজন বন্ধুকে সাথে নিয়ে মেহেদী প্রকাশ করেন প্রথম বাংলা ফোনেটিক লেআউট ‘অভ্র’। ২০০৩ সালের ২৬ মার্চ এটি ওমিক্রন ল্যাব থেকে প্রকাশিত হয়। ফোনেটিকের ধারণাটা অনেকটা এমন, রোমান হরফেই কেউ একজন ‘ami’ লিখলে সেটি ‘আমি’ হয়ে যাবে। এই ফোনেটিক লেআউটের ওপর ভিত্তি করেই বানানো হয় ‘অভ্র’ বাংলা কিবোর্ড।

 ২০০৭-এর পর থেকে এই মুল্লুকে ফেসবুকের জনপ্রিয়তা বাড়তে থাকে। ফেসবুকের ছায়ায় ঢাকা পড়ে যেতে থাকে অন্য সব সোশ্যাল মিডিয়া। প্রথম দিকে শহুরে তরুণদের কাছে এবং পরে ধীরে ধীরে সব শ্রেণি-পেশা-বয়সের মানুষ যুক্ত হতে থাকে এই নীল-সাদা দুনিয়ায়। এই সময়ে ফোনেটিক উচ্চারণে রোমান হরফে বাংলা লেখার চল বাড়তে থাকে।  

কিন্তু এরপর জয়ন্ত কুমার নামক এক ভদ্রলোক বাংলা অনলাইন জগতে সূচনা করেন এক নবযুগের। ভাষার বদলে যাওয়ার পরিক্রমায় আবিষ্কার হয় স্বতন্ত্র একটি ‘ভাষা’। ২০১২ সালের ১৫ জুলাই করা একটি ফেসবুক কমেন্টের স্ক্রিনশট হাতে আসে কিছু তরুণের। কমেন্টটি তাদের কেউ কেউ আগে দেখেছিলেন বটে, তবে সেটিকে খুব একটা পাত্তা দেননি। তবে এবার তারা সেই স্ক্রিনশট নিয়ে পড়ে রইলেন, মিশন হলো এর অর্থ উদ্ধার। কমেন্টটি ছিল, ‘Murad Takla jukti diya bol falti pic dicos kan lakapora kora kata bal.’ কোনো এক তর্কযুদ্ধে জয়ন্ত কুমার (Joyonto Kumer) নামক ওই ব্যক্তি কমেন্টটি করেছেন। এই কমেন্টের অর্থ বের করতে গিয়ে এতটাই নাজেহাল অবস্থায় পড়েছিলেন যে, তারা বাধ্য হয়ে একটি গ্রুপ খুললেন। দুই মাসের গবেষণার পর অবশেষে অর্থ বের করা সম্ভব হলো। জয়ন্ত কুমার বলতে চেয়েছিলেন, ‘মুরোদ থাকলে যুক্তি দিয়ে কথা বল। ফালতু পিক দিছস কেন? লেখাপড়া করে কথা বল।’  

263563641_628994684803117_6189488100158389289_n (1)

জয়ন্ত কুমারের সেই ঐতিহাসিক কমেন্টের স্ক্রিনশট

এই আবিষ্কারে বিমোহিত হয়ে পড়েছিলেন সেই তরুণ-দল। রোমান হরফে যারা দুর্বোধ্য ভাষায় বাংলা লেখেন, তাদের নিয়ে আগ্রহী হয়ে উঠেই এই ঘটনার মাস দেড়েক পর ২০১২ এর শেষদিকে তারা ফেসবুকে খোলেন পেজ ‘মুরাদ টাকলা’। এই ‘মুরাদ’-এর সঙ্গে অবশ্য মুরাদ নামের কারও কোন সম্পর্ক নেই, এমনকি টাক মাথার মানুষদেরও না। শুধু অনলাইনে এই দুর্বোধ্য বাংলা ‘লেখক’দের ‘সৃষ্টিকর্ম’  নিয়েই খোলা হয়েছিল এই পেজ। অল্প দিনের মাঝেই শব্দদুটো গ্রহণ করে নেয় বাংলার অনলাইনচারীরা। ধীরে ধীরে ভুলভাল লেখার প্রতিশব্দই হয়ে যায় ‘মুরাদ টাকলা’ শব্দদ্বয়।   

ততদিনে কম্পিউটার ও মোবাইলে বাংলা লেখার ব্যাপারটিও অপেক্ষাকৃত সহজ হয়ে আসে। অনলাইনে বাংলা লেখার প্রবণতাও বাড়তে থাকে। সেই সঙ্গে মুরাদ টাকলা পেজের কল্যাণে অগণিত মানুষ ‘আলোর পথে’ আসতে থাকেন। কিন্তু তাতেও থেমে থাকেনি রোমান হরফে বাংলা লেখার চল। ঠিক করে বলতে দুর্বোধ্য উচ্চারণে বাংলা লেখার চল। রোমান অর্থাৎ ইংরেজি হরফে বাংলা লেখার পদ্ধতিটি একটি নামও পেয়ে যায়। সেটি হচ্ছে বাংলিশ।

 মুরাদ টাকলা ভাষায় ‘আমি’ শব্দটিকে ‘ami’-র বদলে ‘ame’ কিংবা ‘দেখা’ শব্দটিকে ‘dekha’-র বদলে ‘daka’ লেখা হয়। বাংলিশে a, e এবং i নিয়ে যে কনফিউশন, সেটিই আসলে মুরাদ টাকলাদের বড় ব্যাকরণ। এ ছাড়া o এবং u বর্ণদুটিও টাকলাদের কাছে এক গোলকধাঁধা। v এর স্থলে b কিংবা b এর জায়গায় v এর ব্যবহারও চোখে পড়ে প্রচুর। ‘জ’ উচ্চারণে j এর বদলে g এর উপস্থিতিও লক্ষণীয়। এসবের সঙ্গে তাদের কাছে অপাংক্তেয় হয়ে আছে h বর্ণটি। আবার অন্যদিকে c বর্ণটির প্রতি আছে তাদের এক অমোঘ আকর্ষণ। ফলে দেখা যায় k ও s দুটি বর্ণকেই প্রতিস্থাপিত করছে c। এ ছাড়া র-ফলা ও রেফ ব্যবহারেও প্রচণ্ড অনীহা তাদের। যুক্তবর্ণ নিয়ে অজ্ঞতাও লক্ষ্য করা যায় টাকলা ভাষাভাষীদের মাঝে।

সব মিলিয়ে টাকলা ভাষা এতটাই জটিল হয়ে উঠেছে যে, সব সময় প্রমিত বাংলা পড়ে ও লিখে অভ্যস্ত যে কারও কাছে বাংলার মুরাদ টাকলা রূপটি একেবারেই নতুন কোনো ভাষা মনে হতে পারে। তা ছাড়া কখনো কখনো শব্দের মাঝে ইংরেজি সংখ্যা ব্যবহার করে কথাগুলোকে গোপন সাংকেতিক ভাষার পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া হয়। ‘একসাথে’ শব্দটি সাধারণত মুরাদ টাকলা ভাষায় ‘aksata’ লেখা হয়। এই শব্দটিকে যে ‘17a’ দিয়েও লেখা যায়, তা কল্পনা করা সুস্থ বুদ্ধির যে কারও জন্য কঠিনও বটে। এ কারণেই মুরাদ টাকলা ভাষা ‘ডিকোড’ করা অনেকের কাছেই অবসরের পছন্দের কাজ।  

প্রিয় পাঠক, কেমন লাগলো ‘মুরাদ টাকলা'র ইতিহাস?আপনাদের আরও সহজ করে দিতে earki-র পক্ষ থেকে থাকছে ‘মুরাদ টাকলা অভিধান’ নামক একটি সহায়িকা। যারা চলতে ফিরতে শব্দগুলো ডিকোড করতে হিমশিম খাচ্ছেন, অথবা যারা মুরাদ টাকলা ভাষা থেকে প্রমিত ভাষায় নিজেদের স্থানান্তর করতে চান, দেরি না করে ঝটপট বইটি সংগ্রহ করুন।

১৪৭১ পঠিত ... ১৯:০৮, ডিসেম্বর ০৯, ২০২১

আরও eআরকি

পাঠকের মন্তব্য

আইডিয়া

কৌতুক

রম্য

সঙবাদ

স্যাটায়ার


Top