এ প্রশ্ন নিশ্চয়ই আমাদের সবার মনে এসেছে। ভিপি নূর আসলে রাজনীতিবিদ-আমলা-ব্যবসায়ী মিলে গড়ে তোলা বাংলাদেশের স্বদেশী উপনিবেশের চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের জন্য একটা চ্যালেঞ্জ।
আওয়ামী লীগ যখন মুক্তিযোদ্ধা কোটার দোহাই দিয়ে পুলিশ ও প্রশাসনে যুবলীগ ও ছাত্রলীগের ছেলেদের চাকরি দিয়ে রক্ষীবাহিনী টু'পয়েন্ট তৈরি করার কাজে মশগুল ছিল; তখন নূর এই গাজোয়ারী কোটার বিরুদ্ধে ছাত্র আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছিল। ছাত্রলীগ তখন হেলমেট পরে এসে নূরকে হাতুড়ি দিয়ে পিটিয়েছিল।
রক্তাক্ত নূর ঠিকই দাবি আদায়ে সক্ষম হয়েছিল তার বন্ধুদের নিয়ে। এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডাকসু নির্বাচনে জনপ্রিয় ভোটে নূর শেখ হাসিনার মনোনীত ছাত্রলীগের প্রার্থীকে হারিয়ে দেয়।
ছাত্রলীগের ছেলেরা তখন সুযোগ পেলেই নূরকে রক্তাক্ত করেছে। নূর ভিপি হিসাবে গণভবনে হাসিনার সঙ্গে দেখা করে তাকে নিজের মায়ের সঙ্গে তাকে তুলনা করে স্বাভাবিক মৃত্যুর গ্যারান্টি পেতে চেষ্টা করে।
কিন্তু হাসিনা তো ৭৫-এ পিতৃহত্যার শোকে পিটিএসডি আক্রান্ত মানসিক রোগী; যাকে দিল্লিতে প্রণব মুখার্জির অভিভাবকত্বে ট্রেনিং দিয়ে ফ্রাংকেনস্টাইন হিসেবে তৈরি করে বাংলাদেশে পাঠান হয়েছিল ভারতের হারানো জমিদারি উদ্ধারে। ফলে এই উপনিবেশ টিকিয়ে রাখতে হাসিনা একের পর এক মানুষ খেয়েছে বাংলাদেশে।
ভিপি নূর একটি বৈশ্বিক পরিচিতি পেয়ে যাওয়ায় তাকে প্রাণে বাঁচিয়ে রাখা হয়। কিন্তু মাঝেমধ্যেই ছাত্রলীগ তাকে পিটিয়ে দিয়ে তার প্রতিবাদী কণ্ঠ স্তব্ধ করে রাখতে চেষ্টা করে। তবে নিম্নবিত্ত পরিবারের কালচারাল উইং হাসিনার আনুকূল্যে অনেক করে ভাত খেয়ে চর্বি হলে, নূরকে নূরা বলে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করতে শুরু করে। নিজেরা যেন বিরাট জমিদার তনয়; এমন একটি মনোভঙ্গি তাদের। ২০০৭ সালে বাটারবন আর পানি খেয়ে যারা মুখ শুকনা করে ঘুরত; তারা দশবছরে দুর্নীতির ধূলির ছটা পেয়ে ফেসবুকে কেক কাটার ছবি দিতে শুরু করে। নূর যেহেতু বাংলাদেশে ভারতীয় আগ্রাসনের বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিল; তাই এদেশে শিবসেনার অন্ধ ভক্তেরা নূরকে ছাগু বলে ডাকত। নিজেরা ফেসবুকে হনুমান সেজে কট্টর ধর্মপালন করলেও নূরের মাথায় টুপি দেখলেই তাকে শিবির ডাকত। ভয়ংকর মানসিক পীড়নের মাঝে বেঁচে থেকেছে ছেলেটি। একদিকে জীবনের হুমকি, অন্যদিকে রাজাকার ট্যাগিং; লীগ ও শিবসেনার ক্রমাগত তাকে হত্যাযোগ্য করে তোলার বুনো উল্লাসের মাঝেও নূর ঠিকই তার লক্ষ্যে স্থির থেকেছে।
বাংলাদেশের শক্তিধর রাজনীতির মাজারে সেজদা না দিয়ে বন্ধুদের নিয়ে রাজনৈতিক দল গড়েছে নূর। যখন সমাজের শিক্ষিত, প্রতিষ্ঠিত লোকেরা দাদা ‘আমি সাথে পাঁচে থাকি না’ বলে নমঃ নমঃ নমঃ হাসিনা মম করছে; নূর তখন হাসিনার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জারি রেখেছে।
সে কারণেই চব্বিশের জুলাই বিপ্লবের সময় নূরকে আবার নৃশংসভাবে রক্তাক্ত করেছে পুলিশে চাকরি পাওয়া যুবলীগ ও ছাত্রলীগের খুনেরা; রক্ষীবাহিনী টু'পয়েন্ট ও তার সৈনিকেরা।
৫ অগাস্ট নরভোজি হাসিনা প্রভুর কাছে দিল্লিতে পালিয়ে গেলে; নূরের ২০১৮ সালে শুরু করা বৈষম্যবিরোধী সংগ্রাম একটা গন্তব্যের দেখা পায়। পুলিশ-প্রশাসনে রক্ষীবাহিনী টু'পয়েন্ট ও-র লোকেরা রয়ে যায় এস্টাবলিশমেন্টের আলোছায়ায়। নূরের প্রতি তাদের জাত ক্রোধ।
আওয়ামী লীগ ভারতে পালিয়ে যাওয়ায় বিএনপি এখন সর্বেসর্বা। ১৭ বছরের অপেক্ষার পর এবার তাদের স্ব স্ব এলাকায় জমিদারি বুঝে নেবার পালা। বিএনপির প্রয়াত ও প্রবীণ নেতা-নেত্রীদের ছেলেমেয়েরা বিলেতে পড়ালেখা করে ফিরেছে জমিদারি বুঝে নিতে। তাদের চিন্তা হলো জমিদারের ছেলে জমিদার হবে, পীরের ছেলে পীর হবে।
নূর তার নিজের নির্বাচনী এলাকায় ঘুরতে গিয়ে আবার কালো টাকা পেশী শক্তির পাণ্ডাদের কাছে মার খায়। এত বড় সাহস নূরের; যে কিনা গণতান্ত্রিক সংগ্রাম শেষে নির্বাচনের মাধ্যমে জনপ্রতিনিধি হতে চায়।
জুলাই বিপ্লব জমিদারের ছেলে জমিদার হবার মিথ ভেঙে দিয়েছে। বাংলাদেশের জনমানুষের সন্তানেরা নিজস্ব শক্তিতে জ্বলে উঠে হাসিনার কালো শাসনের অবসান ঘটিয়েছে। দেশব্যাপী রোড মার্চে দেশের মানুষ তাদের ভালোবাসায় অভিষিক্ত করেছে।
ফলে ৫৪ বছর ধরে যে দুর্নীতিবাজ গোষ্ঠী মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, জাতীয়তাবাদ ও ইসলামি চেতনার লিপসার্ভিস দিয়ে ক্ষমতা কাঠামোকে জুয়াঘর হিসেবে গড়ে তুলেছে; দলীয় ক্যাডার ও পুলিশ দিয়ে নির্বিচারে মানুষ হত্যার মাঝ দিয়ে ভীতির রাজত্ব কায়েম করেছে ক্যানিবাল এলিট; দেশলুণ্ঠনের লাইসেন্স পেয়ে একে আজও দরিদ্র দেশ করে রেখেছে; বৈষম্যধূসর প্রজা করে রেখেছে নাগরিকদের; সেই প্রজাদের ছেলেমেয়েরা আজ ভয়হীন নাগরিক, রাজনীতিতে নিজেদের জায়গা দাবি করছে।
বিএনপির বৃদ্ধ নেতা ফজলুর রহমান যাদের, কই থিপুরোনোকা আসছে এরা, যাগো ঘর আছে দুয়ার নাই, বইসা খাওনের জায়গা নাই বলে তুচ্ছ করেছেন, প্রৌঢ়া নেত্রী রুমিন ফারহানা যাদের ফকিন্নি বলেছেন, অত্যন্ত রবীন্দ্রঘন সংস্কৃতিতে উৎকৃষ্ট নেতাদের সন্তান-সন্ততি যাদের ছোট লোক বলছে, দুর্নীতির প্রাসাদে বড় হওয়া দ্বিতীয় প্রজন্মের রাজনীতিক মনে করছেন, এদের ওয়েস্টিনে যাবার স্টেটাস নেই; সেখানে যাবে কেবল বংশানুক্রমে দুর্নীতি বসন্তের সন্তানেরা।
এই মনোজগতের পুলিশি ও সেনারুপ আজ সাঁঝে নুরুকে পিটিয়ে রক্তাক্ত করা। এস্টাবলিশমেন্টের পুরোনো জুয়াঘর বাঁচাতে মরিয়া কোটালপুত্রেরা। হাসিনাৎসির বে-আইনী শাসনের সহযোগী জাতীয় পার্টির জিএম কাদের, যিনি প্রতিটি নির্বাচনের আগে লীগের নেতাদের মতোই দিল্লির প্রভুর কাছে যেতেন; বাংলাদেশ কর্ষণে ভারতের ক্ষমতা কাঠামোর জোয়ালের একদিক রয়েছে লীগের কাঁধে; আরেকদিক রয়েছে জাতীয় পার্টির কাঁধে।
ডিহাসিনাৎসিফিকেশনের প্রয়োজনে আওয়ামী লীগের মতো তার সহযোগী কাদেরের জাতীয় পার্টির কার্যক্রমও স্থগিত হবার কথা ছিল। তা তো হয়নি; উপরন্তু নূর যখন তার দলীয় সহকর্মীদের নিয়ে এই অপরাধী দলটির শো-ডাউনের প্রতিবাদ করতে গেছে; তখন শান্তি শৃংখলা রক্ষার কথা বলে আইন শৃংখলা রক্ষা বাহিনী তাকে পিটিয়ে রক্তাক্ত করেছে। কমনসেন্স ব্যবহার করে আগেই হাসিনার অবৈধ শাসনের দোসর জাতীয় পার্টির কার্যক্রম স্থগিত করলে; হয়তো এ ঘটনা ঘটত না। কিংবা ঘটতই।
তবে এটা যেহেতু দুর্নীতিঘন পুরোনো ব্যবস্থার ক্রোধ; তাতে মনে হয়, নূরকে পিটিয়ে সিগন্যাল দেয়া হয়েছে রাজনীতিতে নবাগত জুলাই বিপ্লবীদের। অবিমৃষ্যকারিতা তো এমনই হয়। পশুপ্রবৃত্তি দেখিয়ে হাসিনাকে গুষ্টিসুদ্ধ ভারতে পালাতে দেখেও রাজনীতির পুরোনো জাঢ্য-জরদ-গব খেলোয়াড়, পুলিশ, এস্টাবলিশমেন্টের যদি হুঁশ না হয়ে থাকে; আবার যদি বাংলাদেশ তারুণ্যের প্রতি পশু প্রবৃত্তিতে ঝাঁপিয়ে পড়ে এরা; তাহলে পরিণতি একই রকম হবে। এক যাত্রার পৃথক ফল হয় না।
কাদের যেহেতু বাংলাদেশ রাজনীতিতে ভারতের প্রতিনিধি; কাজেই নূরের এই রক্তাক্ত হওয়াকে নেহাত পুলিশি একশন বলে মেনে নেওয়া যৌক্তিক নয়। গ্রিক দার্শনিক হেরাক্লাইটাস বলেছিলেন, একই স্রোতে দুবার অবগাহন করা যায় না। নূরের রক্ত পান করে হাসিনার স্রোতে দ্বিতীয়বার অবগাহনের চেষ্টা হজম করা কঠিন হবে বলেই মনে হয়।
পাঠকের মন্তব্য